একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্ট

আমাকে শেখান, গুরু!

ইলাস্ট্রেশন: সংগৃহীত

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সহজলভ্য। অল্প সময়ের মধ্যেই দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা পৌঁছে গেছে ১০৩ এর উপরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় মাত্র ছয়টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বাংলাদেশে। এই সংখ্যা এখন ৫৩ (উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী)। দেশে উচ্চশিক্ষার সহজলভ্যতার এটি একটি প্রতিফলন। তবে সংখ্যার চেয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের প্রশ্ন কয়েক দশক ধরেই উদ্বেগের কারণ।

উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখতে হয় শিক্ষকদের। তাদের বিষয়টি আমরা বিশদভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন পূরণ করতেই তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি যে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করছে কিনা এবং কতটা করতে পারছেন।

শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের সন্তুষ্টির বিষয়টি দিয়ে শিক্ষার সামগ্রিক মান পর্যালোচনা করা যায়। তবে, এটা প্রায়শই অবহেলিত কিংবা কখনো বিদ্রুপাত্মক হিসেবেও দেখা যায়। শিক্ষকরা পরিপূর্ণ শিক্ষা দিতে পারলে শিক্ষার্থীদের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। অবশ্য, এটাই শিক্ষার মান বিচারে একমাত্র মানদণ্ড না হলেও, এটা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের প্রতি কতটা সন্তুষ্ট সে বিষয়ে সাধারণত বাংলাদেশে কোনো গবেষণা হয় না। তাই এই বিষয়ে জানতে চেষ্টা করেছে একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্ট।

শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে কতটা শিখছে, ক্লাসে তারা কেমন এবং তাদের আচরণে তারা কতটা সন্তুষ্ট সে বিষয়ে একটি জরিপ করা হয়েছে। জরিপে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, তাদের শিক্ষকরা বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহায়ক কিনা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের ব্যবহার সন্তোষজনক কিনা এবং তারা নিজ নিজ বিষয়ে দক্ষতার পাশাপাশি যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন কিনা। সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে আমরা জানতে চেয়েছি, শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও পেশাদার উভয় জীবনের জন্য দক্ষতা অর্জনে উৎসাহিত করছেন কিনা।

আমাদের জরিপের ফলাফল মূলত এই ইঙ্গিত দেয় যে, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের সম্পর্কে আলাদা মনোভাব পোষণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব ভালো হলেও তাদের মধ্যে বেশিরভাগের, বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ বা পড়ানোর দক্ষতা ভালো না। শিক্ষার্থীদের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং শিক্ষকদের এই দক্ষতাকে একাডেমিক যোগ্যতার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা মোটেই উচিত না।

আমরা মনে করি, ভালো ফলাফল করলেই সে ভালো শিক্ষক হয় না। কেবলমাত্র ফলাফলের ভিত্তিতে কাউকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে তা সমস্যার কারণ হতে পারে। বিশেষত যখন মুখস্থ বিদ্যার ওপর ভর করে ভালো ফলাফল করা হয়। যদি কোনো শিক্ষকের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগের সক্ষমতা বা সামগ্রিক দক্ষতা না থাকে, তাহলে তার শেখানোর দক্ষতা কমে যায়। একজন শিক্ষক যত বেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন, আনন্দের সঙ্গে, উৎসাহের সঙ্গে পাঠদান করতে পারবেন এবং তাদের জন্য সহজলভ্য হবেন, তার তত বেশি কার্যকরভাবে শিক্ষার্থীদের শেখাতে পারার সম্ভাবনা বাড়বে।

জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া বেশ কয়েকটি মন্তব্য পরীক্ষা করা যায়। তাদের একজন বলেন, ‘আমার মনে হয়, এমন একটি কর্তৃপক্ষ থাকা উচিত যারা এটা দেখবে যে শিক্ষকরা কি পড়াচ্ছেন। শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা অত্যন্ত চমৎকার। আবার অনেকে আছেন তাদের দেখলে মনে হয় দয়া করে আমাদের পড়াতে এসেছেন।’ আরেকজন বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানটি ভালো কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণ ভালো না। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষকরা। সবাই খারাপ না, তবে বেশিরভাগই তাই। মাঝে মাঝে তো মনে হয় আমাকে পড়ানোর জন্য তারা যোগ্য না (কিছু ক্ষেত্রে)।’ অপর এক শিক্ষার্থী মন্তব্য করেছেন, ‘(পড়াশোনা) বইয়ের মধ্যে। কিন্তু, বেশিরভাগ একাডেমিক শিক্ষাই যদি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে শেখানো হয় তাহলে আরও ভালো হয়।’

সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের প্রতি বন্ধুত্বের তারতম্য বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের কঠোরভাবে মূল্যায়ন করেছেন। তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষকদের কম অনুপ্রেরণামূলক বলে নম্বর দিয়েছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের ক্লাসগুলোকে অনেক বেশি উপভোগ্য বলে মনে করেন। মজার বিষয় হলো, যেসব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের বর্তমান প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যেতে চান তাদের মতে, তাদের এমন চিন্তা তৈরির পেছনে ভূমিকা রেখেছেন শিক্ষকরা।

শিক্ষকরা সাধারণত তাদের শিক্ষাগত দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। এটি যৌক্তিক ও উপযুক্ত। ফলস্বরূপ, তাদের অবশ্যই শ্রেণীকক্ষের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি হওয়া উচিত। শিক্ষকদের নিজেকে একজন রোল মডেল হিসেবে গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ক্লাসের সময় ও নিয়মানুবর্তিতার ক্ষেত্রে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা গ্রাহক বা নিজেরাই কোনো পণ্য কি না তা নিয়ে বহু বছর ধরে বিতর্ক চলছে। এ প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই। তবে, একটি বিকল্প মতামত হচ্ছে ‘শিক্ষার্থীরা গ্রাহক বা পণ্য নয়; তারা জ্ঞানের সহ-স্রষ্টা’। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেক শিক্ষার্থীর মাঝে অনুপ্রেরণা তৈরি করে। এতে করে শ্রেণীকক্ষের সংজ্ঞাই পুরোপুরি বদলে যায়। আদর্শগতভাবে শিক্ষকতা হচ্ছে জ্ঞান সহ-নির্মাণের একটি প্রক্রিয়া। শিক্ষকদের ভূমিকা এই প্রক্রিয়াকে কার্যকর, উপভোগযোগ্য ও অনুপ্রেরণামূলক করে তোলা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের আগে ও পরে শিক্ষকদের মূল্যায়ন এবং এই মূল্যায়নের ফলাফলের ভিত্তিতে তাদের প্রশিক্ষণ ও গাইডেন্স দেওয়ার বিষয়ে একাডেমিকভাবে অবশ্যই জোর দিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নগুলো কেবলমাত্র তাদের ভাবনা মনে না করে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।

অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের এই প্রতিক্রিয়ার মূল্য বোঝেন। তবে, এমন অনেকে আছেন যারা শিক্ষার্থীদের এই মূল্যায়ন গুরুত্বের সঙ্গে নেন না এবং যারা গুরুত্ব দিতে চান তাদের হেয় করেন। এমনই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া এক শিক্ষার্থীকে বলা হয়েছিল, ‘আমি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। তোমাদের মূল্যায়ন আমার কর্মক্ষেত্রে বা ভবিষ্যতে এগিয়ে চলার পথে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে না।’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য এই ধরণের মানসিকতা অবশ্যই বদলাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবশ্যই শিক্ষকদের এমন আচরণ মোকাবিলা করতে দৃঢ় নীতি গ্রহণ করতে হবে।

আশা করি আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরও বেশি শিক্ষক যত্নশীল মনোভাব নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে সত্যিকারের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবেন। তবেই সত্যিকারের অর্থে মানসম্মত শিক্ষাদান সম্ভব হবে।

 

মাসুম আলভী চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করছেন। ড. আন্দালিব পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। ড. আন্দালিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অনুষদের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এই নিবন্ধটি তৈরি করেন এবং অপ-এডের জন্য উপস্থাপন করেন। অপ-এডগুলো লেখা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ওপর আলোকপাতের মাধ্যমে এবং একে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে। ‘একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রকল্প’তে অবদান রাখতে ইচ্ছুক যে কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ড. আন্দালিবের সঙ্গে [email protected] মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

What's causing the unrest among factory workers?

Kalpona Akter, labour rights activist and president of Bangladesh Garment and Industrial Workers Federation, talks to Monorom Polok of The Daily Star about the recent ready-made garments (RMG) workers’ unrest.

8h ago