মুক্তিযুদ্ধ

একাত্তরের রক্তাক্ত বাড়ি

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কুষ্টিয়ার কোহিনুর ভিলার গণহত্যা এখনও মানুষকে শিউরে তোলে। শহরের দেশওয়ালী পাড়ার বাড়িটিতে একই রাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ ১৬ জনকে। ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে সেই হত্যাযজ্ঞ ঘটায় স্থানীয় রাজাকার বাহিনী ও রাজাকারদের সহযোগী বিহারীরা। কুষ্টিয়ার মানুষের মুখে মুখে এই বাড়িটি ‘একাত্তরের রক্তাক্ত বাড়ি’ নামে পরিচিত।
কুষ্টিয়ার দেশওয়ালী পাড়ার কোহিনুর ভিলা, যেটি স্থানীয়দের কাছে ‘একাত্তরের রক্তাক্ত বাড়ি’ নামে পরিচিত।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কুষ্টিয়ার কোহিনুর ভিলার গণহত্যা এখনও মানুষকে শিউরে তোলে। শহরের দেশওয়ালী পাড়ার বাড়িটিতে একই রাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ ১৬ জনকে। ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে সেই হত্যাযজ্ঞ ঘটায় স্থানীয় রাজাকার বাহিনী ও রাজাকারদের সহযোগী বিহারীরা। কুষ্টিয়ার মানুষের মুখে মুখে এই বাড়িটি ‘একাত্তরের রক্তাক্ত বাড়ি’ নামে পরিচিত।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ভারতের হুগলি জেলার খানাকুল থানার পাঁচপীরতলা গ্রাম থেকে বাংলাদেশে আসেন দুই ভাই রবিউল হক মল্লিক ও আরশেদ হক মল্লিক। কুষ্টিয়া শহরের দেশওয়ালী পাড়ার রজব আলী খান সড়কের পাশে ৪০/১৯ বাড়িটি কিনে তাদের মায়ের নামে নাম রাখেন ‘কোহিনুর ভিলা’। হুগলিতে রয়ে যান তাদের আরও দুই ভাই।

কুষ্টিয়াতে এসে বেকারি ব্যবসা শুরু করেন তারা। তাদের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত কোহিনুর মিলকো ব্রেড অ্যান্ড বেকারি শহরে বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। ১৯৬০ পরবর্তী দুই ভাইয়ের মধ্যে রবিউল হক মল্লিক সরাসরি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে বিভিন্ন কর্মকান্ডে যোগ দেন। তিনি ছিলেন সজ্জন ও শিক্ষানুরাগী মানুষ। তিনি তার বাড়ির পাশেই মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন। রবিউলের বড় ছেলে আব্দুল মান্নান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় গড়ে ওঠা জয়বাংলা বাহিনীর সদস্য।

ওই রাতের নির্মম হত্যাযজ্ঞে শহীদ হন পরিবারের সবাই। বাংলাদেশে রবিউলের আর কোনো আত্মীয়স্বজন ছিল না। দেশ স্বাধীন হলে স্থানীয়রা ভারতের হুগলিতে খবর পাঠায়। সেখান থেকে রবিউল হক মল্লিকের বড় ভাই ইসমাইল মল্লিক কোহিনুর ভিলায় আসেন। ইসমাইল মল্লিকও মারা গেছেন। ওয়ারিশ সূত্রে এখন বাড়িটিতে ইসমাইলের দুই ছেলে হালিম হক মল্লিক আলিম, শিরু হক মল্লিক ডালিম ও এক মেয়ে আকলিমা খাতুন বসবাস করছেন।

যখন কথা হয় হালিম মল্লিকের সাথে তিনি সেদিনের ঘটনা ও পেছনের বেশ কিছু ঘটনা জানান। হালিমের বয়স এখন ৫৮ বছর। তিনি এদেশে এসে সমস্ত ঘটনা শুনেছেন তার চাচার বেকারির এক কর্মচারী আকুল ও কয়েকজন প্রতিবেশির কাছে।

তিনি জানান, ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আাশেপাশের অন্যান্য পরিবারের মতো রবিউল হক মল্লিকের পরিবার প্রথম দিকে বাড়ি ছেড়ে যাননি।

