কেন হয় না ত্বকী হত্যার বিচার

‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ এবং ‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড’, এই দুটি কথাই তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিচার বিলম্বিত শুধু হচ্ছে না, বিচার কাঁদছেও। বিচারের জন্য শুধু ত্বকীর বাবা-মা নয়, সারাদেশের বাবা-মায়ের অন্তরে কাঁদে।
তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ছবি: সংগৃহীত

‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ এবং ‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড’, এই দুটি কথাই তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিচার বিলম্বিত শুধু হচ্ছে না, বিচার কাঁদছেও। বিচারের জন্য শুধু ত্বকীর বাবা-মা নয়, সারাদেশের বাবা-মায়ের অন্তরে কাঁদে।

আগামী ৮ মার্চ ত্বকী হত্যার আট বছর পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু, এখন পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র দাখিল করেনি তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব। হত্যাকাণ্ডেরর এক বছর না যেতেই সংবাদ সম্মেলন করে যেখানে র‌্যাব বলেছিল কার নির্দেশে, কোথায়, কীভাবে ত্বকী খুন হয়েছিল, সেখানে আট বছর পরও বলছে, ‘তদন্ত চলছে’।

এ তদন্ত কবে শেষ হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেনি র‌্যাব। ত্বকীর বাবা বলছেন, ‘তদন্ত প্রথম বছরেই শেষ। নতুন করে কী তদন্ত করবে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী চাইলেই ত্বকী হত্যার বিচার হবে, অন্যথায় সম্ভব না।’

বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে শহরের শায়েস্তাখান সড়কস্থ ত্বকীর বাসায় যান দ্য ডেইলি স্টারের এই সংবাদদাতা। বাসায় ঢুকতে হাতের বায়ের কক্ষটিই ছিল ত্বকীর। এখানেই পড়ালেখা, কম্পিউটার ব্যবহার, আবৃত্তি, গান সবই করত সে। আজও রুমটিতে তার স্মৃতি ধরে রেখেছেন বাবা রফিউর রাব্বী ও মা রওনক রেহানা। কম্পিউটারের জায়গায় কম্পিউটার, শোকেসে ত্বকীর পাওয়া সব পুরস্কার, বই রাখা আছে। সাজানো-গোছানো সবই আছে, শুধু নেই আদরের ছেলে। কেবল দেয়ালে ছেলের একখানা ছবি।

স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা জানান, ‘ত্বকীর মা ভালো আবৃত্তি করতেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল এক নারী ছিলেন। তবে, ত্বকী মারা যাওয়ার পর থেকেই শোকে পাথর হয়ে গেছেন। এখন তেমন কোথাও যান না তিনি। সব সময় ত্বকীর স্মৃতি নিয়ে থাকেন।’

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের কথার মিল পাওয়া গেছে সরেজমিনে বাসায় গিয়ে। ত্বকীকে হারিয়ে তিনি এখনো কাঁদেন। ছলছল চোখে কোনো কথা বললেন না। ত্বকীর ছবি সম্বলিত বইগুলোতেই বার বার হাত বোলান।’

হঠাৎ পর্দা সরিয়ে ট্রে হাতে একটি কিশোর ঘরে আসে। চমকে উঠি। মনে হলো, ত্বকী বুঝি এলো ফিরে! তেমনই মায়াবী মুখ, তেমনই নিষ্পাপ শান্ত চাহনি। ছেলেটি ত্বকীর ছোট ভাই রাকিব মুহাম্মদ সাকী। সেও মায়ের মতোই কোনো কথা না বলে চলে যায়।

ত্বকীর বাবার বক্তব্য

ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বী বলেন, ‘নতুন করে কী বলার আছে। আমাদের সংবিধানে বাধ্যবাধকতা আছে ৬০ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র দিতে হবে। কিন্তু, আজকে আট বছরেও ত্বকী হত্যার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। ত্বকী হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মধ্যেই তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব সমস্ত রহস্য উদঘাটনের দাবি জানায় এবং কারা তাকে হত্যা করেছে, কেন করেছে, কোথায় করেছে সব কিছু সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে যে অভিযোগপত্র তারা তৈরি করেছে, সেটা আদালতে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু, সেই অভিযোগপত্র আজও পর্যন্ত তারা দেয়নি।’

