পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে ‘গেমচেঞ্জার’ আব্বাস সিদ্দিকী
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় বাম-কংগ্রেসের ব্রিগেড সমাবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়েছে আব্বাস সিদ্দিকীর দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)। সেদিনের বলিষ্ঠ ভাষণ ও সমর্থকদের জোরালো উপস্থিতির পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মাঠে তাকে নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের ২৭ থেকে ৩০ ভাগ মুসলিম ভোটারই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবে। গত এক দশক ধরে দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা তৃণমূলের অন্যতম মূল শক্তি ছিল মুসলিম ভোটার। এ বছর ‘ভাইজান’ হিসেবে জনপ্রিয় আব্বাস সিদ্দিকী নির্বাচন করায় মুসলিম ভোট ব্যাংকের পুরোটাই মমতার হাতছাড়া হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২৭ থেকে ৩০ ভাগ মুসলিম, যারা কখনোই বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় চায় না, তাদের ভোট বিবেচনা করলেও ক্ষমতায় আসার মতো বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোটের বিপুল ভোটার নেই। কিন্তু, তৃণমূল নিশ্চিতভাবেই তাদের ভোটব্যাংক হারাচ্ছে।
অন্যদিকে, মুসলিম জনগোষ্ঠীর মতো বড় একটি অংশের ভোট ভাগ হয়ে গেলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
আব্বাস সিদ্দিকীর রাজনীতি
১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা সাত মেয়াদে ৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট। ২০১১ ও ২০১৬ সালের নির্বাচনে জিতে টানা দুই মেয়াদে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আছে তৃণমূল কংগ্রেস।
ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর মতে, ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকেও বামফ্রন্ট রাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য তেমন কিছু করেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দল তৃণমূল মুসলিমদের উন্নয়নের কথা বলে ক্ষমতায় এলেও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। আব্বাস সিদ্দিকী মনে করেন, ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে মুসলিমদের নিজেদেরই রাজনীতিতে আসতে হবে।
মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ জন্য মমতা সরকারকে সরাসরি আক্রমণ করছেন আব্বাস। তবে, কেবল মুসলিম নয়, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্যেও কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘মমতা বাংলার স্বাধীনতা কেড়েছে। তাকে উৎখাত করে ছাড়ব। এটা বাংলা। এ বাংলা কাজী নজরুলের বাংলা, এ বাংলা সুভাষ চন্দ্র বসুর বাংলা, এই বাংলা সৈদয় আবু বকর সিদ্দিকীর বাংলা, এই বাংলা রবীন্দ্রনাথের বাংলা। এই বাংলা ব্রিটিশদের মতো কালো হাত ভেঙে দিয়েছে। বাংলা থেকে বিজেপি, তৃণমূলকে ছাটাই করে ছাড়ব। আমরা বাংলা বাঁচাব। গণতন্ত্র বাঁচাব। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান দেবো, প্রত্যেকের পেটে ভাত দেবো।’
তৃণমূল ও বিজেপি উভয় দলকেই হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, ‘পিছিয়ে পড়া দলিত, আদিবাসী, মুসলিম সবার জন্য আমি, আব্বাস সিদ্দিকী আছি।’
‘আমরা ভারতীয়, আমরা গর্বিত, ভিক্ষা নয়, অধিকার চাই’, স্লোগানে তিনি জনতাকে মাতিয়ে রাখেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমের কয়েকটি ভিডিওতে আব্বাস সিদ্দিকীর ভাষণে কয়েক হাজার সমর্থকদের ব্যাপক উল্লাস দেখা গেছে।
আইএসএফ কি সাম্প্রদায়িক দল?
আব্বাস সিদ্দিকী ও তার দলের বিরুদ্ধে মূল সমালোচনা হলো, দলটি সাম্প্রদায়িক।
গত ২ মার্চ মঙ্গলবার কংগ্রেস নেতা আনন্দ শর্মা আইএসএফকে ‘সাম্প্রদায়িক দল’ হিসেবে অভিহিত করে দলটির সঙ্গে জোট করার বিরোধিতা করেছেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, আনন্দ শর্মা আইএসএফ কিংবা এ ধরনের দলগুলোর সঙ্গে কংগ্রেসের জোট ‘দলের মূল আদর্শের পরিপন্থি’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘গান্ধী ও নেহেরুর কংগ্রেসের প্রাণ “ধর্মনিরপেক্ষতা”। আমাদের অবশ্যই সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।’
ব্রিগেড সমাবেশে আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস প্রধানের উপস্থিতি এবং সমর্থন লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অন্যদিকে, ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টে কেবল মুসলিম নয়, দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের নেতাও আছেন উল্লেখ করে বাম নেতারা বরাবরই আইএসএফকে কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তি নয় বলে দাবি করে এসেছেন।
গত ৩ মার্চ প্রকাশিত ইন্ডিয়া টুডের এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ সম্পর্কে আব্বাস সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র বাঁচাতে এবং গরিব ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এই জোটে নেমেছি। সুতরাং আমাদের লক্ষ্য যদি একই হয় তবে জোটের সঙ্গে কোনো সমস্যা হওয়া উচিত নয়।’
