২ এপ্রিল ১৯৭১: জিঞ্জিরা গণহত্যা
দিনটি ছিল শুক্রবার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কুখ্যাত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বশীর সেদিন মিটফোর্ড হাসপাতালের ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন কী করে নিশ্চিহ্ন করা যায় হচ্ছে একটি জনপদকে। তার পরিকল্পনা মতো ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে শতাব্দীর এক ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞ।
বুড়িগঙ্গা নদীর ওপাড়ে চলছে একটি জনপদের মানুষকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার তাণ্ডব। মিটিমিটি হেসে রশিদ আহমেদ আত্মতৃপ্তিতে হয়তো নিজেই নিজেকে বলছেন, আজকেই সব খতম। ২৫ মার্চের পর যারা জীবিত ছিল সবগুলোর ভবলীলা সাঙ্গ হবে আজ। আজ পালানোর কোনো উপায় নেই।
এর আগের দিন পহেলা এপ্রিল বিকেলে বুড়িগঙ্গায় গানবোটে টহল দিচ্ছিল পাকিস্তানি হানাদারেরা। তখনো কেরানীগঞ্জ ও জিঞ্জিরার মানুষ বুঝতে পারেনি, সামনে কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। সেদিন রাতের মধ্যেই জিঞ্জিরা, কালিন্দী ও শুভাড্যা— এই তিন ইউনিয়ন ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা। তাদের লক্ষ্য ছিল— একটা পিঁপড়াও যেন বের হতে না পারে এই জনপদ থেকে।
পরদিন ভোরে তিন ইউনিয়ন ও বুড়িগঙ্গার এপাশের মানুষের ঘুম ভাঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের মর্টার শেল ও মেশিনগানের শব্দে। কিন্তু, কারো কল্পনাতেও আসেনি কী হতে চলেছে। কী পরিকল্পনা করা হয়েছে এই তিন ইউনিয়ন ঘিরে। লক্ষ্য একটাই— এই জনপদের প্রতিটি মানুষকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বশীরসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি জেনারেল তখন মিটফোর্ড হাসপাতাল ও পার্শ্ববর্তী মসজিদের ছাদে। সেখান থেকেই চলছে নির্দেশনা ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হত্যাযজ্ঞ বাস্তবায়নের কাজ।
২ এপ্রিল ভোর পাঁচটায় মিটফোর্ড হাসপাতালের পাশে মসজিদের ছাদ থেকে ফ্লেয়ার ছুঁড়ে অপারেশন শুরুর সিগনাল দেন ব্রিগেডিয়ার রশিদ। এরপর শুরু হয় ইতিহাসের এক ভয়াল হত্যাযজ্ঞ আর তাণ্ডবলীলা।
সেদিন সকালে প্রথমেই পাকিস্তানি সেনারা জিঞ্জিরা ও বড়িশুর বাজার গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। তারপর ঘরবাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।
এদিকে মানুষ ভয়ে সমানে দিগ্বিদিক হয়ে ছুটছে। পালাচ্ছে যেদিকে পারছেন। কেউ বা পচা পুকুরে, কেউ ক্ষেতের আড়ালে, ঘরের কোণায়, বাড়ির পাশে ঝোপে লুকিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা পিঁপড়ার মতো খুঁজে খুঁজে মেরেছে নিরস্ত্র মানুষকে। সামনে যারা ছিল তারা তো বটেই, ব্রাশফায়ারের হাত থেকে রক্ষা পায়নি মায়ের কোলের শিশুও। আছাড় দিয়ে, গুলি করে মা-সহ সন্তানকে হত্যা করেছে পাকিস্তানিরা। গ্রামের পর গ্রাম গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে নিমেষেই।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য ছিল মান্দাইল ডাকের রাস্তার সামনের পুকুরপাড়ের একটি ঘটনা। সেদিন এক লাইনে একত্রে দাঁড় করানো হয় ৬০ জনকে। তারপর গর্জে ওঠে স্টেনগান। নিমিষেই ব্রাশফায়ারে লুটিয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ।
এভাবে একের পর এক লাইনে জড়ো করার পর স্টেনগান গর্জে উঠে। কালিন্দীর এক বাড়িতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদারেরা পাশবিক অত্যাচার করে ১১ নারীকে হত্যা করে। গণহত্যার পর পাকিস্তানিরা অনেক কলেজ পড়ুয়া নারীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রের অষ্টম খণ্ডে তুলে ধরা হয়েছে জিঞ্জিরা গণহত্যার ঘটনা। এতে বলা হয়েছে—
