বিভ্রান্তি নয়, নির্দ্বিধায় ভ্যাকসিন নিতে হবে
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন নেওয়ার পর ‘দেহে রক্ত জমাট বাঁধা’র খবরে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে এক ডজনেরও বেশি দেশ ভ্যাকসিন কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। তবে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন নেওয়ার সঙ্গে ‘দেহে রক্ত জমাট বাঁধা’র কোনো যোগসূত্র নেই বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
এই বিভ্রান্তির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের করণীয় কী? দেশে ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ১২ ধরনের স্ট্রেইন পাওয়া গেছে। কিন্তু, প্রচলিত টু-জিন আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় সেগুলো শনাক্ত হয় না। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন থ্রি-জিন আরটি-পিসিআর পরীক্ষা। চলমান প্রেক্ষাপটে থ্রি-জিন পরীক্ষা চালু কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ; প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম; রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন; ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে কর্মরত বাংলাদেশি চিকিৎসক ডা. গোলাম রাহাত খান ও বায়ো মেডিকেল সাইন্স গবেষক ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. খোন্দকার মেহেদী আকরামের সঙ্গে।
অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘যে দেশগুলো ভ্যাকসিন কার্যক্রম স্থগিত করেছে, তারা পূর্ব সতর্কতার অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডব্লিউএইচও যা বলেছে, সেটা তারা তথ্য ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গবেষণা বিশ্লেষণ করে বলেছে। যে দেশগুলো স্থগিত করেছে, তারা তাদের দেশের অবস্থা, সক্ষমতা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু, ডব্লিউএইচও সিদ্ধান্ত দেয় সারাবিশ্বের পরিস্থিতি বিবেচনায়। ফলে সেটি সবার জন্যে প্রযোজ্য। আমাদের উচিত ডব্লিউএইচওর মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া। তাদের মতামতের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হবে।’
দেশে যাদেরকে ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে, তাদের ওপর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে জনগণকে জানানো দরকার ছিল বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা ধাপে ধাপে করা যেত। যেমন: প্রথম দিকে যাদের দেওয়া হয়েছে, ১৪ দিন পর তাদের ওপর কার্যকারিতা, ২৮ দিন পর, আবার দুই মাস পর কার্যকারিতা। এই তথ্যটা পেলে মানুষ মোটিভেটেড হতো। এই তথ্যের মাধ্যমে সরকারেরও কাজ করতে সুবিধা হতো। এখন সেটা নাকি শুরু হয়েছে। সেটা করা দরকার।’
আমাদের দেশে আরও আগে থেকেই থ্রি-জিন আরটি-পিসিআর পরীক্ষা চালু করা দরকার ছিল বলে মনে করেন অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘একজন বাংলাদেশি-ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আমাকে বলেছেন, যে প্রাইমারগুলো দিয়ে আমরা আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করছি, সেগুলো অনেক পুরনো। চীন থেকে কম দামে এগুলো কেনা হয়েছে। কিন্তু, বৈজ্ঞানিক দিক দেখা হয়নি। এখন যত দ্রুত সম্ভব এটা পরিবর্তন করা দরকার। যাতে যেকোনো ধরনই আমরা শনাক্ত করতে পারি।’
‘যে ভ্যাকসিনটা আমাদের দেশে দেওয়া হচ্ছে, নির্দ্বিধায় সেটা নেওয়া যায়। নিজের জীবন বাঁচানোর জন্যে, পরিবারে সংক্রমণ কমানোর জন্যে ও নাগরিক হিসেবে দেশকে রক্ষা করার জন্যে আমাদের ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধিও মানতে হবে’, যোগ করেন তিনি।
ভ্যাকসিন নিয়ে অযথা এক ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘কয়েকজনের দেহে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা পাওয়া গেছে। কিন্তু, ডব্লিউএইচও বলেছে, ভ্যাকসিনের সঙ্গে সেটার কোনো সম্পর্ক নেই। অ্যাস্ট্রাজেনেকাও গবেষণা করে দেখেছে যে, ভ্যাকসিন নেওয়ার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ভ্যাকসিন আসার শুরুর দিকে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছিল। মানুষ দ্বিধায় ছিল। সেটি কাটিয়ে এখন ভ্যাকসিন নেওয়া শুরু করেছে। এখন আবার বিভ্রান্তি ছড়িয়ে মানুষের মাঝে ভয় সৃষ্টি করা হচ্ছে। সেই ভয়ে নিবন্ধন কমেছে, টিকা নেওয়ার সংখ্যা কমেছে।’