‘ত্বকীর ঘাতকরা যেহেতু এ সরকার দলের সঙ্গে ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট, সেহেতু এ অভিযোগপত্রটা আটকে রাখা হয়েছে। আমাদের দেশের বাস্তবতাটা হচ্ছে এরকম যে, কোনো কিছুই প্রধানমন্ত্রীর আদেশ-নির্দেশ ছাড়া হয় না। বিচার যখন না হয়, তখন বুঝি যে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার কারণেই বিচারটা আটকে আছে।’

‘প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এ বিচার হওয়া সম্ভব না। কারণ, ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল শামীম ওসমানের ভাই সংসদ সদস্য নাসিম ওসমান মারা যাওয়ার পর জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী ওসমান পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছিলেন। এরপর থেকেই ত্বকী হত্যার তদন্ত কার্যত থেমে যায়। আর তাই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেলেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ত্বকীর খুনিদের ধরতে দ্বিধা করবে না। তাই ত্বকী হত্যার বিচার পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

‘আমরা বিশ্বাস করি ত্বকী হত্যার বিচার অবশ্যই হবে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত বা শেষ কথা না বা এ আওয়ামী লীগ সরকারই শেষ কথা না। বিচার পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া যায় না। হয়তো সাময়িকভাবে কিছুদিন আটকে রাখা যায়। যেটা এখন আটকে রাখা হয়েছে। যারা এ বিচারগুলো বিলম্বিত করছে, আটকে রাখছে, একসময় তাদেরকেও এ বিচার বন্ধ রাখার অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।’

র‌্যাবের দাবি তদন্ত চলছে?, তিনি বলেন, ‘র‌্যাব সাত বছর আগেই তদন্ত শেষ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ অভিযোগপত্রটি আটকে রেখেছে। এখন র‌্যাব কি বলবে যে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ বা ইচ্ছায় আমরা আটকে রেখেছি? তাই তারা জটিল, তদন্ত চলছে এসব বলছে।’

‘আমরা বিচার দাবি করে যাচ্ছি, দাবি করে যাব। শুধু ত্বকী হত্যা নয়, সাগর-রুনি ও তনুসহ সকল হত্যার বিচার দাবি করছি।’

ঘটনার বর্ণনা

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটি নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার আহ্বায়ক ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকেলে সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সড়ক থেকে তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। ওই রাতেই ত্বকীর পিতা রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় বিষয়টি উল্লেখ করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন এবং র‌্যাব-১১’র কার্যালয়ে চিঠি দেন। এর দুই দিন পর ৮ মার্চ সকালে শীতলক্ষ্যা নদীর খালের পাড় থেকে পুলিশ ত্বকীর মরদেহ উদ্ধার করে।

ত্বকী শহরের চাষাঢ়ায় এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল। ২০১৩ সালের ৭ মার্চ (নিখোঁজের একদিন পর ও মরদেহ উদ্ধারের একদিন আগে) এ লেভেল পরীক্ষার রেজাল্টে পদার্থবিজ্ঞানে ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৯৭ পেয়েছিল ত্বকী। যা সারাদেশে সর্বোচ্চ। এ ছাড়া, ও লেভেল পরীক্ষাতেও সে পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন পরীক্ষাতে দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল।

৮ মার্চ রাতেই ত্বকীর পিতা বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় দণ্ডবিধি ৩০২/৩৪ ধারায় আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন এবং ১৮ মার্চ জেলা পুলিশ সুপারের কাছে ত্বকী হত্যার জন্য তিনি শামীম ওসমান ও তার ছেলে অয়ন ওসমানসহ আট জনের নাম উল্লেখ করে একটি অবগতিপত্র দেন। তদন্তে মামলাটির আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় ২০১৩ সালের ২৮ মে উচ্চ আদালতের নির্দেশে র‌্যাব ত্বকী হত্যা মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে।

