উন্নয়নের কিছু অংশ চরাঞ্চলের শিশুদেরও দিন!

বাংলাদেশেও তৈরি হবে যুদ্ধবিমান। কিছু দিন আগে এই আশার কথা বলেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশের চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে সেটা হয়ত আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে সম্ভব হবে। সেই যুদ্ধবিমান বাংলাদেশ বিদেশে রপ্তানি করবে না নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে ব্যবহার করবে সেটা নিয়ে হাজারও তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে যেহেতু আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো সামরিক দিক থেকে আমাদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তবে দেশের উন্নয়নের ফল সব নাগরিক সমান ভাবে ভোগ করবেন সেই বিষয়ে কোন তর্ক-বিতর্ক চলে না।
Char children
ছবি: মোস্তফা সবুজ

বাংলাদেশেও তৈরি হবে যুদ্ধবিমান। কিছু দিন আগে এই আশার কথা বলেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশের চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে সেটা হয়ত আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে সম্ভব হবে। সেই যুদ্ধবিমান বাংলাদেশ বিদেশে রপ্তানি করবে না নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে ব্যবহার করবে সেটা নিয়ে হাজারও তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে যেহেতু আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো সামরিক দিক থেকে আমাদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তবে দেশের উন্নয়নের ফল সব নাগরিক সমান ভাবে ভোগ করবেন সেই বিষয়ে কোন তর্ক-বিতর্ক চলে না।

বাংলাদেশে গত বছরের ৮ মার্চ করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। মহামারি ঠেকাতে মার্চের শেষের দিকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এর পরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে অনলাইনে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। অভিভাবকরা তাদের ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অনেকে সারা বছর ছেলে-মেয়েদের পরিয়েছেন কোচিং সেন্টারগুলোতে। অনেকে গৃহশিক্ষক রেখে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এসব যাদের সামর্থ্যের বাইরে বিশেষ করে দেশের উপকূল এবং চরাঞ্চলে যারা বাস করে তাদের বছরটি কেটেছে শিক্ষাহীন ভাবে।

গত ফ্রেব্রুয়ারির শেষের দিকে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনার আটটি চরের বিভিন্ন শ্রেণির ৩০ জন শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম গত এক বছরে তাদের পড়াশোনার কথা। ২০ জন শিক্ষার্থী জানিয়েছে যে তারা কোনো পড়াশোনাই করেনি। এমনকি এই বছরের নতুন বই অনেক খুলেও দেখেনি। একজন শিক্ষার্থী বলেছে যে সে সপ্তাহে পাঁচ দিন উপজেলা শহরে যায় প্রাইভেট পড়তে। তিনজন শিক্ষার্থী জানিয়েছে তারা অন্য একটি চরে বিকেলে প্রাইভেট টিউটরের কাছে যায় এক ঘণ্টার জন্য পড়তে। যদিও গেল বছরের বন্যার মধ্যে চার মাস তারা কোনো পড়াশোনা করতে পারেনি। বন্যার পানিতে অনেকের বই-খাতা নষ্ট হয়ে গেছে। দুইজন শিক্ষার্থী জানিয়েছে তারা শুধু নতুন বইয়ের ছবি দেখেছে। বাকি চারজন জানিয়েছে তারা গত এক বছরে বাড়িতে নিজে নিজে পড়ার চেষ্টা করেছে। এই ৩০ জনের ২৯ জনই বলেছে তারা কোনো অনলাইন ক্লাসের কথা শোনেনি। চরের ছেলে-মেয়েরা সবাই ঘরে বাইরে কৃষিকাজে সাহায্য করেছে এই সময়টা। বাকি সময় খেলাধুলা এবং চরের মধ্যে ঘোরাফেরা করে কেটেছে।