‘কিন্তু, যেহেতু ডব্লিউএইচও ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা বলেছে, তাই ভয়ের কোনো কারণ নেই। যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে, টিকা না নিয়ে তা কমানো সম্ভব না। তবে, টিকা নিলে করোনা হবে না, সেটা ভাবলে হবে না। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। আর এখন ভ্যাকসিন নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, তার পেছনে আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন রাজনীতি থাকতে পারে বলেও মনে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘যাদের ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে, তাদের অবস্থা পরীক্ষা করতে পারলে ভালো। কিন্তু, করতেই হবে, তা নয়। তারচেয়ে ভ্যাকসিন আনার দিকে আরও মনোনিবেশ করতে হবে। যাতে আরও ভ্যাকসিন আনা যায় এবং আরও মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া যায়। পাশাপাশি কোনো ধরনের বিভ্রান্তিতে মনোযোগ না দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।’
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সব সময়ই আমরা ডব্লিউএইচওর ওপর নির্ভর করি। তবে, আমাদের এখানে যাদেরকে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, তাদের খোঁজ-খবর রাখতে হবে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কারো “রক্ত জমাট বাঁধা”র কোনো সংবাদ আমরা পাইনি। বিভ্রান্তি তৈরির পর কিছু দেশ টিকাদান স্থগিত করেছে, সেটা যেমন সত্যি, তেমনি অনেক দেশ তো কার্যক্রম চালিয়েও যাচ্ছে। বরং কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া দেশের সংখ্যাই বেশি। একইসঙ্গে ভ্যাকসিন দেওয়া স্থগিত করার সিদ্ধান্তে ডব্লিউএইচও-ও সমর্থন দিচ্ছে না।’
‘আমাদের এখানে এখন পর্যন্ত যাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে, তাদের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে সেই তথ্য জনগণকে দেওয়া অত্যাবশ্যকীয় কাজ। এতে মানুষের মধ্যে দ্বিধা দূর হবে, আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তাদের অ্যান্টিবডি অ্যাসেসমেন্টের কাজ আমাদের এখানেও শুরু হয়েছে। আসলে আমাদের এখানে সবকিছুই তো একটু ধীরে ধীরে হয়, এটাও ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে। কিন্তু, এটা অবশ্যই করতে হবে।’
নির্দ্বিধায় ভ্যাকসিন নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রক্ত জমাট বাঁধার খবর নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকার প্রয়োজন নেই। নির্দ্বিধায় ভ্যাকসিন নিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে নজর রাখা হচ্ছে। যদি কোনো ধরনের সামান্য আভাসও পাওয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে তা জানিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু, মানুষ যেভাবে ভ্যাকসিন নিচ্ছিল, সেভাবেই নিতে হবে। কিছু হলে সরকারই তা বলবে। এখনো সেরকম কোনো পরিস্থিতির উদ্ভাবন হয়নি।’
অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘আমরা ডব্লিউএইচওকে অনুসরণ করি। আর শুধু ডব্লিউএইচও নয়, ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সিও বলেছে, টিকার নেওয়ার সঙ্গে দেহে রক্ত জমাট বাঁধার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সেটা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেও পাওয়া যায়নি। আর এখন তো কোটিরও বেশি মানুষ টিকা নিয়েছেন। টিকা নেওয়ার পর যাদের শরীরে রক্ত জমাট বেঁধেছে, আর টিকা নেওয়ার আগে কতজনের দেহে রক্ত জমাট বেঁধেছে, সেই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই দুইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবধান নেই। কাজেই এটা কোনো প্রমাণিত বিষয় নয়। যেহেতু এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, তাই কিছু দেশ সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। কিন্তু, কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।’