অবশেষে ভোর হলো। কেরানীগঞ্জবাসী তখন ঘুমে অচেতন। সহসা শোনা গেল কামান আর মর্টারের শব্দ। অনেকে লাফিয়ে উঠল ঘুম থেকে। যে যেখানে পারল ছুটাছুটি করতে লাগল। শুরু হলো নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চারদিকে। কেবল চিৎকার, শুধু প্রাণ বাঁচানোর আকুল প্রচেষ্টা। পশুরা রাতভর প্রচেষ্টা নিয়েছিল। কেরানীগঞ্জকে ঘিরে রেখেছিল।
ক্ষেতের মধ্যে নালা কেটে তারা যখন প্রস্তুতি নেয় কেরানীগঞ্জবাসী তখন ঘুমে অচেতন। ঝোপ, ঝাড়, পুকুর, ঘরের ছাদ— যে যেখানে পারল সবাই আত্মগোপন করল। কিন্তু, খুনি টিক্কা খানের কুখ্যাত ব্রিগেডিয়ার বশীর রেহাই দেয়নি কাউকে। গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিল।
মেশিনগান আর টমিগানের প্রচণ্ড আওয়াজে সকলে বিচলিত। সমানে চলল জিঞ্জিরা শুভাড্যা ও কালিন্দী ইউনিয়নের লোকদের ওপর গুলি, অগ্নিসংযোগ লুণ্ঠন। ধর্ষিতা হলো কেরানীগঞ্জের মা-বোনেরা। তিন ইউনিয়নের প্রত্যেকটি ঘর আক্রান্ত হলো। অবশেষে হত্যাযজ্ঞের সমাপ্তি ঘটল। কুখ্যাত ব্রিগেডিয়ার বশীরের নির্দেশ মতো বর্বর বাহিনী থেমে গেল। রেখে গেল এক রক্তাক্ত কাহিনী।
প্রতি গ্রাম থেকে সংবাদ এলো অসংখ্য মৃত্যুর। শত শত লাশ, রক্তে রঞ্জিত লাশ। পিতার বুকে জড়ানো শিশুর লাশ। মার কোল থেকে গুলি খেয়ে ছিটকে পড়া শিশুর বিকৃত-বীভৎস লাশ। মায়ের লাশ, বোনের লাশ, বর্বর পিশাচের দল রক্তের নদী বইয়ে দিল কেরানীগঞ্জে।
ভোর সাড়ে ৫টায় শুরু হওয়া গণহত্যা থামে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে। এই নয় ঘণ্টায় স্রেফ কচুকাটা করা হয়েছিল জিঞ্জিরা, কালিন্দী ও শুভাড্যা ইউনিয়নের প্রাণের ভয়ে পালানো নিরীহ মানুষদের। জিঞ্জিরা গণহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন দুই হাজারের বেশি নিরীহ মানুষ।
এই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। তিনি তার জিঞ্জিরা জেনোসাইড ১৯৭১ বইয়ে লিখেছেন, 'একটি ডোবার ভেতরে মাথা গুঁজে বসে আমি তখন এমন একটি করুণ মৃত্যুর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি যা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। পারিনি। আমি দেখি শেলের আঘাতে একজন ধাবমান মানুষের দেহ থেকে তার মস্তকটি বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়েছে আমি যে ডোবায় লুকিয়ে ছিলাম সেই ডোবার জলে, কিন্তু ঐ মানুষটি তারপরও দৌড়াচ্ছে। শেলের আঘাতে তার মাথাটি যে দেহ থেকে উড়ে গেছে সেদিকে তার খেয়ালই নেই। মস্তক ছিন্ন দেহটিকে নিয়ে কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করার পর লোকটা আর পারলো না, তার কবন্ধ দেহটা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। মস্তকহীন দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তস্রোতে ভিজে গেল শুভাড্যার মাটি।'
সাবেক কূটনীতিক আবদুল হান্নান ছিলেন জিঞ্জিরা গণহত্যার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী। সেদিনের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন, '২ এপ্রিল ভোরে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল উত্তর দিক থেকে আসা মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের বিকট শব্দে। সবাই যে যেদিকে পারে ছুটে যেতে লাগল নিরাপত্তার সন্ধানে। আমি আমার ছয় বছরের ছেলে টিংকুকে নিয়ে এবং আমার স্ত্রী আমাদের তিন বছরের ছেলে রিংকুকে কোলে করে হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে দক্ষিণ দিকে দৌড়াতে লাগলাম। আমার মেয়ে রিমি তখনো এই মন্দ পৃথিবীতে আসেনি। কিছু দূর যেতেই দেখলাম লোকগুলো সবাই পূর্ব দিকে ছুটছে। কিছুক্ষণ পর পূর্ব দিক থেকে গুলি আসছে দেখে আমরা পশ্চিম দিকে ছুটতে লাগলাম। পেছন ফিরে দেখি, আমার স্ত্রী ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পথে পড়ে গেছে। আমি বারবার ব্যাগটা ফেলে দিতে বলায় অবশেষে সে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমার পেছন পেছন ছুটতে লাগল। আমরা একটা মসজিদে আশ্রয় নিতে গেলাম। মসজিদে মানুষের ভিড়ে আর ঠাঁই ছিল না। মসজিদের পেছনে দেখি, অনেক মানুষ কবরে আশ্রয় নিয়েছে। কচুপাতা ও অন্যান্য লতাপাতায় আচ্ছাদিত একটা খালি কবর দেখে আমি ইতস্তত করি এই ভেবে যে কবরে বিষাক্ত সাপ ও পোকামাকড় থাকতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা তো আরও বেশি হিংস্র। কচুপাতা সরিয়ে আমরা কবরে আশ্রয় নিই। বাইরে গুলির আওয়াজ ও ঘরবাড়ি পোড়ার ধোঁয়া দেখতে পেলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা পর গুলির আওয়াজ শেষ হলে কবর থেকে একে একে মানুষ উঠতে দেখে আমরাও উঠে গেলাম। সে এক পরাবাস্তব দৃশ্য। দেখি, মসজিদের সামনে মানুষের জটলা। একটা লোক আমার স্ত্রীর কাদামাখা শাড়ি দেখে আমাদের তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেল এবং আমাকে একটা লুঙ্গি ও আমার স্ত্রীকে একটা শাড়ি দিল। পরে লোকটা একটা নৌকা এনে আমাদের কামরাঙ্গীরচর হয়ে নবাবগঞ্জে পৌঁছে দিল।'
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থে ৩ এপ্রিল ১৯৭১ এর ডায়েরি লিখেছিলেন এভাবে যে, 'মর্নিং নিউজ- এর একটা হেডলাইনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। অ্যাকশন এগেইনস্ট মিসক্রিয়ান্টস অ্যাট জিঞ্জিরা- জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
গতকাল থেকে লোকের মুখে মুখে যে আশঙ্কার কথাই ছড়াচ্ছিল, সেটা তাহলে সত্যি? ক'দিন ধরে ঢাকার লোক পালিয়ে জিঞ্জিরায় গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিল। গতকাল সকাল আর্মি সেখানে কামান নিয়ে গিয়ে গোলাবর্ষণ করেছে। বহু লোক মারা গেছে।
খবরটা আমরা গতকাল শুনি রফিকের কাছে। ধানমন্ডির তিন নম্বর রাস্তায় ওয়াহিদের বাসা থেকে রফিক প্রায়ই হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসে। নিউ মার্কেটে বাজার করতে এলে মাঝে মাঝে ঢুঁ মারে। শরীফের সঙ্গে বসে বসে নিচু গলায় পরস্পরের শোনা খবর বিনিময় করে।
রফিকের মুখে শোনার পর যাকেই ফোন করি বা যার সঙ্গেই দেখা হয়- তাঁর মুখে জিঞ্জিরার কথা।
সবার মুখ শুকনো, কিন্তু কেউই কোন খবরের সমর্থন দিতে পারে না। আজ মর্নিং নিউজ অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে সেটার সমর্থন দিয়েছে। খবর লেখা হয়েছে। দুষ্কৃতিকারীরা দেশের ভিতরে শান্তিপূর্ণ নাগরিকদের হয়রান করছে। বুড়িগঙ্গার দক্ষিণে জিঞ্জিরায় সম্মিলিত এরকম দুষ্কৃতিকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এরা শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছিল। এলাকাটি দুষ্কৃতকারী মুক্ত করা হয়েছে।
দুপুরের পর রঞ্জু এলো বিষণ্ণ গম্ভীর মুখে। এমনিতে হাসিখুশি টগবগে তরুণ। আজ সেও স্তম্ভিত। সোফাতে বসেই বললো 'উঃ ফুপু আম্মা। কী যেন সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটেছে জিঞ্জিরাতে। কচি বাচ্চা, থুড়থুড়ে বুড়ো কাউকে রেহাই দেয়নি জল্লাদরা। কী করে পারলো?'
আমি বললাম, 'কেন পারবে না? গত কদিনে ঢাকায় যা করেছে তা থেকে বুঝতে পার না যে ওরা সব পারে?'