হালিম মল্লিক জানান, তার চাচা রবিউল বেকারিতে তৈরি পাউরুটি, বিস্কুট, তন্দুরি গোপনে শহরের পূর্বদিকে ছোট ওয়ারলেসে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে সরবরাহ করতেন। কখনও তিনি নিজে, কখনও তার ছোট ভাই আরশেদ কখনও বেকারির কর্মচারীরা এগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে আসতো।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে ১ এপ্রিল মুক্ত হয় কুষ্টিয়া। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের পর ১৮ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি বাহিনী সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কুষ্টিয়া পুর্নদখলে নিয়ে নেয়। এসময় কুষ্টিয়া শহরে কারফিউ জারি করে শুরু হয় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। ইপিআর সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পুরো বেকারি জাতীয় খাবার সরবরাহ করা হয়েছিল রবিউল মল্লিকের কোহিনুর মিলকো বেকারি থেকে। রবিউল কোপানলে পড়ে যান স্থানীয় রাজাকার ও রাজাকার সহযোগী বিহারীদের। এসময় ভারতে চলে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও রবিউল হক যাননি। তিনি আশ্রয় নেন ৪ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়া সদর উপজেলারই জিয়ারখী ইউনিয়নের কমলাপুর গ্রামে তার এক পরিচিত জনের বাড়িতে।

‘তার আগে সম্ভবত ৩০ এপ্রিল শহরের স্টেশন রোডে ঠিক রবিউলের বেকারির সামনেই সুরুজ মিয়া নামে পোড়াদহের এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করে রাজাকার সহযোগী কোরবান বিহারী। এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন রবিউল হক মল্লিক ও আরশেদ হক মল্লিক। হত্যাকারীরা রবিউলকে এজন্য হুমকিও দিয়েছিল।’

হালিম মল্লিক জানান, কোরবান বিহারী ছিলেন রবিউলের প্রতিবেশী। এর মাঝে সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে কোরবান বিহারী কমলাপুর গ্রামে গিয়ে রবিউলের সাথে দেখা করে। তিনি রবিউলকে নিজ বাড়িতে ফিরে আসতে পিড়াপিড়ি করেন। কোরবান বিহারী রবিউলকে আশ্বস্ত করে কোন ভয় নেই সে তাকে রক্ষা করবে। এ সময় ব্যবসা বাণিজ্যসহ নানা চিন্তা-ভাবনা করে শহরে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন রবিউল। তিনি শহরে ফেরেন ১৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে।

সেই রাতে ঘটে বীভৎস হত্যাযজ্ঞ

হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে হালিম মল্লিক জানান, বীভৎস ছিল পুরো ঘটনা। ওই রাতে কোরবান বিহারী, মজিদ কসাই, ফোকু কসাই’র নেতৃত্বে ২৫-৩০ জন কোহিনুর ভিলায় হাজির হয়। তখন রাত আনুমানিক ১২টা। শহরে কারফিউ। সজোরে দরজার কড়া নাড়লেও প্রথমে কেউ দরজা খোলেনি। পরে প্রতিবেশী কোরবান বিহারী বার বার নিজের পরিচয় দিলে দরজা খুলে দেন রবিউলের বড় ভাই আরশেদ হকের বড় ছেলে আশরাফ হক। তখন বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন ১৭ জন মানুষ।

এরা হলেন রবিউল হক মল্লিক ও তার দুই স্ত্রী, আত্মীয় রিজিয়া বেগম, ছেলে আব্দুল হান্নান, আব্দুল মান্নান, বড় ভাই আরশেদ হক মল্লিক, তার স্ত্রী, মেয়ে আনু, আফরোজা, ছেলে আশরাফ, অতিথি রেজাউল, দোকান কর্মচারী আসাদ, বাতাসী, জরিনা ও আকুল। এদের মধ্যে আকুল ছাড়া বাকি সবাই সেদিন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। দোকান কর্মচারী আকুল বাসার এক কোণে লুকিয়ে ছিল, তাকে কেউ খুঁজে পায়নি।

হালিম জানান, হত্যাকাণ্ডের পর আকুল অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে গেলেও তার কাছ থেকে তারা ঘটনা জানতে পারেন। সেদিন সবাইকে জবাই করে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে, খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। লাশগুলোর কারো কারো হাত-পা রশি ও মশারী দিয়ে বাঁধা ছিল। নিহতের আর্ত চিৎকার যাতে বাইরে যেতে না পারে সেজন্য ঘরের মধ্যে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে দেয়া হয় বলে পরবর্তীতে আশেপাশের মানুষজন জানিয়েছিলেন।

