করোনাভাইরাস

যুক্তরাজ্যের স্ট্রেইন দেশে শনাক্ত: ‘দেরিতে জানিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছি’

গত ৫ জানুয়ারি দেশে যুক্তরাজ্যে পাওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরন শনাক্ত হলেও তখন সেটি জানানো হয়নি। নতুন ধরন পাওয়ার বিষয়ে আজ সংবাদ প্রকাশ করেছে দ্য ডেইলি স্টার।
ছবি: রয়টার্স

গত ৫ জানুয়ারি দেশে যুক্তরাজ্যে পাওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরন শনাক্ত হলেও তখন সেটি জানানো হয়নি। নতুন ধরন পাওয়ার বিষয়ে আজ সংবাদ প্রকাশ করেছে দ্য ডেইলি স্টার

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ ও ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম। (বাম দিকে থেকে)

প্রশ্ন উঠেছে— এত আগে যুক্তরাজ্যের ধরন শনাক্ত করেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা আইইডিসিআর কেন তখন জানায়নি? দেশের প্রচলিত আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় নতুন ধরন শনাক্ত হয় না। সেক্ষেত্রে নতুন কিট ব্যবহার করা দরকার কি না? বর্তমানে করণীয়?, ডেইলি স্টার কথা বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এবং বায়ো মেডিকেল সাইন্স গবেষক ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. খোন্দকার মেহেদী আকরামের সঙ্গে।

অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘যখন যুক্তরাজ্যে এই ধরনটা পাওয়া গেল এবং আমরা জানলাম যে, এট খুব দ্রুত ছড়ায়, তখন বলা হয়েছিল আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার, যাতে বাংলাদেশে এই ধরনটা না আসে। আমাদের দেশের অনেকেই যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। তারা তো দেশে আসবেই। কিন্তু, যথাযথভাবে তাদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা দরকার ছিল। তাদের কারো তিন দিনের, কারো সাত দিনের আবার কারো কোনো কোয়ারেন্টিনই হয়নি।’

‘নতুন ধরনটা শনাক্ত হওয়ার এতদিন পর তা জানানো হলো, এর মধ্যে তো এগুলো ছড়িয়ে যায়। কিন্তু, উচিত ছিল শুরুতেই সিরিয়াসভাবে সেটা জানানো, মানুষকে সচেতন করা। এই ধরনটা যাতে বেশি করে শনাক্ত করা যায়, সেই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। মানে জিনোম সিকোয়েন্সিংটা বাড়ানো দরকার। দ্বিতীয়ত, যখনই আমরা কারোর মধ্যে এই ধরনটা শনাক্ত করব, তখনই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ কঠোরভাবে তার আইসোলেশন নিশ্চিত করা, যাতে তার কাছ থেকে এটা না ছড়ায়। এরপর তার কন্টাক্ট ট্রেসিং করা। এটাতে খুব জোর দিতে হবে। সংস্পর্শে যাওয়া ব্যক্তিদের পরীক্ষা করা, তাদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা। এই কাজগুলো যদি আমরা করি, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব। কিন্তু, আমরা যদি তা স্বীকারই করতে না চাই, দেরিতে জানাই, তার মানে আমরা আসলে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছি।’

নতুন ধরন শনাক্তের পর যুক্তরাজ্যের নেওয়া ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যখন সেখানে নতুন ধরনটা শনাক্ত হলো, তারা কত সিরিয়াস হয়ে গেল। এরপর যেসব দেশে গেল, সবাই সতর্ক হলো। কাজেই এটা যাতে দ্রুত শনাক্ত করা যায়, সেই ব্যবস্থাই আমাদের নিতে হবে। আরেকটা বিষয়, ভারতে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টটাও শনাক্ত হয়েছে। সেই ভ্যারিয়েন্টে কিন্তু অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটাও কাজ করে না। সেক্ষেত্রে আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে যাতে ভারতে থেকে সেটা আমাদের দেশে চলে না আসে। সিরিয়াস না হলে এতদিন আমরা যেভাবে কষ্ট ভোগ করেছি, ভবিষ্যতে আরও কষ্ট করতে হবে।’

