ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পূর্ব প্রস্তুতি

বঙ্গবন্ধু: ৭ মার্চ ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণকে বলা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম ডাক। ঐতিহাসিক সেই ভাষণ পরবর্তীতে ইউনেসকো ডকুমেন্টারি হেরিটেজ (প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অনুবাদ হয়েছে ১২টি ভাষায়। কেমন ছিল সেই ভাষণের পূর্ব প্রস্তুতি?

জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত হলে বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে হরতালের ডাক দেন। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে এক বিশাল সমাবেশে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। ওই ভাষণেই ৭ মার্চ রেসকোর্সে ভাষণ দিবেন বলে ঘোষণা করেন তিনি।

৭ মার্চ জনসভার দিন ধার্য হলে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি জানান ছাত্র নেতাদের অনেকে। যদিও এটা চাপ ছিল না। আবার অন্যদিকে আলোচনার পথও উন্মুক্ত ছিল অনেকটা। এক তরুণ নেতা সেদিন দুপুরের দিকে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়া জনগণ মানবে না।’ জবাবে খানিকটা অসন্তুষ্ট হয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মানুষের নেতৃত্ব দেব, তারা দেবে না। তোমরা তোমাদের কাজে যাও।’

বঙ্গবন্ধু ছাত্র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বললেন। জাতীয় চার নেতার সঙ্গেও কথা বললেন, মতামত নিলেন। ৬ মার্চ রাতেও জাতীয় চার নেতা ছাড়া বেশ কজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। সামরিক শাসন তুলে নেওয়া, সেনাদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়া, গণহত্যার তদন্ত ও গনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

পরের দিন কী বলবেন সে বিষয়ে ৬ মার্চ সারা রাত ভেবেছেন বঙ্গবন্ধু। কখনো উদ্বিগ্ন পায়ে পায়চারি করেছেন পাইপ হাতে, কখনো লিখেছেন। যদিও ৭ মার্চের ভাষণ কোনো লিখিত আকার ছিল না। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তার চিন্তা ও উদ্বেগ দেখে বলেছিলেন, ‘তুমি নিজে যা বিশ্বাস করো তাই বলবে।’ বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই ভাষণের প্রস্তুতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘৭ মার্চ ভাষণের আগে আম্মা আব্বাকে বলেন, “অনেকেই অনেক কথা বলবে। তুমি সারাজীবন আন্দোলন সংগ্রাম করেছ, জেল খেটেছ। তুমি জানো কী বলতে হবে, মানুষ কী শুনতে চায়। তোমার মনে যে কথা আসবে সে কথাই বলবা।”’

৭ মার্চের সকাল থেকে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির বাড়িতে ভিড় ছিল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের। সবাই নিজ নিজ মতামত পেশ করেছিলেন। সেদিন জনসভা উপলক্ষে সবার মনে একদিকে যেমন উচ্ছ্বাস ছিল, তেমনি ছিল শঙ্কাও। বেশিরভাগ মানুষই ধারণা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু এই সমাবেশ থেকেই সরাসরি স্বাধীনতার ডাক দিবেন। আর আশঙ্কা ছিল, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলে গোলাবারুদ-কামান দিয়ে হামলা করা হবে রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতার ওপর। ওই দিন সকাল থেকেই ঢাকা যেন পরিণত হলো মিছিলের নগরীতে। সারাদেশের মানুষ ভাষণ শুনতে ছুটছিল ঢাকার দিকে। তাদের গন্তব্য একটাই- রেসকোর্স ময়দান। রেসকোর্সে ভাষণ দিতে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু কথা বলেন ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সঙ্গে। ড. কামাল হোসেনকে বঙ্গবন্ধু নিজে বলেছিলেন, ‘আমি তো লিখিত বক্তব্য দেব না। আমি আমার মতো বক্তব্য দেব। পয়েন্টগুলো ফরমুলেট করো।’

বঙ্গবন্ধু মঞ্চে যাওয়ার আগে বেশ কয়েকবার চোখ বুলিয়েছিলেন কেবল সেই লিখিত খসড়ায়। আর বক্তব্য দিয়েছেন নিজের মতো করে। বঙ্গবন্ধু জানতেন, তিনি যদি এককভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তবে তা বিপজ্জনক হবে, পাকিস্তানীরা গুলি চালাবে। সেদিনের প্রস্তুতিও ছিল ভয়ানক। ড. কামাল হোসেন লিখেছিলেন, ‘সব জায়গায় মেশিনগান ফিট করা। শাহবাগ হোটেলের ছাদেও ছিল মেশিনগান। যেখানে জনগণের জমায়েত সেখানেই মেশিনগান। যুদ্ধ প্রস্তুতির কোনো বাকি রাখে নাই। ওই মুহূর্তে আনুষ্ঠানিক অর্থে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে গুলি ছাড়া আর  পথ নাই।’ এসব কিছু মাথায় রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

মিছিল, মানুষের ভিড়, মানুষ তাকে একনজর দেখতে আগলে দাঁড়াবে, এসব বিবেচনায় রেখেই পূর্ব নির্ধারিত রাস্তা বাদ দিয়ে বিকল্প পথে বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানে নেওয়া হয়েছিল।

সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফরিদপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের চলচ্চিত্র  পরিচালক অভিনেতা আবুল খায়ের এই ভাষণ ভিডিও করেন। এইচ এন খোন্দকার করেছিলেন সেই ভাষণের অডিও রেকর্ড। অডিও রেকর্ডটি তারপর আবুল খায়েরেরই মালিকানাধীন রেকর্ড লেভেল ঢাকা আর্কাইভ করেছিল। অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের এক কপি দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। অডিওর এক কপি ভারত সরকারকে এবং তিন হাজার কপি অডিও রেকর্ড সারাবিশ্বে বিতরণ করা হয়েছিল ভারতের রেকর্ড লেভেল এইচএমভি রেকর্ডসকে দিয়ে।

৭ মার্চের ভাষণের পরদিন পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা আইএসআই রিপোর্ট দেয়, ‘চতুর শেখ মুজিব, চতুরতার সঙ্গে বক্তৃতা করে গেলেন। একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন, অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হওয়ার দায়িত্ব নিলেন না। নীরব দর্শকের ভূমিকা ছাড়া আমাদের কিছুই করার ছিল না।’

সূত্র- বিবিসি বাংলাকে দেওয়া তোফায়েল আহমেদের সাক্ষাৎকার; ‘৭ মার্চ কেন গুরুত্বপূর্ণ’- ড. কামাল হোসেন; শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ৮৫তম জন্ম বার্ষিকীতে শেখ হাসিনার বক্তব্য।

Comments

The Daily Star  | English

Gazipur Police Commissioner Nazmul Karim withdrawn

He was withdrawn in the face of a controversy over closing one lane of a highway while travelling from Dhaka to his workplace

1h ago