আজমেরী ওসমানের অফিসে র‌্যাবের অভিযান

ওই বছরের ৭ আগস্ট ওই সময়ের র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে আজমেরী ওসমানের মালিকানাধীন ‘উইনার ফ্যাশন’ এ অভিযান চালিয়ে রক্তমাখা জিন্স প্যান্ট, পিস্তলের বাট ও ইয়াবা সেবনের সরঞ্জামাদিসহ বিপুল পরিমাণ সামগ্রী উদ্ধার করে। অভিযানের সময়ে অফিসের দেয়াল, সোফা, আলমিরাসহ আসবাবপত্রে অসংখ্য বুলেটের দাগ পাওয়া যায়। ‘সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের’ দেওয়া ছয়টি টর্চার সেলের মধ্যে এ উইনার ফ্যাশনকে অন্যতম টর্চার সেল ও এখানে ত্বকীকে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগও করেছিলেন রফিউর রাব্বি।

২০১৪ সালের ৫ মার্চ, অর্থাৎ ত্বকী হত্যার প্রথম বছর পার হওয়ার ঠিক আগে র‌্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) কর্নেল জিয়াউল আহসান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘তদন্তে সন্দেহভাজন হিসেবে ওসমান পরিবারের সদস্য আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ত্বকী হত্যায় অংশ নেওয়া বাকি ১০ জন হলেন— রাজীব, কালাম শিকদার, মামুন, অপু, কাজল, শিপন, জামশেদ হোসেন, ইউসুফ হোসেন ওরফে লিটন, সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর ও তায়েবউদ্দিন ওরফে জ্যাকি। যেকোনো দিন এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’ কিন্তু, ২০২১ সালের মার্চেও অভিযোগপত্র আদালতে জমা পড়েনি।

র‌্যাব যেসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনেছিল তাদের সবাই পলাতক। তারা হলেন— রাজীব, কালাম সিকদার, মামুন, অপু, কাজল, শিপন ও আজমেরীর গাড়িচালক জামশেদ।

আজমেরী ওসমান নারায়ণগঞ্জের প্রয়াত এমপি নাসিম ওসমানের ছেলে, আওয়ামী লীগ নেতা এমপি শামীম ওসমান ও জাতীয় পার্টির এমপি সেলিম ওসমানের ভাতিজা।

দুই আসামির স্বীকারোক্তি

ত্বকী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র‌্যাব ইউসুফ হোসেন লিটন, সুলতান শওকত ভ্রমর, তায়েব উদ্দীন জ্যাকি ও সালেহ রহমান সীমান্ত নামের চার জনকে গ্রেপ্তার করে। ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার ইউসুফ হোসেন লিটন প্রথম ত্বকী মামলায় আদালতে জবানবন্দিতে সরাসরি জড়িত বলে স্বীকার করেন। তিনি জবানবন্দিতে সালেহ রহমান সীমান্তের জামতলা ধোপাপট্টির বাড়িতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের স্থান, কাল, পাত্র— সকল কিছুর বর্ণনা করেন।

অন্যদিকে এ ঘটনায় গ্রেপ্তার সুলতান শওকত ভ্রমর ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তিনি জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছিলেন, ত্বকী হত্যার নেতৃত্বে ছিলেন আজমেরী ওসমান। তবে, ১৬ দিন পর অর্থাৎ ২৮ নভেম্বর ভ্রমর তার জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আদালতে আবেদন করেন।

২০১৪ সালের ২০ মার্চ নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েই নারায়ণগঞ্জ ও পরে দেশ ত্যাগ করেন ভ্রমর। তিনি এখনো দেশের বাইরে। আদালত এখনো ভ্রমরের বিরুদ্ধ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রেখেছে। বাকিরা সবাই জামিনে বের হয়ে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন।

প্রকাশ্যে আজমেরী ওসমান

ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বী জানান, হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি আজমেরী ওসমান তখন আত্মগোপনে ছিলেন। পরে র‌্যাবের তৎপরতা থেমে গেলে আড়াল থেকে বেরিয়ে প্রকাশ্যে আসেন তিনি। আর রফিউর রাব্বী প্রতি মাসের ৮ তারিখে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করছেন।

