ইউরোপে ক্রমেই গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে বাংলাদেশিদের অ্যাসাইলাম আবেদন
উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের হাজারো মানুষ পাড়ি জমান ইউরোপের অনেক দেশে। তাদের একটি বড় অংশ অবৈধভাবে ইউরোপে পা রাখেন। তারা যখন অবৈধভাবে ইউরোপে আসেন তখন তাদের সেখানে বৈধ হওয়ার আবেদন করতে হয়। এর অংশ হিসেবে তারা প্রথমে বেছে নেন রাজনৈতিক আশ্রয় বা পলিটিক্যাল অ্যাসাইলামকে।
যদি ইউরোপের কোনো দেশের আদালতে কোনো নাগরিকের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন গৃহীত হয় তাহলে তিনি বৈধভাবে সে দেশে থাকার অনুমতি পান। তিনি সে দেশের নিয়ম অনুযায়ী স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতা দেওয়া হয়। যেকোনো পেশাভিত্তিক কাজে তিনি নিযুক্ত হতে পারেন। তবে তিনি আইনত নিজ দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করতে পারেন না। তাকে সে দেশের সরকার শরণার্থী স্ট্যাটাসের পাশাপাশি পাসপোর্ট দেয়। এটি ‘এলিয়েন’স পাসপোর্ট’ নামে পরিচিত। এ ধরনের বিশেষ পাসপোর্টের মাধ্যমে তিনি নিজ দেশ ছাড়া অন্য সব দেশে যাতায়াত করতে পারেন।
প্রতি বছর কত সংখ্যক মানুষ অবৈধ পথে ইউরোপের দেশগুলোতে আসেন?— এমন প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দেওয়া সম্ভব না হলেও ইউরোপীয় বর্ডার ও কোস্টগার্ড এজেন্সি ফ্রন্টেক্স বলছে— প্রতি বছর অনুপ্রবেশের দায়ে ইউরোপের নানা দেশের সীমান্ত থেকে প্রায় এক লাখ পঁচিশ হাজার মানুষকে আটক করা হয়।
ইউরোপিয়ান কমিশন বলছে, গত ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখ ৮১ হাজার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন এসেছিল যুদ্ধবিধস্ত সিরিয়া ও আফগানিস্তান থেকে।
সিরিয়া ও আফগানিস্তানের পরের অবস্থানে রয়েছে ভেনেজুয়েলা, ইরাক, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, মরক্কো, পাকিস্তান ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশ।
অন্য দেশের তুলনায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের সংখ্যা অনেক কম।
অনিয়মিত অভিবাসীদের সবচেয়ে পছন্দের গন্তব্য হচ্ছে ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেন। এরপর রয়েছে গ্রিস, সাইপ্রাস, জার্মানি ও অস্ট্রিয়া। বর্তমানে অবশ্য এ চারটি দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন অনেক কমে এসেছে।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় মাথাপিছু হিসাবে গ্রিস ও সাইপ্রাসে শরণার্থীর সংখ্যা বেশি। অনিয়মিত অভিবাসীদের কাছে ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেন পছন্দের কারণ, ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় এ সব দেশ অভিবাসীদের প্রতি নমনীয়। কোনো কারণে যদি এ সব দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন গৃহীত না হয় তাহলে শর্তসাপেক্ষে পরবর্তীতে বৈধতার জন্যে তারা আবেদন করতে পারেন।
এছাড়াও, সরাসরিভাবে এ সব দেশ সাধারণত কাউকে তার নিজ দেশে ফেরত পাঠায় না। তাই রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন গৃহীত না হলেও এ সব দেশে অবস্থান করা যায়, যদি কারো নামে কোনো গুরুতর অপরাধের রেকর্ড না থাকে।
১৯৫১ সালের ২৮ জুলাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শরণার্থীবিষয়ক আইন প্রস্তাব করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডসহ অনেক দেশে শরণার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই আইনটি পাশ হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ২২ এপ্রিল থেকে তা কার্যকর করা হয়। ‘জেনেভা কনভেনশন’ হিসেবে পরিচিত এই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি তার ব্যক্তিগত কোনো বিশ্বাস বা রাজনৈতিক মতাদর্শ অথবা ধর্ম, বর্ণ বা জাতিগত কোনো পরিচয়ের কারণে নিজ দেশ বা সমাজে নিগৃহীত হন এবং তিনি যদি মনে করেন যে তিনি তার দেশে নিরাপদ নন তাহলে উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে তিনি অন্য যেকোনো দেশে শরণার্থী হিসেবে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার অধিকার রাখেন।
এছাড়াও, কোনো কারণে যদি তিনি দেশ ত্যাগে বাধ্য হন বা রাষ্ট্র যদি তার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে তিনি অন্য দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করতে পারবেন।
যদিও অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশি নাগরিকদের ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন হার অনেক কম; তেমনি বাংলাদেশি নাগরিকদের রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার আবেদন সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
এর প্রধান কারণ, বাংলাদেশিরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কারণ দেখিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে থাকেন। কিন্তু, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী অর্থনৈতিক কারণে কোনো ব্যক্তি কখনো রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার জন্য শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হতে পারবেন না।
