সুনামগঞ্জের শত বছরের সম্প্রীতির সুনাম নষ্ট করল কারা?

অবিভক্ত ভারতের কংগ্রেসনেত্রী সরোজিনী নাইডু সুনামগঞ্জ সফরে এসে মানুষ ও প্রকৃতির সুন্দর সহাবস্থান দেখে বলেছিলেন, ‘এখানকার প্রত্যেকটি মানুষ কেন কবি নয়?’
শাল্লার নোয়াগাঁও ও পাশের কয়েকটি গ্রামের হেফাজতে ইসলাম সমর্থকরা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা করে। ছবি: সংগৃহীত

অবিভক্ত ভারতের কংগ্রেসনেত্রী সরোজিনী নাইডু সুনামগঞ্জ সফরে এসে মানুষ ও প্রকৃতির সুন্দর সহাবস্থান দেখে বলেছিলেন, ‘এখানকার প্রত্যেকটি মানুষ কেন কবি নয়?’ 

সরোজিনী নাইডু ভুল বলেননি। অপূর্ব প্রকৃতি ও সম্প্রীতির জনপদ সুনামগঞ্জের প্রত্যেকটি মানুষ আসলে কবি। মরমি কবি হাসন রাজা, রাধারমণ, দুর্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিম, ক্বারি আমির উদ্দিনের মতো মানুষ এবং অবারিত হাওরের জল-জোছনার জনপদ সুনামগঞ্জের আছে শত বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস। 

কিন্তু, গত ১৭ মার্চ বুধবার বঙ্গবন্ধুর ১০১-তম জন্মোৎসবের দিনে সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেই ইতিহাসে কলঙ্ক লেপন করা হয়েছে। কাদের উসকানিতে, কাদের ইন্ধনে, কোন ধর্মান্ধ প্রেরণায় এই আক্রমণ হলো? হেফাজতের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত ঢাকার শাপলা চত্বর থেকে শাল্লা কতদূর? শাপলা থেকে এই শাল্লা বড় অচেনা লাগে। এ কোন বাংলাদেশ? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?

একই নদীর জল, একই হাওরের খেতের ফসল, একই সূর্যের আলো, একই বৃক্ষের ছায়া ও মায়ায় শত শত বছর ধরে শান্তি, স্বস্তি ও সম্প্রীতিতে পাশাপাশি থাকা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সচেতনভাবে ঘৃণার বীজ ছড়াচ্ছে কারা? এ গভীর অন্ধকার থেকে সহসা বের হওয়ার কোনো আলো কি আমরা দেখতে পাচ্ছি?

সুনামগঞ্জের শাল্লা সবসময় প্রগতিশীল রাজনীতির উর্বর ভূমি। অক্ষয়কুমার দাশ, বরুণ রায়, গুলজার আহমেদ, আব্দুস সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্মৃতিধন্য এই শাল্লা। দিরাই-শাল্লার মানুষ সবসময় প্রগতিশীল রাজনীতির সমর্থক। সেই জনপদে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বীজ রোপণ হলো কীভাবে?

১৫ মার্চ হেলিকপ্টারে চড়ে হেফাজত নেতা বাবুনগরী ও মামুনুল হক গিয়েছিলেন এক মাহফিলে। জানা যায়, সেখানেও তিনি বরাবরের মত উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি তরুণদের উগ্র ধর্মান্ধ রাজনীতির টার্গেট বানিয়ে উত্তেজিত করেন। প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলার মত ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। সেই মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লিখেছিলেন  এক হিন্দু যুবক। হেফাজতের অনুসারীরা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। হামলার আগের রাতে আপত্তিকর লেখার অভিযোগে যুবককে সোপর্দ করা হয় পুলিশের কাছে। তবুও, ১৭ মার্চ বুধবার সকালে দিরাই-শাল্লা উপজেলার নাচনী, চণ্ডিপুর, সন্তোষপুর, কাশিপুর, সরমঙ্গলসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রাম থেকে কয়েক হাজার হেফাজত অনুসারীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সংঘবদ্ধভাবে শাল্লার হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম নোয়াগাঁওয়ে হামলা চালায়। এসময় তারা ঘরবাড়ি ভাঙচুর, ব্যাপক লুটপাট করে। এতে নিরীহ ও ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও যুবককে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। এমন দৃশ্যের কথা ভাবলে সাতচল্লিশের দাঙ্গা আর একাত্তরে পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকারদের তাণ্ডবের কথাই মনে পড়ে।

উদ্বেগের বিষয় হলো- হেফাজতের নেতারা সারাদেশে মাহফিলের নামে তাদের রাজনৈতিক এজেণ্ডা নিয়ে ঘুরে ঘুরে সহজ-সরল সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষকে এভাবেই দিনের পর দিন উত্তেজিত করছেন, উসকানি দিচ্ছেন। সরকারের পাশাপাশি প্রগতিশীল লেখক, শিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মীদের বিরুদ্ধে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে, সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের মূল আদর্শের বিরুদ্ধে তাদের বক্তৃতায় নিয়মিত ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। প্রশাসনও এসব দেখেও না দেখার ভান করে। 

আশঙ্কার বিষয় হলো- স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে হেফাজতের মিছিল, মিটিং ও মাহফিলে সহযোগিতার। এ যেন সর্ষের ভেতরেই ভূত। এই আদর্শহীন রাজনীতির বিষফলই শাল্লার এই চিত্র। প্রায় সময় আমরা দেখি ব্যক্তি বিশেষের অপরাধের আক্রোশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ হয়। ব্যক্তি বিশেষের দায় একটা সম্প্রদায়ের ওপর কীভাবে বর্তায়? এই উসকানি আর বিভেদের কারিগর কারা? অথচ বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি- এই স্লোগানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। বঙ্গবন্ধুর ১০১-তম জন্মদিনে শান্তি ও শত বছরের সম্প্রীতির জনপদ শাল্লাবাসী আজ এমন নজিরবিহীন আক্রমণে স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ, হতবাক। এ দুঃসহ স্মৃতি, এ গভীর ক্ষত তারা কীভাবে কাটিয়ে উঠবে আমরা জানি না। সরকার ও প্রশাসন এখন তাদের কতটা নিরাপত্তা দিতে পারবে, শঙ্কা কাটিয়ে উঠতে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হবে, অপরাধীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা দেখার বিষয়। 

যারা সুনামগঞ্জের শত বছরের সম্প্রীতির সুনাম নষ্ট করেছে তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিও দেখে দোষীদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হোক। যাতে ভবিষ্যতে কখনো কেউ এমন আক্রমণের দুঃসাহস না দেখায়। রামু, রংপুর, নাসিরনগর, ভোলা থেকে শাল্লা এসব বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। একই রোগের উপসর্গ মাত্র। এসব রোগের সুচিকিৎসা জরুরি। ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়লে কোনো প্রতিষেধকে কাজ হবে না। 

লেখক: কবি ও গবেষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

9h ago