আইনজীবীর বক্তব্য

তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলার আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ বাবু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত ১ মার্চ দুপুরে আমরা ত্বকী হত্যা মামলার দ্রুত অভিযোগপত্র দাখিল ও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে আসা আসামিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়ার জন্য আদালতে দরখাস্ত দেই। পরে আদালত শুনানি শেষে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাকে (র‌্যাব-১১) অভিযোগপত্র দ্রুত দাখিলের তাগিদ দেন। তবে, গ্রেপ্তারের আবেদন নামঞ্জুর করেন। এর পরিবর্তে আদেশে লিখেছেন, “তদন্তকারী কর্মকর্তার ইচ্ছা হলে আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারেন”।’

তাগিদ দেওয়ার পরও যদি র‌্যাব অভিযোগপত্র না দেয়, সেক্ষেত্রে কী করবেন?, তিনি বলেন, ‘আদালতে দরখাস্ত দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো কিছুই করার নেই। এখন পর্যন্ত পাঁচ থেকে ছয় বার অভিযোগপত্র দাখিল ও আসামিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতে দরখাস্ত করা হয়। প্রতিবারই আদালত থেকে তাগিদ দেওয়া হয়। তবে, এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। আদালতের তাগিদের পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাবের কোনো কার্যক্রমও আমরা দেখি না।’

তদন্তকারী সংস্থার বক্তব্য

তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব-১১’র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তদন্ত চলমান রয়েছে। জটিল মামলা, তাই সময় লাগছে। দৃশ্যমান না হলেও কাজ হচ্ছে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতনরাও তদারকি করছেন। সার্বক্ষণিক এ বিষয়ে তাদের জানানো হচ্ছে।’

আপনাদের কার্যক্রমে কোনো চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে কি না?, তিনি বলেন, ‘কোনো চাপ নেই। র‌্যাবের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে না জেনেই তদন্তভার র‌্যাবকে দেওয়া হয়। আমরা আইনগত প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তদন্তকাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’

এই হত্যাকাণ্ডের এক বছর না যেতেই সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেওয়া হলো শিগগিরই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। তাহলে এখন কেন এত সময় লাগছে?, র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কর্মকর্তা বদলি হয়, নতুন আসে, এজন্যেও সময় লাগছে। দৃশ্যমান না হলেও কাজ চলছে।’

কবে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে?, তিনি বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে তা বলা সম্ভব না। তবে, কাজ চলছে। যখনই শেষ হবে, তখনই জমা দেওয়া হবে।’

ত্বকী মঞ্চের বক্তব্য: হত্যার ৩ কারণ

সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের সদস্যসচিব ও কবি হালিম আজাদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ত্বকী হত্যার এক বছরের মাথায়, ২০১৪ সালের ৫ মার্চ র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল হাসান র‌্যাবের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। হত্যার কারণ হিসেবে তারা তিনটি বিষয়কে উল্লেখ করেন। এক, ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন; দুই, এর কিছু দিন আগে গণপরিবহনে শামীম ওসমান ও তার অনুগত লোকদের ব্যাপক চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে তার আন্দোলন; তিন, চিহ্নিত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভূমি দখলের প্রতিবাদে জনগণের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া। এ তিনটি কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা ত্বকীকে হত্যা করেছে বলে উল্লেখ করে র‌্যাব একটি অভিযোগপত্র তৈরি করেন এবং তা উপস্থিত সাংবাদিকদের সরবরাহ করেন।’

‘ত্বকী হত্যার এক বছর পরে নারায়ণগঞ্জে সংগঠিত সাত খুন মামলার কার্যক্রম নিম্ন ও উচ্চ আদালতে সম্পন্ন হয়েছে। শিশু রাজন-রাকিব হত্যাসহ কিছু মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হলেও ত্বকী হত্যার অভিযোগপত্রটি আদালতে পেশ করা হয় নাই। যার ফলে আদালতে ত্বকী হত্যায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া ঘাতক সুলতান শওকত ভ্রমর ও ঘাতক ইউসুফ হোসেন লিটনসহ সকলেই উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছে কেউবা দেশেই ঘুড়ে বেড়াচ্ছে।’

