প্রবাসে

অনিন্দ্য সুন্দর পর্বতমালা মাতরা

শীতে ইউরোপে যারা ঘুরতে ভালবাসেন, দলবেঁধে তুষারে ঢাকা পথে আকাঁবাকাঁ পাহাড়ি পথে আনন্দে ছুটে বেড়াতে যাদের ইচ্ছে করে অথবা তুষার ধবল এলাকায় যারা তুষারপাতে আইস স্কেটিং, ট্রেকিং কিংবা স্কিইং করতে চান, এমন মানুষদের পছন্দের তালিকায় থাকবে ‘মাতরা’।
মাতরা ওয়াচ টাওয়ার থেকে ছবি তুলেছেন অমিত চন্দ্র দাশ

শীতে ইউরোপে যারা ঘুরতে ভালবাসেন, দলবেঁধে তুষারে ঢাকা পথে আকাঁবাকাঁ পাহাড়ি পথে আনন্দে ছুটে বেড়াতে যাদের ইচ্ছে করে অথবা তুষার ধবল এলাকায় যারা তুষারপাতে আইস স্কেটিং, ট্রেকিং কিংবা স্কিইং করতে চান, এমন মানুষদের পছন্দের তালিকায় থাকবে ‘মাতরা’।

হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট থেকে প্রায় শত কিলোমিটার দূরে মাতরা উত্তর হাঙ্গেরির একটি পর্বতশ্রেণী। ‘মাতরা’ শীতকালে যেন এক মন্ত্রময় স্থান। মাতরায় বেড়াতে যাওয়া মানে মন্ত্রমুগ্ধ কিশোরদলের যাত্রাভিযানে অনন্য সংযোজন। শীতের মায়াময় তুষারপাতে মাতরা পাহাড়ি পথ ধরে চলা এক অনন্য অনুভূতি। পাইন গাছের ডালে ডালে প্রকৃতি যেন শ্বেতশুভ্র রূপের ডালি বসিয়েছে। 

ছবি: এলটন চাকমা

মাতরা (Mátra) উত্তর হাঙ্গেরিয়ান পর্বতমালার অংশ। এটি গিয়োঙ্গগিস  এবং এগার শহরগুলির মধ্যে অবস্থিত। দেশের সর্বোচ্চ শিখর কেকেস্টো এই পর্বতমালার অন্তর্গত। শিখরটির উচ্চতা ১০১৪ মিটার। একই সাথে এটি ইউরোপের বৃহত্তম সক্রিয় আগ্নেয়গিরি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এটি তর্না নদীর উপত্যকা এবং জাগিভা নদীর মাঝখানে অবস্থিত। মাতরাকে সহজেই আলাদা ভাগে ভাগ করা যায়।

পশ্চিমে মাতরার সর্বোচ্চ পয়েন্ট হলো মুজসলা যার উচ্চতা ৮০৫ মিটার। মধ্যভাগের মাতরা গঠিত হয়েছে মাতরা রিজ মালভূমি এবং গালিয়া-তেটের সমন্বয়ে। খাড়া, ঢালু মাতরার পথে একে অপরের সাথে বিকল্পভাবে ঘন বনাঞ্চলে আবৃত। কোমল ঢালু এবং সমান্তরাল উপত্যকা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে। মাতরার মধ্যে রয়েছে বৃহত্তম নাগি ভেলি, যাকে গ্রেট উপত্যকা নামে সবাই চিনে। মাতরাফ্রেড থেকে মাতরাহাজা পর্যন্ত এলাকা হচ্ছে মাতরার 'প্রধান প্রবেশদ্বার'। একে নাগি পাতক উপত্যকা বলা হয়। মাতরার পাদদেশে বেশিরভাগ চাষাবাদযোগ্য জমি রয়েছে।

মাতরায় কী কী দেখা যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর ভ্রমণকারী হিসেবে দিতে গেলে আপনাকে কয়েক বিষয়ে নজর দেবার জন্য অনুরোধ করব। সাথে কিছু প্রশ্ন করে রাখতে চাই। আপনি কি হলিউডের এনিমেশন সিনেমার পাগল? আইস এইজ সিরিজের সিনেমাগুলোর বাস্তব এলাকার দৃশ্য কেমন হতে পারে? অথবা, শীতে দুর্গম পর্বতের কী কী চিত্র আপনার মনে ভেসে আসে? আসুন এই প্রশ্নের উত্তরগুলো দেবার চেষ্টা করি। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আপনি যদি মাতরা ভ্রমণে যান, তবে আপনার কাছে মনে হবে আপনি হলিউডের এনিমেশন সিনেমার শ্যুটিং স্পটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

ছবি: অমিত চন্দ্র দাশ

হলিউডের সিনেমায় যেমন আমরা দেখি রাজকন্যাকে উদ্ধারে রাজপুত্রের দুঃসাহসিক সব অভিযান, তেমনি আপনার মনে হবে মাতরার বন্ধুর পথে রাজকন্যাকে খুঁজে পাবার মিশন নিয়ে রাজপুত্র আপনার আশে পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে কল্পনার রাজ্য। বরফে তৈরি সেই রাজ্যের প্রতিটি ঘর, জানালা, বাড়ির আঙ্গিনা শুভ্র সাদা দেখতে দেখতে আপনার মনটি আনন্দে ভরে উঠবে। হঠাৎ করে যদি সূর্যের আলো আপনার উপর বর্ষিত হয়, আপনি ভেবে নেবেন স্রষ্টা শ্যুটিং স্পটের জন্য বিশাল মশাল বাতির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আপনি অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখবেন মুগ্ধকর পরমেশ্বরের সৃজন লীলা।

