করোনার মধ্যেই বিসিএস দেবেন পৌনে ৫ লাখ প্রার্থী
করোনা সংক্রমণের মধ্যেই ৪১তম বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আগামী ১৯ মার্চ অনুষ্ঠেয় এই পরীক্ষায় প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ প্রার্থী অংশ নেবেন।
দেশে করোনার সংক্রমণের হার যখন ঊর্ধ্বমুখী তখন বিসিএস পরীক্ষা হলে আক্রান্তের হার বাড়তে পারে এমন আশঙ্কা করে পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অনেক প্রার্থী। একদল পরীক্ষা স্থগিত চেয়ে আদালতে রিটও করেছিলেন। তবে, হাইকোর্ট সেই রিট খারিজ করে দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা আয়োজন করতে পিএসসিকে নির্দেশ দিয়েছেন।
সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) বলছে, পরীক্ষা পেছানোর কোনো ভাবনা তাদের ছিল না। এখনো নেই। তবে, পরীক্ষা দিতে এসে করোনার সংক্রমণ যেন না বাড়ে সেজন্য কঠোর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এজন্য তারা ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছে যেগুলো মানতেই হবে।
তবে, জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়াটাই এখন চ্যালেঞ্জ। পিএসসি ও পরীক্ষার্থীসহ সবাইকেই এখন সেই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
২০১৯ সালের শেষে ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। গত বছরের এপ্রিলে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে সেটি স্থগিত করা হয়। প্রকোপ কিছুটা কমে আসার পর এই বছরের ১৩ জানুয়ারি ৪১তম বিসিএসের তারিখ ঘোষণা করে পিএসসি।
এর কয়েকদিন পর ২২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছিলেন, ঈদুল ফিতরের পর ২৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হবে এবং আবাসিক হলগুলো ১৭ মে থেকে খুলে দেওয়া হবে। এই তারিখের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিসিএস পরীক্ষার আবেদন ও পরীক্ষার তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হবে। এরপর ৪৩তম বিসিএসের আবেদন ও পরীক্ষা নেওয়ার সময় পিছিয়ে দেওয়া হয়। তবে ৩ মার্চ পিএসসির সভায় ৪১তম বিসিএস ১৯ মার্চই বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু, করোনার মধ্যে পরীক্ষা না নেওয়ার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ৪১তম বিসিএসের পরীক্ষার্থীদের একটি অংশ গতকাল সোমবার মানববন্ধন করেছেন৷ তাদের দাবি, করোনার প্রকোপ কমলে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের হল খোলার সঙ্গে সমন্বয় করে ৪১তম বিসিএস পরীক্ষার তারিখ পুনঃনির্ধারণ করতে হবে৷
এর আগে ৮ মার্চ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনেও আন্দোলনকারীরা পরীক্ষা পেছানোর দাবি তুলেছিলেন। শিক্ষার্থীদের দাবি, ‘করোনা যেন না ছাড়ায় সে কারণেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক হলগুলোও বন্ধ৷ এখন পৌনে পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নিলে করোনার প্রকোপ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’
গত দুই দিনে অন্তত হাজার তিনেক প্রার্থী দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন। এর মধ্যে অনেকেই বলছেন, অনেকদিন ধরে এই পরীক্ষা ঝুলে আছে। কাজেই পরীক্ষা হয়ে যাক। আরেকদল করোনার মধ্যে পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করেছেন।
রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক মাহফুজ আহমেদ গতকাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পিএসসি যখন পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছিল, তখন করোনার সংক্রমণ খুবই কম ছিল। এখন সংক্রমণ বাড়ছে। কাজেই এখন পরীক্ষা নেওয়া উচিত নয়।’
নাজমুস সাকিব নামে এক প্রার্থী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় স্বাভাবিকভাবেই বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়ে তাদের আত্মীয়-স্বজনের বাসা, শহরের বিভিন্ন মেস, হোটেলে অবস্থান নেবে। বাস-ট্রেনে চড়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাবে। এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেওয়া মানে লাখো ছেলেমেয়েকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলা।’
এনামুল হক নামে আরেক প্রার্থী বলেন, ‘পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকবে সারাদেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, স্কুল কলেজের শিক্ষক, অফিস সহকারী, পিএসসিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, অভিভাবক। সবমিলিয়ে দুই ঘণ্টার পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে অন্তত ১০ লাখ মানুষ বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যাবেন।’
তবে, পরীক্ষার্থীদের অনেকেই চাইছেন, ১৯ মার্চই পরীক্ষা হয়ে যাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক মুবিনুল হক বলেছেন, ‘করোনার মধ্যে মিছিল-মিটিং, অফিস-আদালত সবকিছু চলতে পারলে পরীক্ষা নিতে সমস্যা কোথায়?’
ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক শাহরিয়ার আহমেদ বলেন, ‘করোনার কারণে বড় বড় সব ধরনের নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ। বয়স চলে যাচ্ছে। কাজেই আমরা পরীক্ষা দিতে চাই।’
বিভিন্ন ক্যাডারে দুই হাজার ১৬৬ শূন্যপদে প্রার্থী নিয়োগ দিতে ২০১৯ সালে নভেম্বরে ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থী তাতে আবেদন করেন। এটা বিসিএসে আবেদনের রেকর্ড।
৪১তম বিসিএসে ছাড়াও পিএসসি আরও তিনটি বিসিএস নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে ৪০তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা চলেছে। ৪২তম বিশেষ বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়ে গেছে। ৪৩তম বিসিএসের আবেদন প্রক্রিয়া চলছে। পিএসসি বলছে, জট এড়াতেই ১৯ মার্চ পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। ওইদিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ কেন্দ্রে একযোগে এই পরীক্ষা হবে।
পিএসসি বলছে, পরীক্ষায় পৌনে পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থী অংশ নেবেন। এর মধ্যে দুই লাখ ১১ হাজার প্রার্থীই ঢাকার। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৩৭ হাজার, চট্টগ্রামে ৩৫ হাজার, রংপুরে ৩২ হাজার, খুলনায় ৩০ হাজার, বরিশালে ১২ হাজার, সিলেটে ১৬ হাজার এবং ময়মনসিংহে ২৮ হাজার পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে বড় কেন্দ্রগুলোতে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার প্রার্থী আছেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি প্রার্থী আছেন এমন কেন্দ্রগুলোতে চ্যালেঞ্জটা বেশি।
কোভিড নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম গতকাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘করোনার এই সময়ে বিপুল সংখ্যক প্রার্থীদের নিয়ে পরীক্ষা নেওয়াটা ঝুঁকি। তবে, পিএসসি যদি মনে করে এই পরীক্ষা নিতেই হবে, তাহলে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীদের প্রবেশ থেকে শুরু করে বের হওয়ার পুরো সময়টা স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। প্রবেশের আগে ও কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার সময় মাস্ক পরে স্যানিটিইজিং করে ঢুকতে হবে। ব্যক্তিগত সুরক্ষা, সামস্টিক সুরক্ষা এগুলো না মানলে কিন্তু মুশকিল হয়ে যাবে।’
৪১তম বিসিএস নেওয়ার দায়িত্বে আছেন সাবেক সচিব ও পিএসসির সদস্য শাহজাহান আলী মোল্লা। পরীক্ষা নিয়ে পিএসসির প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি গতকাল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এমনিতেই চারটি বিসিএসের জট লেগেছে। আমরা এখন প্রতি বছর একটা করে বিসিএস শেষ করতে চাই। আর এই বিসিএস শুধু ঢাকায় না, সাত বিভাগেই হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে পরীক্ষাটি নেওয়া হবে।’
স্বাস্থ্যবিধির বিস্তারিত ব্যাখা করে শাহজাহান আলী মোল্লা বলেন, ‘আমরা ১১টি নির্দেশনা দিয়েছি। প্রত্যেককে মাস্ক পরে কেন্দ্রে আসতে হবে। প্রত্যেককে তাপমাত্রা মেপে কেন্দ্রে ঢোকানো হবে। কারও তাপমাত্রা বেশি হলে তাদেরকে আলাদা কেন্দ্রে নিয়ে নেওয়া হবে। পরীক্ষার্থীদের যথেষ্ঠ দূরত্ব মেনে আসন বিন্যাস করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমাদের যেসব নির্দেশনা মেনে পরীক্ষা নিতে বলেছে, আমরা সে অনুযায়ী সব করছি। আমরা আশা করছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’
শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
আরও পড়ুন:
৪১ ও ৪২তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ১৯ মার্চ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি
Comments