গতি হারিয়েছে করোনা টিকাদান কর্মসূচি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন নিবন্ধন প্রক্রিয়া জটিল
ছবি: আমরান হোসেন

চলমান করোনা টিকাদান কর্মসূচির ব্যাপারে কিছুই জানেন না পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ার পাথর শ্রমিক জহুর আলীর (৪৪)। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মহানন্দা নদী থেকে পাথর সংগ্রহ করেন তিনি। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘টিকাদান যে চলছে, আমার জানা নাই। আপনার কাছ থেকেই মাত্র জানলাম।’

এই প্রতিবেদক চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তেতুলিয়া বাজারের আশপাশের বিভিন্ন পেশার প্রায় ৫০ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন।

জহুর আলীসহ আরও কয়েকজন নদী থেকে পাথর সংগ্রহ করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাদের একজন মো. শহীদুল (৩০) অবশ্য বলেন যে তিনি টিকাদান কর্মসূচির বিষয়ে শুনেছেন।

তবে তিনি এটা জানতেন না যে মাত্র আধ কিলোমিটার দূরে তেতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে।

এর পাশেই ঈদগাহ বস্তি গুচ্ছগ্রাম। গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে অল্প সময় আলাপেই বোঝা গেলো যে তাদেরও দেশব্যাপী করোনার টিকাদান কর্মসূচির ব্যাপারে ধারণা নেই বললেই চলে।

সেখানকার বাসিন্দা জাহানারা বেগম (৪০) বলেন, ‘আমি টিকাদান কর্মসূচির কথা শুনেছি। কিন্তু, কোথায় টিকা দেয় জানি না। আমাদের সঙ্গে কেউ (স্বাস্থ্যকর্মী) যোগাযোগ করেননি।’

বেশিরভাগ লোকজনই জানান যে তারা এখনো টিকা নেননি। অল্প কয়েকজন জানান যে তারা কিংবা তাদের পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা টিকা নিয়েছেন। তবে, তারা সবাই টিকা নিতে আগ্রহী।

তেতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, উপজেলায় তিন হাজার ৫৫০ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা সরবরাহ করা হয়েছে এবং গতকাল পর্যন্ত তিন হাজার ডোজ দেওয়া হয়েছে।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী করোনা টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। সরকারের পরিকল্পনা ছিল প্রথম মাসেই প্রায় ৭০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার। কিন্তু এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। এখন পর্যন্ত ৪৯ লাখ ১১ হাজার ৯০২ জন মানুষ টিকা নিয়েছেন।

গতকাল টিকা নিয়েছেন ৭০ হাজার ৯৩৩ জন। ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে দৈনিক গড়ে দুই লাখ মানুষ টিকা নিয়েছেন।

তেতুলিয়ার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আবুল কাশেম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যারা নিবন্ধন করেন, তাদেরকে আমি নিজে ফোন করি। আমরা প্রতি সপ্তাহে দুইবার বাজার এলাকায় ঘোষণা দিয়ে মানুষকে টিকার ব্যাপারে জানাই। তারপরও খুব বেশি মানুষ সাড়া দিচ্ছে না। গতকাল (রোববার) মাত্র ৩৪ জন টিকা নিতে এসেছিলেন।’ 

এই প্রতিবেদক ৬ থেকে ১২ মার্চের মধ্যে রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারি, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের প্রায় ১০০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। 

তাদের বেশিরভাগেরই টিকা সম্পর্কে খুব কম ধারণা রাখেন। বিশেষ করে দিন মজুরদের ক্ষেত্রে সচেতনতা আরও কম।

রংপুর সদর হাসপাতালের স্বাস্থ্য সহকারী নাসিমা বেগম বলেন, ‘আমি আমার এলাকায় মানুষের বাসায় গিয়ে টিকা নিতে উৎসাহ দেই। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমার সন্দেহ থাকে যে আদৌ তারা টিকা নেবেন কি না।’

‘নিবন্ধন প্রক্রিয়া ঝামেলাপূর্ণ’

সরকার গত ২৭ জানুয়ারি সুরক্ষা ডট কম ওয়েবসাইটের মাধ্যমে টিকাদানের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু করে।

টিকা নিতে জাতীয় পরিচয় পত্র ও মোবাইল নম্বরসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। নিবন্ধন শেষ হলে টিকা কার্ডের একটি প্রিন্ট কপি নিয়ে টিকাদান কেন্দ্রে যেতে হয়।

মানুষের সাড়া কম হওয়ায় সরকার টিকা নেওয়ার ন্যুনতম বয়স কমিয়ে ৪০ বছর করেছে। এরপরেও টিকা নিতে উৎসাহী মানুষের সংখ্যা বাড়েনি।

গতকাল বিকেল পর্যন্ত মোট ৬২ লাখ ৮২ হাজার ৮৮৪ জন নিবন্ধন করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে জটিল ও ঝামেলাপূর্ণ বলে মনে করছেন।

মগবাজার, শান্তিনগর সহ রাজধানী শহরের বেশ কিছু এলাকা ঘুরে ছোট ছোট দোকানে ৫০ টাকার বিনিময়ে করোনা টিকার নিবন্ধন করে দেওয়ার বিজ্ঞাপন দেখা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক ডা. শফিউন শিমুল টিকাদান কর্মসূচিতে মানুষের কম সাড়ার পেছনে তিনটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন।

তিনিই বলেন, ‘প্রথমত, অনেকেই টিকাদান কর্মসূচির ব্যাপারে ভালো করে জানে না। দ্বিতীয়ত, নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল, এবং সবশেষে মানুষের মনে টিকা নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধা আছে।’

ডা. শফিউন করোনা টিকার প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

তার বক্তব্যের সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের কার্যকরী দলের সদস্য ডা. জাকির হুসাইন বলেন, ‘সরকার এখনো মানুষকে এ কথাটি বিশ্বাস করাতে পারেনি যে সবাই কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। সরকারের বর্তমান প্রচারণা দেশের সাধারণ জনগণের জন্য উপযোগী নয়।’

টিকা দেওয়ার জন্য বয়সের সীমা থাকা উচিত নয় বলে তিনি মনে করেন।

‘৪০ বছরের কম বয়সী লোকেরা প্রতিদিন বাইরে যান। তারা সুপার-স্প্রেডার। কিন্তু আমরা তাদেরকে অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি। এটি সংশোধন করা উচিত,’ তিনি বলেন।

Comments

The Daily Star  | English

Smaller in size, larger in intent

Finance Adviser Salehuddin Ahmed has offered both empathy and arithmetic in his budget speech, laying out a vision that puts people, not just projects, at the heart of economic policy.

9h ago