কংগ্রেস নেতা আনন্দ শর্মার আইএসএফের সঙ্গে জোট নিয়ে সমালোচনা সম্পর্কে কী ভাবছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাদের চিন্তাভাবনা যদি সাম্প্রদায়িক হয়, তবে আমাদের বলার কিছু নেই। আমরা সাম্প্রদায়িক কি না, সেটা জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন।’
এদিকে, তৃণমূল নেতারাও আইএসএফকে একটি সাম্প্রদায়িক দল দাবি করে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন। এর মধ্যে টলিউড নায়িকা ও তৃণমূলের সংসদ সদস্য নুসরাত জাহানকে নিয়ে কয়েক বছর আগে আব্বাস সিদ্দিকীর কটাক্ষ মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নতুন করে নিন্দা জানাতে শুরু করেছেন তৃণমূল নেতারা।
এদিক থেকে বিজেপিকে আব্বাস সিদ্দিকী কিংবা আইএসএফ নিয়ে খুব একটা সমালোচনাতে জড়াতে দেখা যাচ্ছে না। বিজেপি নেতারা আগের মতোই প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে মমতাবিরোধী অবস্থান ধরে রেখেছেন।
বিহার নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা
গত বছর বিহার নির্বাচনে পাঁচটি আসনে জিতেছিল আসাদউদ্দিন ওয়াইসির হায়দ্রাবাদভিত্তিক রাজনৈতিক দল সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন বা এমআইএম এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিহারের ক্ষমতায় আসে বিজেপি।
কংগ্রেসের অভিযোগ, আসাদউদ্দিন ওয়াইসি মূলত বিজেপিকে সুবিধা করে দিতেই নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। কংগ্রেসের নেতারা আসাদউদ্দিন ওয়াইসিকে সরাসরি ‘বিজেপির দালাল’ উল্লেখ করে বলেছেন, তার দল মুসলিম ভোট কেটেছে বলেই বিজেপি জোট বিহারে আবার ক্ষমতায় আসতে পারল।
পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনেও লড়াই করার কথা জানিয়েছিলেন আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। তিনি চাইছিলেন, আব্বাস সিদ্দিকীর ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের সঙ্গে জোট করতে। তবে, শেষমেশ কংগ্রেস-বামফ্রন্টের জোটেই যোগ দিয়েছেন আব্বাস।
এ প্রসঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘এমআইএমের সঙ্গে প্রথম বৈঠকের পর কয়েক সপ্তাহ ধরে তারা কোনো যোগাযোগ করেনি। আমরা জানি না যে এখানে (বাংলায়) তাদের দলের দায়িত্বে কে আছে।’
এদিকে, বিহার নির্বাচনের মতো বিজেপিকে নির্বাচনে জেতাতেই বিজেপি বিরোধীদের ভোট কাটার জন্য আব্বাস সিদ্দিকী মাঠে নেমেছেন বলে সরাসরি অভিযোগ করেছেন মমতা। তৃণমূল নেতারা আইএসএফকে বিজেপির ‘বি টিম’ বলেও মন্তব্য করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আব্বাস বলেন, ‘আমরা বিহারের পুনরাবৃত্তি চাই না। আমাদের লড়াই দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে।’
প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে বিজেপি বিরোধী অবস্থান কম কেন, জানতে চাইলে আব্বাস বলেন, ‘আমরা বিজেপি সম্পর্কে খুব বেশি কথা বলি না কারণ তারা আমাদের চিন্তাভাবনা প্রক্রিয়ায় নেই। তবে মমতা ব্যানার্জি না থাকলে বিজেপি কখনো বাংলায় পা রাখতে পারত না। বিজেপি থামাতে হলে প্রথমে মমতাকে সরাতে হবে।’
আইএসএফ নেতা মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তিনি একবার আমাদের বোকা বানিয়েছেন, আবারও সেই একই কাজ করতে চান। আমি শুনেছি তিনি ফুরফুরা শরীফে আসছেন। হঠাৎ তার নয় বছর পরে মাজারের কথা মনে পড়ল। তিনি আসলে বিজেপিকে নতুন ইস্যু ধরিয়ে দিতে চাইছেন। এখন বিজেপি আবার বলবে “দেখুন তিনি (মমতা) খাতুন হয়ে গেছেন!” সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে এসেছে মমতার হাত ধরেই।’
এবারের পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে মূল আসন নন্দীগ্রামে লড়বেন তৃণমূল প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল থেকে দলত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দেওয়া শুভেন্দু অধিকারী।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত নন্দীগ্রামে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট থেকে একজন আইএসএফের প্রার্থীকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। আসনটিতে এ বছর নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলবে বলে ধারণা করছেন পর্যবেক্ষকরা।
এ ছাড়াও, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, উত্তর চব্বিশ পরগনা, হুগলি, হাওড়া, বর্ধমান এবং বীরভূমের মতো দক্ষিণের জেলাগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয় আব্বাস।
তবে, নির্বাচনে প্রার্থী দিলেও তিনি নিজে ভোটে দাঁড়াবেন না বলে জানিয়েছেন আব্বাস সিদ্দিকী। তিনি বলেছেন, ‘আমি বরং কিংমেকার হতে চাই।’
আরও পড়ুন:
পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন: আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে জোট নিয়ে কংগ্রেসে বিরোধ
বিধানসভা নির্বাচনে মমতার পাশে শিবসেনা
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে মুসলিম ভোট ফ্যাক্টর
পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন: আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে জোট নিয়ে কংগ্রেসে বিরোধ
‘মোদি-দিদি আসলে এক’ কলকাতা বিগ্রেড সমাবেশে কংগ্রেস-বামফ্রন্ট
বিজেপিকে সুবিধা দিতেই ৮ দফায় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত, অভিযোগ মমতার
‘জয় বাংলা স্লোগানে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গকে বাংলাদেশ বানাতে চায়’
Comments