'ফুফু আম্মা আমার এক কলিগ ওখানে পালিয়েছিল সবাইকে নিয়ে। সে আজ একা ফিরে এসেছে- একবারে বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে। তাঁর বুড়ো মা, বউ, তিন বাচ্চা, ছোট এক ভাই স-ব মারা গেছে।'
'সে সকালবেলা নাস্তা কিনতে একটু দূরে গিয়েছিল বলে নিজে বেঁচে গেছে। কিন্তু এখন সে বুক-মাথা চাপড়ে কেঁদে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর বলছে, সে কেন বাঁচলো? উঃ ফুফু আম্মা চোখে দেখা যায় না তাঁর কষ্ট।'
আরেকটি বর্ণনা পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর ৭১ এর দশ মাস গ্রন্থে। তিনি লিখেছিলেন, 'পাক সেনাবাহিনীর জিঞ্জিরা অপারেশনের কোনো তুলনা নেই সমকালীন বিশ্বে। মিলিটারিরা সেদিন জিঞ্জিরা ও বড়িশুর বাজারটি জ্বালিয়ে দেয়। চুনকুটিয়া-শুভাড্যা ধরে বড়িশুর পর্যন্ত পাঁচ থেকে সাত মাইল এলাকা মিলিটারি ঘিরে ফেলে এবং নারী শিশু নির্বিচারে যাকে হাটের কাছে পেয়েছে তাকেই গুলি করে মেরেছে। নারীদের চরমভাবে লাঞ্ছিত করেছে। কয়েকজন কলেজ ছাত্রীকে অপহরণ করেছে। সকাল পাঁচটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত চলে এই হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নি সংযোগের মতো চরম বর্বরতা।'
কেন এই অপারেশন জিঞ্জিরা?
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত গণহত্যাগুলোর একটি 'অপারেশন জিঞ্জিরা'। ২৫ মার্চের পর পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যার পর ঢাকা শহরের বেঁচে যাওয়া মানুষ প্রাণের ভয়ে পালানোর স্থান ও প্রথম নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত জিঞ্জিরার দিকে যাত্রা করেছিল।
জিঞ্জিরা ও এর আশেপাশের এলাকাগুলো ছিল তখন প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। তাই সেগুলো আগে থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী চিহ্নিত করে রেখেছিল। এই জিঞ্জিরা দিয়েই তাজউদ্দীন আহমেদসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা ঢাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন। এই জিঞ্জিরা ছিল পুরোদস্তুর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ঘাঁটি।
অন্যদিকে, পাকিস্তানি গোয়েন্দারা সংবাদ পেয়েছিল জিঞ্জিরাতে হানাদারদের বিরুদ্ধে গোপনে সংগঠিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা। তাই পাকিস্তানিদের মূল লক্ষ্য ছিল জিঞ্জিরা আক্রমণ।
২৫ মার্চের পর ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া সবাই কেরানীগঞ্জের দিকে জড়ো হতে থাকেন। কেরানীগঞ্জ হয়েই গ্রামের দিকে যাওয়া শুরু করেছিলেন তারা। কারণ ঢাকার অন্য এলাকায় সার্বক্ষণিক মিলিটারিদের টহল ছিল। এই এলাকা কিছুটা ঝুঁকিমুক্ত ছিল বলে সবাই এখানেই জড়ো হয়েছিলেন। কেউ বা চলে গিয়েছিলেন নিজ নিজ গ্রামের বাড়ি। ঠিক তখনই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি চালায় যেন কেউ পালাতে গিয়ে মারা পড়ে। তবে পহেলা এপ্রিলেই কেরানীগঞ্জের মানুষ কিছুটা অনুমান করতে পেরেছিলেন সেখানেও কিছু একটা হতে যাচ্ছে।
এই নির্মম-ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরদিনই পাকিস্তানি শাসকেরা মিথ্যাচার চালায় গোটা বিশ্বজুড়ে। ৩ এপ্রিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজের এক সংবাদের শিরোনাম ছিল: Action against miscreants at Jinjira অর্থাৎ 'জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ'।
তৎকালীন পিটিভি (পাকিস্তান টেলিভিশন) ঐ দিন ২ এপ্রিল রাতে সংবাদ প্রচার করে, 'বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতিকারীদের কঠোর হাতে নির্মূল করা হয়েছে।'
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড (পৃষ্ঠা ৩৭৬-৩৭৮)
জিঞ্জিরা জেনোসাইড ১৯৭১/ নির্মলেন্দু গুণ
দৈনিক বাংলা: ১৩ নভেম্বর, ১৯৭২
জিঞ্জিরা গণহত্যা ও আমার সর্বনাশ/ আবদুল হান্নান
৩ এপ্রিল শনিবার ১৯৭১; একাত্তরের দিনগুলি/ জাহানারা ইমাম
৭১ এর দশ মাস/ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
Comments