২ মার্চ জাতীয় পতাকা দিবস

ছবি: সংগৃহীত

২ মার্চ জাতীয় পতাকা দিবস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবনে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।

১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী। তারা নিশ্চিতভাবেই ধারণা করেছিল যে ছয় দফার বাস্তবায়ন এবার হয়েই যাবে। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠতা আওয়ামী লীগের। ৭১ এর ১২ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দুই দফা আলোচনা হলো।

বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আলোচনা সন্তোষজনক, এবং প্রেসিডেন্ট খুব শিগগিরই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করতে সম্মত হয়েছেন।’ ইয়াহিয়া খানের বক্তব্যও ঠিক অনুরূপ ছিল। তিনি বললেন, ‘শেখ মুজিব তার সঙ্গে যে কথা বলেছেন, যে আলোচনা তুলেছেন সেসব যৌক্তিক ও সঠিক।’

কিন্তু, ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে লারকানায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাসভবনে গিয়ে গোপন বৈঠকে মিলিত হলেন পাকিস্তান আর্মির জেনারেলদের সঙ্গে।

৭১ এর জানুয়ারির শেষ দিকে দলের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে জুলফিকার আলী ভুট্টো  ঢাকায় এলেন। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই জাতীয় পরিষদের বৈঠকে ছয় দফার ওপর শাসনতন্ত্র তৈরির কথা বললেন। কিন্তু, ভুট্টো তখন আরও আলোচনার কথা বলেছিলেন। ভুট্টো চান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে হোক।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি, আওয়ামী লীগ তাদের ৬ দফার বিষয়ে আপস বা পরিবর্তন না করলে ভুট্টো অধিবেশনে যোগদানের বিরোধিতা করলেন। এরপর ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। সেই আলোচনার পর ভুট্টো জানালেন তার দেওয়া শর্ত না মানলে তিনি কোনভাবেই অধিবেশনে যোগ দিতে পারবেন না।

বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝে ফেললেন আসল কাহিনী। পাকিস্তানিরা নির্বাচনের ফল বানচাল করার জোরালো চেষ্টা করছে। তাই বঙ্গবন্ধুকেও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।

অন্যদিকে, ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো মিলে আঁকলেন আরেক ছক। পহেলা মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করলেন ইয়াহিয়া।

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হতেই মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছাড়াই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করল। তখন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্যরা হোটেল পূর্বাণীতে ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজে। এরই মধ্যে বিক্ষোভ মিছিল পূর্বাণীর সামনে। বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ আন্দোলন জোরদার করার পরামর্শ দিলেন। সঙ্গে ঘোষিত হলো ২ মার্চ থেকে ৩ মার্চ দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল চলবে।

২ মার্চ ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত’। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার পর সংগ্রামী ছাত্র সমাজের উদ্যোগে ২ মার্চ বিক্ষোভ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণের বটতলায়। বেলা ১১টার দিকে বক্তব্য দিচ্ছিলেন ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব। এমন সময় ছাত্রলীগের নেতা শেখ জাহিদ হোসেন একটি বাঁশের মাথায় পতাকা বেঁধে মঞ্চে এলেন।

রব ছাড়াও সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন ডাকসুর জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও শাহজাহান সিরাজ। সেই ছাত্র সমাবেশের নেতৃত্বে ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজসহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। সেখান থেকেই স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের কথা উঠেছিল।

২ মার্চের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তির বীজ বপন হয়েছিল। বক্তব্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা  বলেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যেকোনো ত্যাগ-তিতিক্ষার জন্য তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সমাবেশ শেষে তৎকালীন জিন্নাহ অ্যাভিনিউ তথা বায়তুল মুকাররম পর্যন্ত গিয়ে মিছিল শেষ হয়।

সেদিন দুপুরে ও রাতে যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সচিবালয়ে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়েছিল। রাতে পাকিস্তান রেডিওতে ঢাকায় কারফিউ জারির ঘোষণা এসেছিল।

কিন্তু, কারফিউ ভঙ্গ করে ছাত্র শ্রমিক জনতা শহরের বহু জায়গায় ‘কারফিউ মানি না’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’সহ নানা স্লোগানে বিক্ষোভ করেছিল। ছাত্র যুবক জনতা কারফিউ ভেঙে গভর্নর হাউজের দিকে যেতে শুরু করলে ডিআইটি মোড় ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে মিছিলে গুলি চালায় সেনাবাহিনী।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩ মার্চ ১৯৭১ পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছিলেন শাজাহান সিরাজ।

৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা শাহজাহান সিরাজ। বঙ্গবন্ধু নিজে অবশ্য জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ১৯৭১ এর ২৩ মার্চ।

জাতীয় পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছিল আরও কয়েক মাস আগে— ১৯৭০ সালের ৬ জুন। সেদিন ইকবাল হলের (বর্তমানের সার্জেন্ট জহুরুল হক) ১১৬ নম্বর কক্ষে পতাকার আকার, গঠনসহ পতাকার বিষয়ের পরিকল্পনার জন্য বৈঠকে বসেছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা।

আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, স্বপন কুমার চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, শিব নারায়ণ দাস, মার্শাল মনিরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন নেতা  সেখানে ছিলেন। ঐ সভায় কাজী আরেফ আহমেদের প্রাথমিক প্রস্তাবনার ওপর  আলোচনা শেষে পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। পতাকার ডিজাইন ঠিক করা হয়েছিল সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্য, তার মধ্যে হলুদে খচিত বাংলাদেশের মানচিত্র। ঐ রাতেই নিউমার্কেট থেকে সবুজ কাপড় কিনে তার মধ্যে লাল বৃত্ত সেলাই করে নেওয়া হয়েছিলো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কায়েদ আজম হলে (বর্তমান তিতুমীর হল)।

ওখান থেকে তা নেওয়া হয় শেরে বাংলা হলে। রাত ১১টা নাগাদ কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শিবনারায়ণ দাসের হাতে সম্পন্ন হয়েছিল পতাকার সম্পূর্ণ ডিজাইন। নিউমার্কেটের ছাত্রলীগ অফিসের কাছেই নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্সে বানানো হয়েছিল নতুন পতাকা।

৭ জুন বঙ্গবন্ধুর হাতে দেওয়া হয়েছিল সেই পতাকা। সে উপলক্ষে কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়েছিল। কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আ স ম আব্দুর রব। তিনি সেই পতাকা তুলে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর  হাতে। বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে সেই পতাকা ছাত্র-জনতার সামনে তুলে ধরেছিলেন। পতাকাটি রাখা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বিধায় তখন হাসানুল হক ইনু পতাকাটি হলে তার রুমে নিয়ে সহপাঠী শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে দিয়েছিলেন। ওখান থেকে শরীফ নুরুল আম্বিয়া তার বন্ধু শেরে বাংলা হলের খবিরুজ্জামানকে লুকিয়ে রাখতে বলেছিলেন। যদিও সেই পতাকা পরবর্তীতে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসেন নিয়ে গিয়েছিলেন মালিবাগে তার বাসায়।

তথ্য সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ২ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পতাকা উত্তোলন (দৈনিক আজাদ)

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Blast heard in north Tehran, main road partially closed: AFP

Israel army says struck Iran centrifuge production, weapons manufacturing sites

20h ago