‘আমরা নির্ভয়ে ভ্যাকসিন নিতে পারি। আমাদের এখানে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে সেই অর্থে কারো সমস্যা এখনো দেখা যায়নি। কাজেই আমাদের কার্যক্রম যেভাবে চলছে, তা চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের এখানে এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন নেওয়ার পর চার জনের শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। যা সেরেও গেছে। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে আমাদের এখানেও পরীক্ষা চলছে’, যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশি-ব্রিটিশ চিকিৎসক ডা. গোলাম রাহাত খান বলেন, ‘দেহে রক্ত জমাট বাঁধার যে কথা বলা হচ্ছে, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। রক্তে জমাট বাঁধা রোগের খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মানুষের হঠাৎ বুকে ব্যথা বা স্ট্রোক, এগুলোর মূলে কিন্তু রক্ত জমাট বাঁধা রয়েছে। মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে, রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতাও তত বাড়ে। ভ্যাকসিন নেওয়ার সঙ্গে রক্ত জমাট বাঁধার সংশ্লিষ্টতার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। যদি করোনা নাও থাকত, তাও রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটতই। ইংল্যান্ডের সাত কোটি মানুষের মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ৬৫ জন ব্লাড ক্লটের শিকার হয়।’
‘অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকাও কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলছে যে, রক্ত জমাট বাঁধার সঙ্গে ভ্যাকসিন নেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। ব্রিটিশদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার জন্যে এসব ঝামেলা হচ্ছে কি না, তা দেখার বিষয়। ইংল্যান্ডে প্রায় দুই কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে এক কোটি ৭০ লাখকেই অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। গত দুই মাসে ভ্যাকসিন দেওয়ায় এখানে কিন্তু সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অনেক কমেছে। বাংলাদেশেরও এই জিনিসটি দেখতে হবে যে, ভ্যাকসিন দিলে কী সুবিধা পাওয়া যায়।’
‘বাংলাদেশে যে থ্রি-জিন আরটি-পিসিআর পরীক্ষা চালু হওয়া দরকার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যাতে আমরা নতুন স্ট্রেইনগুলো সম্পর্কে জানতে পারি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত যত দ্রুত সম্ভব এই উদ্যোগ নেওয়া।’
সবশেষে তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞান কোনো গল্পগাথা নয়। বিজ্ঞান হচ্ছে প্রমাণ। অনেক বছর ধরে ভ্যাকসিন দাপটের সঙ্গে পৃথিবী থেকে বিভিন্ন রোগ দূর করছে। তাহলে এখন কেন নেওয়া যাবে না? আমার আহ্বান থাকবে, কোনো ধরনের কুসংস্কারে কান না দিয়ে ভ্যাকসিন নেওয়া ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।’
ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলেন, ‘ভ্যাকসিন দেওয়ার পর কয়েকটি দেশে কিছু সংখ্যক মানুষের শরীরে ব্লাড ক্লট বা রক্ত জমাট বাঁধাজনিত জটিলতা দেখা দিয়েছে। এই রক্ত জমাট বাঁধার সঙ্গে ভ্যাকসিনের আসলেই কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা দেখার জন্যেই মূলত কিছু দেশে ভ্যাকসিন দেওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। অনুমোদনের আগে যখন অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করা হয়েছে, তখন কারও শরীরে ভ্যাকসিনের কারণে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটেনি। ব্রিটেন ও ইউরোপের স্বাস্থ্য রেগুলেটর এই ঘটনাগুলো নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখে বলেছে, ভ্যাকসিন দেওয়ার পর যে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটেছে, তা নিতান্তই কাকতালীয়। এর সঙ্গে ভ্যাকসিনের কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও একই অভিমত।’
রক্ত জমাট বাঁধাজনিত রোগগুলো আর দশটা সাধারণ রোগের মতোই বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর গোটা বিশ্বে গড়ে রক্ত জমাট বাঁধাজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হয় প্রতি এক হাজারে একজন। ৮০ বা এর বেশি বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি প্রতি এক হাজারে সাত জন। ভ্যাকসিন দেওয়ায় এই সংখ্যা যদি না বাড়ে, তাহলে রক্ত জমাট বাঁধার সঙ্গে ভ্যাকসিনের সম্পর্ক রয়েছে বলা যাবে না। সেই হিসেবে, ইউরোপে ভ্যাকসিন ছাড়া এমনিতেই ৫০ লাখ মানুষের ভেতরে এক মাসে রক্ত জমাট বাঁধাজনিত সমস্যা দেখা দেওয়ার কথা ৪১৬ জনের এবং ৮০ বা এর বেশি বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি হবে প্রায় তিন হাজার। এখন ইউরোপে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন নেওয়া ৫০ লাখ মানুষের ভেতর রক্ত জমাট বাঁধাজনিত সমস্যা হয়েছে ৩০ জনের। সুতরাং ভ্যাকসিন দেওয়ার পর যে ৩০টি রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে ভ্যাকসিনের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এই রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনাগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটতো।’