বাসে করে মাতরায় প্রবেশ করে প্রথমে ওয়াচ টাওয়ারে চলে যেতে পারেন। টাওয়ারের চূড়ায় উঠে চারপাশ ভাল মতো পর্যবেক্ষণ করলে মাতরার মাত্রাহীন সৌন্দর্য্যের অংশবিশেষ উপলব্ধি করতে পারবেন। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে যত পশ্চিম দিকে যাবেন, ততই বিস্মিত হবেন। বনের গভীরে প্রতিটি ছোট বড় গাছে কান্ড, শাখা-প্রশাখা শ্বেত-শুভ্র তুষারে ঢেকে আছে। তুষারপাত স্তুপাকারে চারপাশে ছড়িয়ে থাকলেও মানুষকে খুব সহজে আক্রান্ত করছে না। টানা কয়েক ঘণ্টা তুষারের ওপর হাঁটার পরেই ঠান্ডা কী জিনিস সেটি অনুভূত হয়। তবে ভয় পাবার কিছু নেই!

মাতরা বনাঞ্চলের আকাশচুম্বী পাইন গাছের সারিতে চোখ রেখে আপনি ঠিক করে নিতে পারেন আপনার পায়ে হাটার সম্ভাব্য গন্তব্যস্থল। ওয়াচ টাওয়ার থেকে মাটিতে নেমে দেখতে পাবেন মাতরার পথে পথে পাইন গাছের বিশাল আয়োজন। গ্রীষ্মে পাইন গাছ শত শত ক্লান্ত পথিকের আশ্রয় হিসেবে দেখা দেয়। শীতে পাইন গাছসমূহ নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের পাতায় পাতায় জমে থাকা তুষারপাত আলোর সংস্পর্শে এসে জ্বলজ্বল করে উঠে।

হাঙ্গেরিতে অধ্যায়নরত লেখকসহ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। ছবি: কাজী নুহাস মিশকাত

রাজধানী বুদাপেস্টের কয়েকটি এলাকা ছেড়ে মাতরা যাবার রেলগাড়ি এবং বাস পাওয়া যায়। কেলেটি, নওগাতি থেকে প্রতি দুই ঘণ্টা পর পর রেলগাড়ি গিয়োঙ্গগিসের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। রেলগাড়িতে গিয়োঙ্গগিস যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা পঁচিশ মিনিট। শিক্ষার্থীদের জন্য ভাড়া লাগবে হাঙ্গেরি মুদ্রায় ৮৩৬ ফরিন্ট। রেলগাড়ি থেকে নেমে বাসে করে গিয়োঙ্গগিস যেতে সময় লাগলে প্রায় ৫৫ মিনিট। ভাড়া খুবই কম। একদম হাতের নাগালের মধ্যে। কেউ যদি বাসে করে সরাসরি বুদাপেস্ট থেকে মাতরা পাহাড়ি এলাকায় যেতে চান, সে ক্ষেত্রে পুস্কাস মেট্রো স্টেশন থেকে প্রতি একঘণ্টা পর পর বাস পাওয়া যায়। শিক্ষার্থী পরিচয়ে হাঙ্গেরি মুদ্রায় ১১০০ ফরিন্টে টিকেট পাওয়া যায়।

রাত্রিযাপন করার জন্য মাতরাতে বেশি কিছু হোটেল রয়েছে। তবে সেই সব হোটেলে রাত্রিযাপনের জন্য আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। মাতরা থেকে একটু দূরে গিয়োঙ্গগিস শহরেও আরও কিছু হোটেল আছে। আপনার সময় এবং যাত্রার তারিখ অনুযায়ী বুকিং দিয়ে রাখতে পারেন।  কোন সময়ে কোন ট্রেন বা বাস ধরবেন এই বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রাখবেন। সময়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে পকেট থেকে অতিরিক্ত অর্থ বের হয়ে যাবে। বাস বা রেলগাড়ি নির্দিষ্ট এলাকা থেকে নির্দিষ্ট সময়ে ছেড়ে যায়। অনুসন্ধান করলে আপনার স্মার্টফোনেই সব জানতে পারবেন। এই বিষয়ে খেয়াল না করলে ভ্রমণের স্বাভাবিক আনন্দ উৎযাপন থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। আর ভ্রমণের সময় শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে যথার্থ গরম কাপড় সঙ্গে নিতে হবে। সেই সাথে খাওয়ার পানির বোতল এবং শুকনো খাবার রাখা যেতে পারে এবং অবশ্যই রেলগাড়ি বা বাসের টিকেট কাটতে আপনার পরিচিতিমূলক কাগজপত্রের কপি রাখতে ভুল করবেন না।

লেখক: শিক্ষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা। পিএইচডি গবেষক, কর্ভিনাস ইউনিভার্সিটি অব বুদাপেস্ট, হাঙ্গেরি।

Comments

The Daily Star  | English

Houses for homeless: A project destined to fall into ruin

At least a dozen homes built for the homeless and landless on a river island in Bogura’s Sariakandi upazila have been devoured by the Jamuna while dozens of others are under threat of being lost.

5h ago