‘নারীর সমানাধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন’
বাংলাদেশে ৯৬ শতাংশ জমির মালিক পুরুষ। কেবল চার শতাংশ নারীর জমির মালিকানা আছে। কিন্তু এই চার শতাংশই সমাজের ধনী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। দরিদ্র ও প্রান্তিক নারীদের জমির ওপর কোনো অধিকার নেই। যদিও বিপুল সংখ্যক নারী কৃষি শ্রমের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু জমির মালিক না হওয়ায় কৃষক হিসেবে তাদের স্বীকৃতি নেই।
প্রান্তিক পর্যায়ের নারীরা তাদের স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে রাষ্ট্রীয় অনুদানে জমির মালিকানা পেতে পারেন। তবে একজন নারী বা বিধবা নারীদের জমির মালিকানা পেতে পুত্র সন্তান থাকার শর্ত আছে, যা নারীদের প্রতি সুস্পষ্ট বৈষম্য।
আজ মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টার এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত একটি ওয়েবিনারে আইনজীবী, নারী অধিকার কর্মী এবং নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়গুলো এবং বাংলাদেশি নারীদের প্রতি বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যের বিষয়ে আলোচনা করেন।
‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রতিশ্রুতি: টেকসই উন্নয়নে ভূমি ও কৃষিতে নারীর সমান অধিকার’ শীর্ষক এই ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞরা এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু উন্নতির বিষয় উল্লেখ করে নারীদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে কিছু সুপারিশ করেছেন।
এএলআরডির উপ-নির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি বলেন, ‘প্রান্তিক নারীদের জীবনযাত্রার উন্নতিতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। “আমার বাড়ি, আমার খামার” প্রকল্প থেকে ১৫ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি নারী উপকৃত হয়েছেন। কম্প্রিহেনসিভ ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম থেকে দুই লাখ ৬৫ হাজারেরও বেশি নারী উপকৃত হয়েছেন। নারীরা বিভিন্ন ধরণের ভাতাও পাচ্ছেন।’
‘তবে কেবল এই প্রকল্পগুলো তাদের জীবনমানে টেকসই উন্নয়ন আনতে পারে না। এগুলো স্বল্প-মেয়াদী সমাধান। আমাদের অবশ্যই সব বৈষম্যমূলক আইন সংস্কার করে, ক্ষতিকারক ও বৈষম্যমূলক চর্চা বন্ধ করে সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে’, বলেন তিনি।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক সমকাল পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশি নারীদের ব্যাপক ক্ষমতায়ন হয়। তারা রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করেছেন। এতে ভূমিসহ অন্যান্য সম্পদের মালিকানা অর্জন এবং সমাজের সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়।’
‘তবে নারীদের জন্য সংরক্ষিত সংসদীয় আসনের নামে কখনো কখনো আমরা রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য হিসেবে তাদের ভূমিকা উপেক্ষা করি। আমাদের এই মানসিকতা পরিবর্তন করা দরকার’, যোগ করেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার বলেন, ‘অনেক নারী অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত। বিশেষত কৃষিতে তারা শ্রম দেন। এই নারীদের বেশিরভাগই পুরুষের তুলনায় অনেক কম বা খুব নামমাত্র মজুরি পান।’
তিনি বলেন, ‘নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে পুরুষ ও নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মস্থলে সমান মজুরি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সংসদ সদস্য শিরিন আক্তার বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই বৈষম্যমূলক আইন ও সামাজিক রীতিনীতি সংস্কার করতে হবে। সব ধর্মের নারীরা পুরুষদের মতো সমানভাবে সম্পদের উত্তরাধিকারী যেন হয়, আইনে তা নিশ্চিত করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘আমার নির্বাচনী আসনে বেশিরভাগ জমি সামাজিকভাবে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের মালিকানাধীন। নারীদের সমাজে দুর্বল অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে তারা প্রায়ই জমি দখল করেন। ভূমির ওপর নারীর মালিকানা রক্ষায় নারী অধিকার কর্মীদের সম্মিলিতভাবে এই ভূমি দখলকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো উচিত।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নারীরা দেশের সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তারা তাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে কৃষি কাজ করেন। তবে তাদের কঠোর পরিশ্রম স্বীকৃত নয়।’
‘আমাদের সরকারের কাছ থেকে আইনি স্বীকৃতি পাওয়া প্রয়োজন এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে আমরা আপনাদের সবার সহযোগিতা চাই’, বলেন তিনি।
আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ও সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘এখনো বাংলাদেশি নারীরা নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আমরা দেখেছি গতকালই এক প্রতিবন্ধী নারীকে কীভাবে বাস থেকে ফেলে দিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।’
‘আমাদের আইন সংস্কার করা দরকার এবং নারীর প্রতি সব ধরণের বৈষম্য রোধে আমাদের বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ করতে হবে’, বলেন তিনি।
ওয়েবিনার শেষে বক্তারা নারীদের ভূমির অধিকার নিশ্চিতে কয়েকটি সুপারিশ করেন, যার মধ্যে আছে- নিঃশর্তভাবে ভুমির ওপর নারীর প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা, কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারী শ্রমিকদের সমান মজুরি নিশ্চিত করা, নারীদের উৎপাদিত পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত করা, বাজার পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং নারীদের জন্য প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
Comments