দ্বিতীয়ত, অনেকে জেনেভা কনভেশন অনুযায়ী রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তিগত কোনো বিশ্বাসকে পুঁজি করে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবেদনের পক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ দিতে তারা ব্যর্থ হন। অনেক সময় অনেকে ভুয়া ডকুমেন্ট দিয়েও রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। এ সব কারণে ধীরে ধীরে বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন ইউরোপের দেশগুলোতে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে।
ইতালি-প্রবাসী সাংবাদিক ও অল ইউরোপ বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জমির হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘অতীতে বাংলাদেশের অনেক নাগরিক ইতালিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। কিন্তু, বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। প্রথমত, অনেক বাংলাদেশি ভুয়া ডকুমেন্ট দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন।’
‘অনেক সময় দেখা যায় যখন তাদেরকে একাধিকবার সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয় তখন তাদের আগের বক্তব্যের সঙ্গে পরের বক্তব্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এছাড়াও, অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক কোনো বিষয় বা পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কথা তুলে ধরেন। অর্থনৈতিক কারণে কাউকে কখনো শরণার্থী স্ট্যাটাস দেওয়া হয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইরাক, সিরিয়া বা আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নয়। অর্থনৈতিক সূচকে আমাদের দেশ বর্তমানে অনেক এগিয়ে। দক্ষিণ এশিয়া বা আফ্রিকার অনেক দেশে জাতিগত বা ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে সহিংসতার সংবাদ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এ রকম কোনো সমস্যা নেই। কাজেই ইউরোপে এখন বাংলাদেশি নাগরিকদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা আগের চেয়ে কম।’
তার মতে, ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যে ইতালি একটি মানবিক রাষ্ট্র। এই দেশ কাউকে সহজেই ফেরত পাঠায় না। এই দেশের সরকার নানা ক্যাটাগরিতে অনিয়মিত অভিবাসীদের বৈধতা পাওয়ার সুযোগ দেয়। অনেকের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও এই দেশে থেকে যেতে পারেন।’
‘যদিও সম্প্রতি ইতালির উপ-প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও সালভিনির অতি রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে অভিবাসীদের প্রতি দেশটির সাধারণ নাগরিকদের যে নমনীয়তা এক সময় ছিল তা থেকে এখন তারা কিছুটা সরে এসেছেন।’
জার্মানি-প্রবাসী জাকির হোসেন খান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এক সময় বাংলাদেশ থেকে অনেকে রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের অনেক দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের জন্য ইউরোপের দেশগুলোতে এমন সুযোগ অনেক কমে এসেছে।’
তার মতে, ‘অনেক সময় অনেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। আবেদনের স্বপক্ষে তারা যে সব কাগজ জমা দিয়েছেন সেগুলোও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে অবশ্য জার্মানিতে অনেক বাংলাদেশি ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা সমকামী পরিচয়ে রাজনৈতিক আবেদন করছেন। কেননা, বাংলাদেশে এগুলো ট্যাবুর মতো। তবে ঢালাওভাবে এরকম রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বিদেশের মাটিতে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে। আমাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।’
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও লন্ডন ১৯৭১ এর প্রতিষ্ঠাতা উজ্জ্বল দাশ ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘অন্য দেশগুলোতে যত অনিয়মিত বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, বৈধ উপায়ে আমাদের বিদেশে যাওয়ার পথ তত সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ইতালি, ফ্রান্স কিংবা স্পেনসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে অনুপ্রবেশের লক্ষ্যে অনেকে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকাও খরচ করেন। এই টাকা দিয়ে বাংলাদেশে যে কেউ ব্যবসা করতে পারেন। উন্নত জীবনের আশায় তারা ইউরোপে আসতে চান। কিন্তু, সেই জীবনকে পরবর্তীতে আর উপভোগ্য করে তোলা সম্ভব হয় না।’
তিনি সবাইকে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিদেশে যাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি কারিগরি ও প্রশিক্ষণমূলক কাজ ও ইংরেজি চর্চার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, যাতে দক্ষতার ভিত্তিতে বৈধভাবে এ দেশ থেকে অন্য দেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করার সুযোগ প্রসারিত হয়।
রাকিব হাসান রাফি: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া
Comments