‘এখন একদিকে ঘাতক আজমেরী ওসমান প্রশাসনের সামনেই বীরদর্পে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন, অন্যদিকে শামীম ওসমান ত্বকী হত্যার বিচারপ্রার্থীদের নানাভাবে ভয়-ভীতি দেখিয়ে নিবৃত করতে ব্যর্থ হয়ে তাদেরকে হামলা করে, মামলা দিয়ে নির্যাতনের বিভিন্ন পথ অব্যাহত রেখেছেন। বহু সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মী বিভিন্ন সময় তার হামলার শিকার হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে, রবীন্দ্রজয়ন্তীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তারা হামলা চালিয়েছে।’

হালিম আজাদ আরও বলেন, ‘দেশের প্রতিটি নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকারকে সংবিধান নিশ্চিত করেছে। দেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে ৬০ দিনের মধ্যে তার অভিযোগপত্র আদালতে পেশ করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ সাত বছর আগে অভিযোগপত্র তৈরি হলেও এই হত্যাকাণ্ডের আট বছরেও অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়নি। আজকে সরকার সে অধিকার ক্ষুণ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানকেও লঙ্ঘন করে চলেছে। বিচার প্রক্রিয়া আটকে রেখে এখন হয়তো একে বিলম্বিত করা যাচ্ছে। কিন্তু এ বিচার বন্ধ করে দেওয়া কখনোই সম্ভব হবে না। অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় অবশ্যই যেমনি দাঁড়াতে হবে, তেমনি ঘাতকদের পক্ষ নিয়ে বিচার বন্ধ রাখার অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকেই একদিন বিচারের কাঠগড়ায় আসতে হবে।’

ত্বকী হত্যার ৮ বছরে ৪ দিনের কর্মসূচি

ত্বকী হত্যার আট বছর পূর্ণ হওয়ায় আগামী ৫, ৬, ৮ ও ২০ মার্চ নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ জানায়, গতকাল শুক্রবার বিকেল ৩টায় আলী আহাম্মদ চুনকা নগর মিলনায়তনের সামনে সমাবেশ হয়েছে। আজ শনিবার সকাল ৯টায় বন্দর উপজেলার সিরাজ শাহর আস্তানা কবরস্থানে ত্বকীর কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ ও মিলাদ মাহফিল হয়। আগামী ৮ মার্চ বিকেল ৫টায় সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে শীতলক্ষ্যা নদীর পাঁচ নম্বর খেয়াঘাটে আলোর ভাসান। ২০ মার্চ শনিবার বিকেল ৩টায় ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে ‘জাতীয় ত্বকী চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতা ২০২০’র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।

সামাজিক সংগঠনের বক্তব্য

সামাজিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’র সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নূর উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ত্বকী হত্যার বিচার হওয়া একান্ত জরুরি। এর আগে র‌্যাবের পক্ষ থেকে অভিযোগপত্র দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু, পরবর্তীতে সেটা দেওয়া হয়নি। কিছু আসামির নামও প্রকাশ করেছিল। সরকারের একটি অংশ কারো প্ররোচণায় বা কাউকে বাঁচাতে বিলম্ব করছে। অপরাধী ঘুরে বেড়াবে আর ভুক্তভোগী বিচার পাবে না, এ সংস্কৃতি হলে নগরবাসী তথা নগরের বাইরে যারা আছে আমরা সকলেই শঙ্কিত। আমরা চাই দ্রুত ত্বকী হত্যার অভিযোগপত্র দেওয়া হোক এবং অপরাধীদের শাস্তি হোক।’

মেয়র আইভীর বক্তব্য

ত্বকী হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এখনো বিচার দাবিতে সোচ্চার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিষয়টা দুঃখজনক যে এখনো পর্যন্ত আমরা ত্বকী হত্যার বিচার পেলাম না। এ সরকার অনেকগুলো আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচার করেছে। কিন্তু, ত্বকী হত্যার বিচারের কাজ শুরু হচ্ছে না। এটার জন্য আমরা ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। আমরা আশা করি, সরকার ত্বকী হত্যাকারীদের বিচার করবে এবং যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি নিশ্চিত করবে।’

আরও পড়ুন:

বিচারের বাণী সরবে কাঁদে

Comments

The Daily Star  | English

Govt cancels deal with Summit Group for second FSRU

Summit terms termination of the deal ‘unjustified’, says will appeal for review

46m ago