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের ধরনটা যখন শনাক্ত হয়ছে, তখনই আমাদের জানানো উচিত ছিল। কর্তৃপক্ষ কেন জানায়নি, সেটা জানি না। তাদের জিজ্ঞাসা করেন, জানুয়ারিতে পাওয়া গেলেও তারা কেন তখন জানাল না। আমার যেটা মনে হয়, তারা খুব বেশি তথ্য জানাতে চায় না। কিন্তু, এগুলো জানাতে হবে। মানুষের প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয় আছে। কাজেই পাওয়ার পরই তাদের জানানো উচিত ছিল।’

যত দ্রুত সম্ভব দেশে থ্রি-জিন আরটি-পিসিআর পরীক্ষা চালু করা দরকার বলে মনে করেন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি আরও বলেন, ‘যা করণীয়, সেগুলো আমরা তো বলেই আসছি। মাস্ক পরার কথা আমরা সবাই শুরু থেকেই বলছি। কিন্তু, অনেকেই মাস্ক পরছেন না। বিভিন্ন জায়গায় শারীরিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না। মোদ্দা কথা, স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। সবার আগে আমাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। তা না হলে করোনা ছড়িয়ে পড়বে। আমরা আগেই কোয়ারেন্টিনের কথা বলেছিলাম, তারা মানেনি। এখন তো প্রধানমন্ত্রীই বলেছেন যে, যুক্তরাজ্য থেকে যারা আসবেন, তাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার কথা। আমরা জানতে চাইলে বলা হয়, ঠিকমতো কোয়ারেন্টিন প্রক্রিয়া পালন করা হচ্ছে। বাস্তবে হচ্ছে কি না, সে খবর নেওয়া দরকার।’

ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলেন, ‘যেহেতু জানানো হয়েছে যে, আমাদের দেশের করোনাভাইরাসের নতুন ধরন “এন৫০১ওয়াই” শনাক্ত হয়েছে, তার মানে এই ধরনটিই যে যুক্তরাজ্যের শনাক্ত হওয়া ধরন, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। যদি জানুয়ারিতে নমুনা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে, তাহলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সর্বোচ্চ ১০ দিন সময় লাগতে পারে। অর্থাৎ একটা নমুনা নিয়ে সিকোয়েন্সিং করে ফল পেতে ১০ দিন লাগে। এখানে বিষয়টি এমন নয় যে আগে একরকম ফল পাওয়া গেছে, পরে আরেক রকম পাওয়া গেল।’

‘বিষয়টি এমন হতে পারে যে, প্রথমে তারা একটা-দুইটা কেস পেয়েছে। কিন্তু, ভীতি সৃষ্টি করতে চায়নি বলে তা জানায়নি। পরে যখন দেখল, পাঁচ-ছয়টা, তখন জানাল। কিন্তু, কতটি নমুনা মধ্যে তারা পাঁচ-ছয়টি পেল, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিস্থিতি বোঝার জন্যে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি ২০টা নমুনা পরীক্ষা করে পাঁচ-ছয়টাতে নতুন ধরন পাওয়া যায়, তাহলে পরিস্থিতি এক রকম। আবার যদি ১০০টা পরীক্ষা করে পাঁচ-ছয়টা পায়, তাহলে অন্যরকম’, বলেন তিনি।

বাংলাদেশে জিনোম সিকোয়েন্সিং করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জিনোম সিকোয়েন্সিংটা সরকারিভাবে করা হচ্ছে। আমার মনে হয় বেসরকারিভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ যাদের ফ্যাসিলিটি আছে, তাদেরকেও এই কাজ করার জন্যে সরকাররের পক্ষ থেকে তহবিল দেওয়া যেতে পারে। যতে করে শুধু সরকারের ওপর নির্ভর না করে বেসরকারিভাবেও কাজ করা যায়।’

