‘রণক্ষেত্র’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া

হেফাজতে ইসলামের হরতালকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন সর্বত্র। চারদিকে ঝাঁজালো পোড়া গন্ধ। ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান, দুটি মন্দির, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, ভূমি অফিস, জেলা পরিষদ কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, পৌর মিলনায়তন, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন, জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারসহ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বাড়িতে।
ছবি: মাসুক হৃদয়

হেফাজতে ইসলামের হরতালকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন সর্বত্র। চারদিকে ঝাঁজালো পোড়া গন্ধ। ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান, দুটি মন্দির, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, ভূমি অফিস, জেলা পরিষদ কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, পৌর মিলনায়তন, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন, জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারসহ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বাড়িতে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব, থানা ভবন, পুলিশের কার্যালয় এমনকি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে চলাচলকারী আন্তঃনগর ট্রেনও হামলা-ভাঙচুরের কবল থেকে রক্ষা পায়নি।

ছবি: মাসুক হৃদয়

গতকাল রোববার পুলিশ ও হেফাজত নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিভিন্ন স্থানে এবং সরাইল বিশ্বরোড এলাকায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিন জন নিহত হয়েছেন। মোদিবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত তিন দিনে সেখানকার সংঘর্ষে মোট নয় জন মারা গেছেন। এর মধ্যে শুক্রবার একজন ও শনিবার পাঁচ জন মারা যান।

গতকাল সন্ধ্যা নাগাদ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে অন্তত ৪০ জন গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

সরাইল সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আনিছুর রহমান হাইওয়ে থানায় হামলার বিষয়টি দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করে জানান, হামলায় অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।

গতকালের নিহতরা হলেন— সদর উপজেলার বুধল ইউনিয়নের খাঁটিহাতা গ্রামের আলতাব আলীর ছেলে হাদিস মিয়া ওরফে কালন মিয়া (২৩), সরাইল উপজেলা সদরের কুট্টাপাড়া গ্রামের সুফি আলীর ছেলে আল-আমিন (২০)। আনুমানিক ৪০ বছর বয়সী অপর নিহত ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায়নি।

ছবি: মাসুক হৃদয়

হাদিস ও আল-আমিন সরাইল বিশ্বরোড মোড়ে হাইওয়ে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যান। নিহত অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি শহরের পীরবাড়ি পুলিশ লাইনস এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন।

রোববার বেলা ১১টার পর হেফাজতের হরতাল-সমর্থকরা জেলা পরিষদ ভবনে আগুন দেয়। ভবনটির নিচতলার একাধিক কক্ষে অগ্নিসংযোগের পর এসি বিস্ফোরিত হয়। এর পরপরই সুরসম্রাট আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার এবং পৌরসভায় ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়।

আগুনে সদর উপজেলা ভূমি অফিসের নিচতলার বিভিন্ন কক্ষে থাকা নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনের শ্রেণিকক্ষ ও জাদুঘরে থাকা সবকিছু ভস্মীভূত হয়ে গেছে। সেখানকার সরোদ মঞ্চের সব আসবাবপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

রোববার দুপুর ১২টার দিকে হেফাজত কর্মীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব ভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। সেসময় প্রেসক্লাব ভবনের সামনে ক্লাবের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামিরের ওপরও হামলা চালানো হয় বলে জানান প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জাবেদ রহিম বিজন। জামিরের মাথায় ছয়টি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার পর থেকেই হেফাজতের হরতাল সমর্থকরা হামলা-ভাঙচুর চালাতে শুরু করেন। তাদের সঙ্গে বহিরাগত একদল যুবক মিলে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা পৌরসভা কার্যালয়, পৌর মিলনায়তন, পুলিশ লাইনস, সদর থানা, খাঁটি হাতা বিশ্বরোড হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি, শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালী বাড়ি মন্দির, দক্ষিণ কালী বাড়ি, জেলা আওয়ামী লীগ ও সংসদ সদস্যের কার্যালয়, সরকারি গণগ্রন্থাগার, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারের কার্যালয়, তার নিজ ও শ্বশুর বাড়ি, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পাঠাগার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা চৌধুরী আফজাল হোসেন নেসারের বাড়ি, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আনার, জামাল খানের বাড়ি, বিজয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়ার কার্যালয়, উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী মহিলা কলেজ, ছাত্রলীগ সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেলের বাড়ি, সাধারণ সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন শোভনের বাড়ি এবং চৌধুরী মঞ্জিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায় ও আগুন দেয়।