Char children
ছবি: মোস্তফা সবুজ

বাটির চরের সারিয়াকান্দি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রেহেনা আক্তার জানিয়েছে যে সে বাড়িতে একদিনও পড়তে বসেনি। অটো পাশ করে এ বছর সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছে। অভিভাবকরাও পড়ালেখার কোনো চাপ দেয়নি। বাড়িতে তাকে পড়ালেখায় সাহায্য করার মতো কেউ নেই।

বগুড়া ও গাইবান্ধায় চরের মধ্যে আছে ১৮০টি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারের উপরে। এই সব শিক্ষার্থীদেরও একই অবস্থা।

অন্যদিকে, ইসআত জাহান বগুড়া শহরের সরকারি এক ডাক্তার দম্পতির মেয়ে। সে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত বছরের জুলাই থেকে তাদের স্কুলে অনলাইনে ক্লাস চলছে। সে সপ্তাহে পাঁচ দিন তিনটি করে অনলাইন ক্লাস পায় স্কুল থেকে। এর বাইরে বাড়িতে আসেন দুইজন গৃহ শিক্ষক। অনলাইনে টিউশন নেন আরও একজন শিক্ষকের কাছে।

অন্যদিকে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা জানিয়েছেন যে সেখানে বিদ্যুৎ নেই, বাড়িতে গিয়ে পড়ানোর মতো শিক্ষিত মানুষ নেই, টেলিভিশন নেই, স্মার্টফোন দুই একজনের থাকলেও ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। শুধু গান, ভিডিও, ওয়াজ মাহফিলের বক্তব্য শুনতে ও ছবি তুলতে ব্যবহার হয় স্মার্টফোন। তাদের শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা।

অথচ এক বছরে বিষয়টি নিয়ে দেশের সচেতন মহলে কোনো আলোচনা শোনা যায়নি। সরকারি কোনো আলোচনায় সুবিধাবঞ্চিত এই শিক্ষার্থীদের কথা উঠে আসেনি। ডেইলি স্টার ছাড়া চর অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মূল ধারার কোনো গণমাধ্যমকে কোনো প্রতিবেদন প্রচার করতে দেখা যায়নি।

বগুড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক-দুই মাসের একটি সংক্ষিপ্ত কোর্স করার পরিকল্পনা আছে। এটা সব শিক্ষার্থীর জন্য প্রযোজ্য হবে। চরের শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা কোনো পরিকল্পনা নেই।

আমাদের দেশের চর এবং উপকূলীয় এলাকায় হতদরিদ্র শ্রেণির মানুষের বসবাস। ভূমিহীন-শিক্ষাহীন কৃষক ও জেলেদের বেশি বসবাস এসব এলাকায়। তারা আমাদের খাবার যোগান দেন। নদী এবং সাগর থেকে আমাদের জন্য সুস্বাদু মাছের যোগান দেন। সব রকমের শাক-সবজি, ধান, গম, ভুট্টা চাষ হয় চর এলাকায়। কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বগুড়ার মাত্র তিনটি উপজেলার চর থেকে দেশের ৫ শতাংশ মরিচ যোগান দেওয়া হয়। গাইবান্ধা জেলার ৩০ শতাংশ মানুষ বসবাস করেন তিস্তা-যমুনা, ব্রহ্মপুত্রের পেটে। এই জেলার চর থেকে সারাদেশে যাচ্ছে মিষ্টি কুমড়া। দেশে যে ডাল চাষ হয় তার ৬০ শতাংশ আসে নদীর চরাঞ্চল থেকে। বাংলাদেশের কৃষিতে এইসব চরবাসীর অবদান অনেক বেশি।

চরের অনুন্নত জীবন-মান, নিয়মিত বন্যা-খরা, বিশুদ্ধ পানির অভাব, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, চিকিত্সাহীনতার পরও কৃষকরা ফসল ফলান। এই সব খেটে খাওয়া মানুষ স্বপ্ন দেখেন তাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন।