সকালে পৌরসভার ড্রেনে রক্তের ধারা দেখতে পেয়ে এলাকাবাসী বাড়ির ভিতরে ও আশেপাশে ক্ষতবিক্ষত লাশগুলো দেখতে পায়। রবিউল হক মল্লিকসহ তিন-চারজনের লাশ পড়েছিল বাাড়ির দক্ষিণপাশে নফর শাহর মাজারের পাশে। কয়েকজনের লাশ পড়েছিল বাড়ির পূর্বপাশে পুকুড় পাড়ে। বাড়ির মধ্যে, বাথরুমে, রান্না ঘরে, শোবার ঘরের মেঝেতে রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পড়েছিল সবার লাশ। ছোট ৮ বছরের রাজুকে হত্যা করে ফেলে দিয়েছিল পুকুর পাড়ে। নারীদের লাশ ছিল বিবস্ত্র।

খুনিরা টাকা পয়সা ছাড়াও বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নেয়।

হালিম জানান, শুনেছি হত্যাকাণ্ডের পরের দিন বেলা দশটা সাড়ে দশটার দিকে গাড়িতে কয়েকজন সেনাসহ একজন পাকিস্থানী সেনা কর্মকর্তা এসেছিলেন সংবাদ শুনে। তিনি নাকি এতোটা নৃশংসতা কখনও দেখেননি।

বাড়ির পেছনে পূর্বপাশে ফাঁকা জায়গায় চারটি কবরে ১৬ জনকে কবর দেওয়া হয়েছিল। দুইটি কবরে ছোটদের পাঁচজন করে এবং অন্য দুটি কবরে বড়দের তিনজন করে দাফন করা হয়।

সংরক্ষণ করা হয়নি গণহত্যার স্থান, গণকবর

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কোহিনুর ভিলা গণহত্যার স্থান ও গণকবরগুলি বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। এখন গণকবরের তিনদিকে পাকাবাড়ি ও একদিকে বর্তমানে ফাঁকা জায়গা রয়েছে। তবে সেটি অন্যের মালিকানাধীন। কবরের চারপাশে নামমাত্র প্রাচীর। গণকবরে আসা যাওয়ার জন্যও বিশেষভাবে কোন রাস্তা বা গলি নেই। শুধু কবরের জায়গাটুকু খালি পড়ে আছে। প্রতিবেশিদের বাড়ির ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে যেতে হয়। কোহিনুর ভিলার পুরাতন বাড়িটির অবস্থা খুবই শোচনীয়। বাড়িটির পুরাতন ছাদ ও পলেস্তরা খসে পড়ছে। বাড়ির পশ্চিমপাশে রাস্তার পাশে ২০১০ সালে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ৭১, খুলনা বিভাগ কর্তৃক একটি নামমাত্র নামফলক নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সেখানে শহীদদের পূর্ণাঙ্গ নামের তালিকা নেই। শহীদদের নামের পাশে উল্লেখ করা বয়স নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে।

প্রতিবছর ১৮ সেপ্টেম্বর কোহিনুর ভিলার গণহত্যার দিনটিকে সরকারিভাবে স্মরণ করা হয় না। কেবলমাত্র গণমাধ্যমকর্মীরা এ বাড়িটিকে ঘিরে সংবাদ প্রচার করে আসছে। নতুন প্রজন্ম জানে না এই বাড়িটির ইতিহাস। জানে না গণহত্যার শিকার শহীদদের সম্পর্কে এবং কারা গণহত্যা চালিয়েছিল।

হালিম মল্লিক জানান তার পূর্বে তার পিতা এবং বর্তমানে তিনি বহু মানুষের কাছে ঘুরছেন এই বাড়ি ও কবরটি রক্ষার জন্য। কিন্তু উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এমনি পরিবারটি শহীদ পরিবারের মর্যাদাও পায়নি।

Comments

The Daily Star  | English
BNP office in Nayapaltan

Column by Mahfuz Anam: Has BNP served its supporters well?

The BNP failed to reap anything effective from the huge public support that it was able to garner late last year.

9h ago