কাদের মির্জা-বাদল গ্রুপের সংঘর্ষ: বসুরহাটে ১৪৪ ধারা, আটক ২৭
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভায় আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় আজ বুধবার সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করেছে উপজেলা প্রশাসন।
গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আলাউদ্দিন (৩২) নামের এক যুবক নিহত হন। এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরও ২০ জন।
গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন- রাজিব, মাইনউদ্দিন, জাকির হোসেন হৃদয়, আরাফাত, আনোয়ার হোসেন, শাহ আলম, রাসেল, দেলোয়ার হোসেন, মো. সেলিম, শাহাদাত হোসেন, রাকিবুল ইসলাম, রিপন ও নুরুল ইসলাম। এদের মধ্যে জাকির হোসেন হৃদয়কে গুরুতর অবস্থায় রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সদস্য মোতায়েন করা হয়। রাতেই অভিযান চালিয়ে ২৭ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সোমবার বিকালে বসুরহাট রূপালী চত্বরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াত খানের ওপর মেয়র আবদুল কাদের মির্জার অনুসারীদের হামলার প্রতিবাদে মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় রূপালী চত্বরে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে আওয়ামী লীগের একাংশ (মিজানুর রহমান বাদল গ্রুপ)। সন্ধ্যা ৬টার দিকে থানার পশ্চিম পাশের সড়ক (মাকসুদা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়) দিয়ে সভায় হামলার চেষ্টা চালায় মির্জার সমর্থকরা। এসময় উভয় পক্ষের সমর্থকরা মুখোমুখি হলে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে এ সংঘর্ষ পৌর এলাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। রাত ৮টার দিকে মেয়র কাদের মির্জার সমর্থকরা বসুরহাট বাজারে একটি মিছিল বের করলে বাদলের সমর্থকদের সঙ্গে পুনরায় সংঘর্ষ হয়। পরে কাদের মির্জার অনুসারীরা বসুরহাট পৌরসভা ভবন ও প্রাঙ্গণে অবস্থান নিলে বাদল গ্রুপের লোকজন ফের হামলা চালায়। এসময় তাদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলি বিনিময় শুরু হয়। উভয় পক্ষের গুলিতে ২০ জন আহত হন।
আহতদের উদ্ধার করে রাত পৌনে ১১টায় নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। এদের মধ্যে উপজেলার চরকালী গ্রামের মোমিনুল হকের ছেলে আলাউদ্দিনকে (৩০) মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
বসুরহাট একাডেমির শিক্ষক ও পৌর সভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা গুলিবিদ্ধ আনোয়ার হোসেন জানান, কাদের মির্জা তাদের নিয়ে রাত ৯টার দিকে বসুরহাট পৌর ভবনের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে বসে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় মিজানুর রহমান বাদল গ্রুপের ২০০-২৫০ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী পৌর ভবনটিকে চারপাশ থেকে ঘেরাও করে ফেলে। এসময় হেলমেট পরিহিত ৩০-৪০ জন সন্ত্রাসী পৌর ভবন লক্ষ্য করে অনবরত গুলি ছুড়তে থাকে।
গুলিতে তিনিসহ কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন দাবি করে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশ ও র্যাব ঘটনাস্থলে আসার আগেই হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। কাদের মির্জাকে হত্যা করার জন্যই তারা এই গুলি হামলা চালিয়েছে।’
তবে, গুলিতে নিহত আলাউদ্দিনকে নিজের অনুসারী বলে দাবি করেছেন কাদের মির্জা ও মিজানুর রহমান বাদল উভয়েই।
মিজানুর রহমান বাদলের আরও দাবি, কাদের মির্জার অনুসারীরাই তার সমর্থকদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার সৈয়দ মহিউদ্দিন আবদুল আজিম বলেন, ‘রাত পৌনে ১১টার দিকে গুলিবিদ্ধ ১৫ জনকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। এদের মধ্যে আলাউদ্দিন নামের এক যুবককে মৃত অবস্থায় আনা হয়। জাকির হোসেন হৃদয় নামের এক যুবককে গুরুতর অবস্থায় রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। নিহত যুবকের চোখে মুখে গুলিবিদ্ধ এবং পেটের ওপর ধারালো অস্ত্রের কোপের আঘাত ছিল। বাকি ১৩ জন হাসপাতালের ১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন।’
নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন জানান, সংঘর্ষে এক যুবক নিহত হয়েছেন। আরও বেশ কিছু লোক আহত হয়েছেন। রাতে কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন সড়কে গাছের গুড়ি ফেলে সড়ক অবরোধ করে দুষ্কৃতিকারীরা। রাত থেকে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা গাছের গুড়ি সরিয়ে সড়ক ফাকা করেছে। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ও রাতে সংঘর্ষের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ২৭ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
তিনি আরও জানান, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। গুলিতে হতাহতের ঘটনায় কোনো পক্ষই আজ বুধবার বেলা ১১টা পর্যন্ত লিখিত কোনো অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে পুলিশ তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বর্তমানে পুলিশ, ডিবি ও র্যাব সদস্যরা রাস্তায় টহল দিচ্ছেন। পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এর আগে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কোম্পানীগঞ্জের চাপরাশিরহাট পূর্ব বাজারে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই বসুরহাট পৌর মেয়র আবদুল কাদের মির্জা এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সেসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারসেল ও শর্টগানের গুলি ছুঁড়ে। ঘটনার ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে ত্রিমুখী সংঘর্ষের মুখে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক মুজাক্কিরসহ ৭-৮ জন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ৪৫মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান মুজাক্কির। এ ঘটনার ১৫ দিন পর আলাউদ্দিন নামের আরেক যুবক গুলিতে মারা গেল।
উল্লেখ্য, গত ২২ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জেরে বসুরহাট পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন:
Comments