২০১৯ সালে বন্যার সময় বগুড়া ও গাইবান্ধায় চার শতাধিক প্রাথমিক স্কুল দুই মাস বন্ধ রাখা হয়েছিল। গত তিন বছর এই দুই জেলার চরগুলো ঘুরে দেখা গেছে এসব স্কুলের শিক্ষার মান তেমন ভালো নয়। ঝরে পড়া শিশুদের সংখ্যাই বেশি। মেয়েদের বাল্য বিয়ে নৈমিত্তিক ঘটনা। দুর্গম এলাকা এবং সময়মত নৌকা না পাওয়ার অজুহাতে অনেক স্কুলের শিক্ষকদের দুই ঘণ্টা দেরিতে স্কুলে যেতে দেখা যায়। স্কুল ছুটির দুই ঘণ্টা আগেই তারা স্কুল ছাড়েন। উপজেলা শিক্ষা অফিসার- ইউএনও, জেলা শিক্ষা অফিসার এসব তথ্য জানেন কোনো ব্যবস্থা নেন না।

যেসব শিক্ষক চর এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তারা কেউ চরে বসবাস করতে চান না। আমার দেখা ১০০ জন প্রাথমিকের শিক্ষকের একজন চরে বাস করেন। নিজেদের ছেলে-মেয়েদের ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর জন্য তারা শহরে থাকেন। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাওয়া শুরু করতেই অনেককে শহরে গিয়ে বসবাস করতে দেখা যায়। অর্থাৎ চরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান নিয়ে খোদ শিক্ষকরাই সন্দিহান। শিক্ষকদের অভিযোগ, চরে থাকার মতো নিরাপত্তা নেই।

সরকার চাইলে যে চরাঞ্চল বাসযোগ্য করতে পারে সেটা তো ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন সুবিধা দেখলেই বোঝা যায়। মাত্র দুই বছরে ভাসান চরে ১ লক্ষ রোহিঙ্গাদের জন্য ক্লাস্টার হাউজ, সাইক্লোন সেন্টার, শৌচাগার, খাদ্য গুদাম, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, অস্থায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থানের মত এত সব সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।

ভাসান চরে এসব করা হয়েছে শুধুমাত্র রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার জন্য। তাহলে বাংলাদেশের নদীর চরাঞ্চলে যেসব মানুষ বসবাস করে তাদের নাগরিক সুবিধা দেওয়ার দায়িত্ব কি রাষ্ট্রের ওপর বর্তায় না?

দেশে গত ১০ বছর ধরে যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে তা দেশ এবং বিদেশেও ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে কিন্তু প্রান্তিক মানুষের উন্নয়ন হয়েছে কতটুকু। চরাঞ্চলের যে কৃষকরা আমাদের জন্য খাদ্যের যোগান দিচ্ছেন তাদের উন্নয়ন হয়েছে কতটুকু? তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য সরকার কী করছে?

এটা সত্য যে সরকার কিছু কিছু চরে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল এবং অনেক ধীর গতিতে হচ্ছে সেই কাজ। কোন চরে বিদ্যুৎ যাবে সেটাও নির্ভর করে ওই এলাকার সংসদ সদস্যের উপর।

মহামারিতে এক বছর শিক্ষাহীন অবস্থায় কেটেছে চরের শিক্ষার্থীদের। সরকার এই শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারেনি। সরকারকেই ঠিক করতে হবে ভবিষ্যতের মহামারিতে এসব এলাকার শিশুদের কিভাবে পাঠদান করা হবে। এর দায়িত্ব একমাত্র সরকারের উপর বর্তায়।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের প্রাথমিক এবং কারিগরি শিক্ষার মান উন্নয়নে ২০০ মিলিয়ন ইউরো সহায়তা দিচ্ছে। গত বছরের মে মাসে ৪৬ দশমিক ১২৫ মিলিন ইউরো বাংলাদেশকে দিয়েছে তারা। এই টাকা দিয়েও সরকার চরাঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন করতে পারে।

মোস্তফা সবুজ: সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Section 144 imposed in Khagrachhari Sadar, Rangamati municipality

Attacks on indigenous communities in Rangamati follow yesterday's violence in Khagrachhari

28m ago