ছবি: মাসুক হৃদয়

জেলার আশুগঞ্জ, সরাইলের একাধিক জায়গায় আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। গতকাল বেলা ১টা পর্যন্ত হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ চলে।

এসব হামলার মূল লক্ষ্য ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি সম্পদ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি। শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায়নি মন্দির ও প্রেসক্লাব। শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ভাষা চত্বরে শনিবার থেকে শুরু হওয়া উন্নয়ন মেলার স্টলও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম পথের চলন্ত সোনার বাংলা ট্রেনেও হামলা হয়।

শহরের সরকারি কলেজ সংলগ্ন রেলগেট এলাকায় আশপাশের ড্রেন থেকে কংক্রিটের স্ল্যাব তুলে রেললাইনে রাখা হলে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। স্টেশনের কাছের রেলগেটের ব্যারিয়ার বাঁকা করে ফেলা হয়। রেললাইনের প্যান্ডেল ক্লিপ খুলে ফেলা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথের তালশহর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনের মাঝখানে একটি সেতুতেও আগুন দেওয়া হয়। পৌর এলাকার মূল সড়কের অনেক জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটি ফেলে রাস্তা আটকে রাখা হয়।

আশুগঞ্জে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর টোলপ্লাজায় পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ করেন হরতাল সমর্থনকারীরা। আগুন দেওয়া হয় পুলিশ ফাঁড়িতে। টোল আদায়ের বুথ ভাঙচুর করা হয়।

সরাইলের বিশ্বরোড খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেসময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই জন মারা যান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার শোয়েব আহমেদ জানান, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনের পৌঁছার আগে হরতাল সমর্থকরা ইট-পাটকেল ছুঁড়ে। এতে ট্রেনের ইঞ্জিন ও ১৫ কোচের ১১৭টি কাঁচ ভেঙে যায়। পরে ট্রেনটি পুশ ব্যাক করে ভৈরব রেলওয়ে জংশন স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়।

সকালে হরতালের সমর্থনে করা মিছিলে নেতৃত্বদানকারী হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সাজিদুর রহমান গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন, শনিবার স্থানীয় সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর নেতৃত্বে মিছিল থেকে বিনা কারণে মাদ্রাসাছাত্রদের ওপর হামলা চালানো হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই উত্তেজনা দেখা দেয়।

এমপি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী আজ দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবে বলেন, ‘গতকালে হেফাজতের ব্যানারে, তাদের নামে যে তাণ্ডবলীলা চালানো হয়েছে, তা একাত্তরের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে শুধু হেফাজতই নয়, তৃতীয় একটা পক্ষও রয়েছে। যারা মিলে এই কাজ করেছে। তাণ্ডবের সময় পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। আমি এই ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি।’

এর আগে, এক মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরজুড়ে ব্যাপক হামলা-ভাঙচুর চালিয়েছিল জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা। সেদিনও ‘রণক্ষেত্রে’ পরিণত হয়েছিল পুরো শহর। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ আর লুটপাটের ঘটনায় অন্তত একশ কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে জানায় স্থানীয় প্রশাসন। সেদিন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন, উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন ও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরের কয়েটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়।

আরও পড়ুন:

আবারও পোড়ানো হলো ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভূমি অফিস, গণগ্রন্থাগার, আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে আগুন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হাইওয়ে থানা ও পুলিশ লাইনে হামলা, গুলিতে নিহত ৩

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: নিহত বেড়ে ৬ হেফাজতের হরতালে দোকান ও যান চলাচল বন্ধ

Comments

The Daily Star  | English
Chief Adviser Muhammad Yunus

Chief Adviser Yunus's UNGA trip a critical turning point

Now is the best chance for Bangladesh to strengthen international cooperation.

4h ago