দেশ স্বাধীনটা প্রথম যুদ্ধ, পপ গানের শুরুটা দ্বিতীয় যুদ্ধ: জানে আলম
বাবা ভান্ডারী লাইন ছাড়া চলে না রেলগাড়ি বা একটি গন্ধমের লাগিয়া আল্লাহ বানাইলো দুনিয়া বা স্কুল খুইলাছেরে মাওলা স্কুল খুইলাছে— স্বাধীনতাত্তোর এই তিনটি গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অভিজাত বাসার ড্রয়িং রুমে বাজা শুরু করল এসব গান। আর এরকম কিছু গানই পপ শিল্পী জানে আলমকে দেয় বাংলাদেশের সংগীত জগতে এক অনন্য স্থান।
ফিরোজ সাঁই আগেই গেছেন, চলে গেছেন পপ গুরু আজম খান। আর গতকাল চলে গেলেন জানে আলম। এখন কেবল আছেন বাংলাদেশের পপ সংগীতের গোড়াপত্তনকারী চার খলিফার একজন ফেরদৌস ওয়াহিদ।
জানে আলমের গানের পথচলার শুরুটা মসৃণ ছিল না। তার শেখার কোনো সুযোগ ছিল না। বাসায় বোনকে যখন ওস্তাদ গান শেখাতেন, তখন তিনি শুনে শুনে শিখতেন। মায়ের হাতে মার পর্যন্ত খেয়েছেন গান গাওয়ার জন্য। মায়ের শখ ছিল ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। কারণ বাবা আব্দুস সালাম খান ছিলেন মানিকগঞ্জের বিখ্যাত ডাক্তার। তিনি চাইতেন ছেলে গান শিখুক, কিন্তু পড়াশোনাটা যেন ভালোভাবে করে। কারণ তখনো গানকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি। আর বাবার প্রশ্রয়েই তিনি পা রাখেন গানের জগতে।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে জন্ম নেওয়া এ গুণী শিল্পী এসএসসি পাশ করে ঢাকায় চলে আসেন। ইতোমধ্যে তিনি খুদেশিল্পী হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করতে শুরু করেন। তবে, ঢাকায় এসে তিনি ওস্তাদ ফজলুল হকের নজরে পড়েন। শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নেওয়ার জন্য জানে আলমকে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে আমন্ত্রণ জানান ওস্তাদ ফজলুল হক। তিনি শেখাও শুরু করলেন। ইতোমধ্যে তার লং-প্লে অ্যালবাম বের হয় যার নাম ছিল বনমালী। ঢাকা রেকর্ডস কোম্পানি থেকে ১১টি গানের সংকলন ছিল এই লং-প্লেটি।
দেশ তখন মাত্র স্বাধীন হয়েছে। উর্দু আর হিন্দি গানে তখন দেশ সয়লাব। তখন পপ গুরু আজম খান ভাবলেন দেশের তরুণদের দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং বাংলাদেশের গান দিয়েই বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে হবে। শুরু করলেন নতুন ধারার গান। তখনকার তরুণ প্রজন্ম যেন মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লেন।
আজম খানের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে জানে আলমের গানের ঢং পাল্টে গেল। পপ গুরু জানে আলমকে বলেন, গান হবে বাংলাদেশি, কথা হবে বাংলাদেশি, কিন্তু স্টাইলটা হবে বিদেশি এবং বাদ্যযন্ত্র হবে বিদেশি।
আজম খানের নেতৃত্বে ফেরদৌস ওয়াহিদ, জানে আলম, ফিরোজ সাঁই মিলে দেশে শুরু করেন নতুন ধারার পপ গান। ঢাকা-২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধা জানে আলম তখন ফোক বেইজড পপ গান করতে শুরু করলেন। সহজ কথায় সহজ সুরে মাটির মানুষ ও আধ্যাত্মিক গান গাইতে লাগলেন।
তারপর ইতিহাস। শুধুই এগিয়ে যাওয়া। নিজের গাওয়া গানের সংখ্যা চার হাজারের মতো। এ ছাড়া, তার লেখা, সুরে রয়েছে প্রায় তিন হাজার গান।
একবার জাপানের সম্রাটের জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল যায় জাপানে, সে দেশের আমন্ত্রণে। তো জানে আলম মঞ্চে উঠে গান শুরু করলেন একটি গন্ধমের লাগিয়া। রাজা খুশি হয়ে স্টেজে এসে জানে আলমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন আর সম্রাটের গলা থেকে একটি চেন খুলে জানে আলমকে দেন।
জানে আলম চলে গেলেন। রেখে গেলেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। কতটা জনপ্রিয়, সেটা বলে হয়তো বোঝানো যাবে না। একটা তথ্য দেই। বাবা ভান্ডারী লাইন ছাড়া চলে না রেলগাড়ি— এই গানটি এত জনপ্রিয় হয় যে পর পর ২৮ অ্যালবাম বের হয় শুধু মাইজ ভান্ডারীকে নিয়ে।
জানে আলমের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান বোধহয় দয়াল বাবা কেবলা কাবা আয়নার কারিগর। দেশ স্বাধীনকে জানে আলম বলতেন প্রথম যুদ্ধ আর পপ গানের শুরুটাকে তিনি বলতেন দ্বিতীয় যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি পেয়েছেন। কিন্তু, এত এত জনপ্রিয় গান গাওয়ার পরেও মেলেনি স্বাধীনতা বা একুশে পদক।
তিনি একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আর কত গান গাইলে, কতটা মানুষের হৃদয়ে গেলে এসব পদক পাওয়া যাবে জানি না। তবে অসংখ্য মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি।’
আরও পড়ুন:
Comments