দ্য ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের এই জ্যেষ্ঠ গবেষক বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৬ লাখ মানুষকে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এই ভ্যাকসিনে যদি রক্ত জমাট বাঁধতোই, তাহলে তো এই দেড় মাসে রক্ত জমাট বাঁধা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতো কমপক্ষে পাঁচ শ জন। ভারতে দুই কোটি মানুষকে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। কয়জন মানুষ রক্ত জমাট বাঁধা সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে? ভারতীয় রেগুলেটরের তথ্য অনুযায়ী, এখনো কোভিশিল্ডের কারণে সেখানে রক্ত জমাট বাঁধার কোনো ঘটনা ঘটেনি।’
‘তবে, ভ্যাকসিন নেওয়ার পর যদি কোনো মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হয় বা কারও মৃত্যু হয়, তাহলে তা যথাযথভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে এর সঙ্গে ভ্যাকসিনের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি না। আর এ কারণেই অনেক সময় ভ্যাকসিন কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত রাখা হয়। এটা সম্পূর্ণই নিরাপত্তা ও সাবধানতার জন্যে। তাই বাংলাদেশে যারা ভ্যাকসিন নিতে ভয় পাচ্ছে বা দ্বিধায় রয়েছে, তাদেরকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিগুলো বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আন্তর্জাতিক ড্রাগ রেগুলেটর যা বলে তা বিশ্বাস করতে হবে। কারণ তারা যে পরামর্শগুলো দেয়, বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা করেই সেগুলো দিয়ে থাকে। আর এসব ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে প্রাধান্য পায়।’
আরটি-পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন ধরন শনাক্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আরটি-পিসিআরে “টু-জিন” পরীক্ষা হয়। নতুন ধরন শনাক্ত করতে থ্রি-জিন পরীক্ষা করতে হবে। এই থ্রি-জিনের একটি জিন “এস-জিন”, যা স্পাইক প্রোটিনকে শনাক্ত করে। থ্রি-জিন পরীক্ষায় দুটি যদি পজিটিভ আসে, আর এস জিন নেগেটিভ আসে, তাহলে সেটাকে ড্রপ আউট বলে। এর অর্থ বোঝায় যে, এই নমুনাটিতে ভাইরাসের পরিবর্তিত ধরন আছে। সেক্ষেত্রে পরে তা নিশ্চিত করার জন্যে জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে হবে। বাংলাদেশ চাইলেই থ্রি-জিন পরীক্ষার কিট সংগ্রহ করতে পারবে। অবশ্যই এটা সংগ্রহ করে তা দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। তাতে খরচও খুব বেশি হবে না। বরং সিকোয়েন্সিং করতে খরচ খুব বেশি। তাই যত দ্রুত সম্ভব থ্রি-জিন পরীক্ষার কিট এনে পরীক্ষা করার পরামর্শই দিচ্ছি।’
আরও পড়ুন:
অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কারণে রক্ত জমাট বাঁধা এবং আমাদের যত ভ্রান্তি!
অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন কতটা সুরক্ষা নিশ্চিত করে?
ভ্যাকসিন নিলেও করোনায় আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে?
ভারতে করোনার নতুন স্ট্রেইন, বাংলাদেশে সতর্কতা জরুরি
৪ সপ্তাহের পার্থক্যে দ্বিতীয় ডোজে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৫৩ শতাংশ, ১২ সপ্তাহে ৮৩ শতাংশ
ভ্যাকসিন নেওয়া এবং না নেওয়া, মানুষ চিহ্নিত হবে দুই দলে
করোনার নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হয় না বাংলাদেশের পিসিআর পরীক্ষায়
মত-দ্বিমত ‘করোনাভাইরাসে দ্বিতীয়বার আক্রান্তের সম্ভাবনা নেই?’
ভ্যাকসিন নিয়ে দ্বিধা ও বিতর্ক কেন?
ভ্যাকসিন কবে পাব এবং অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের ‘ভুল ডোজ’র আশাবাদ
যুক্তরাজ্যের স্ট্রেইন দেশে শনাক্ত: ‘দেরিতে জানিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছি’\
করোনার নতুন স্ট্রেইন: করছি কী, করণীয় কী
করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ‘কিছুটা কমতে পারে’
Comments