দ্য ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের এই জ্যেষ্ঠ গবেষক বলেন, ‘যুক্তরাজ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ এত বেশি হওয়ার কারণ ছিল এই নতুন ধরন। নানা ধরনের শঙ্কা ছিল। কিন্তু, ভালো খবর হচ্ছে, যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়ার ধরনেও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকাসহ অন্যান্য ভ্যাকসিনগুলো কার্যকর। কিন্তু, এই ভ্যারিয়েন্টের নেতিবাচক দিকগুলো হলো— এটি আগেরটির চেয়ে ৫০-৭০ শতাংশ বেশি দ্রুত ছড়ায়। দ্বিতীয়ত, এটি ৩০ শতাংশ বেশি সিভিয়ার কোভিড তৈরি করতে পারে। কিন্তু, যেহেতু এটি প্রমাণিত যে, ভ্যাকসিন এর ওপর কাজ করে, তাই এটি আমাদের জন্যে আশাব্যঞ্জক খবর। দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টে কিন্তু ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।’

আরটি-পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন ধরন শনাক্তের বিষয়ে এই বিজ্ঞানী বলেন, ‘বাংলাদেশে আরটি-পিসিআরে “টু-জিন” (দুইটি জিন) পরীক্ষা হয়। অর্থাৎ এখানে যে কিট ব্যবহার করা হয়, সেটি দুইটি জিনকে টার্গেট করে পরীক্ষা করে। নতুন ধরন শনাক্ত করতে থ্রি-জিন (তিনটি জিন) পরীক্ষা করতে হবে। এই থ্রি-জিনের একটি জিন “এস-জিন”, যা স্পাইক প্রোটিনকে শনাক্ত করে। থি-জিন পরীক্ষায় দুটি যদি পজিটিভ আসে, আর এস জিন নেগেটিভ আসে, তাহলে সেটাকে ড্রপ আউট বলে। এর অর্থ বোঝায় যে, এই নমুনাটিতে ভাইরাসের পরিবর্তিত ধরন আছে। সেক্ষেত্রে পরে তা নিশ্চিত করার জন্যে জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে হবে। থ্রি-জিন পরীক্ষার কিটটি বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্যে রয়েছে। বাংলাদেশ চাইলেই এটা সংগ্রহ করতে পারবে। অবশ্যই এটা সংগ্রহ করে তা দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। তাতে খরচও খুব বেশি হবে না। বরং কিসোয়েন্সিং করতে খরচ খুব বেশি। তাই যত দ্রুত সম্ভব থ্রি-জিন পরীক্ষার কিট এনে পরীক্ষা করার পরামর্শই দিচ্ছি। কারণ, যুক্তরাজ্যের ধরনটা শনাক্তে থ্রি-জিন পরীক্ষা খুবই কার্যকরি একটি প্রক্রিয়া।’

‘নতুন ধরনকে সহজভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গুরুত্বের সঙ্গে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা আশা করি, এরকম কোনো নতুন ধরন পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত তথ্যসহ তা জানাবে। তাহলে মানুষ সচেতন হতে পারবে এবং পরিস্থিতিও জানা যাবে। যেহেতু তারা বলেছেন, পাঁচ-ছয়টি নমুনায় নতুন ধরন পাওয়া গেছে, তাই এখন অত্যন্ত দ্রুত কন্টাক্ট ট্রেসিং করতে হবে’, যোগ করেন ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম।

আরও পড়ুন:

যুক্তরাজ্যের নতুন স্ট্রেইন বাংলাদেশে শনাক্ত

যুক্তরাজ্যে ‘নতুন’ করোনাভাইরাস শনাক্ত

যুক্তরাজ্যে শনাক্ত করোনার নতুন স্ট্রেইন ‘আরও বেশি প্রাণঘাতী হতে পারে’

করোনার নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হয় না বাংলাদেশের পিসিআর পরীক্ষায়

করোনার নতুন স্ট্রেইন: করছি কী, করণীয় কী

‘বিসিএসআইআর নতুন স্ট্রেইন আবিষ্কার করে বসে আছে! জানাবে না?’

ভারতে করোনার নতুন স্ট্রেইন, বাংলাদেশে সতর্কতা জরুরি

করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ‘কিছুটা কমতে পারে’

Comments

The Daily Star  | English

Govt cancels deal with Summit Group for second FSRU

Summit terms termination of the deal ‘unjustified’, says will appeal for review

1h ago