ফরিদপুরে ত্রাসের রাজত্ব
তাদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভয়।
গত বছর গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত দরপত্রের কারসাজি, চাঁদাবাজি এবং ভূমি দখলের মাধ্যমে জেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই সাজ্জাদ হোসেন বরকত এবং ইমতিয়াজ হাসান রুবেল।
দুই ভাই মিলে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন এবং এদের কাজে বাধা দিলে নির্যাতনের শিকার হতে হতো।
অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছোট ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর ও মোশাররফের সহকারী ব্যক্তিগত সচিব এ এইচ এম ফুয়াদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় এই সিন্ডিকেটটি কারসাজির মাধ্যমে জেলার সব দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করতেন।
স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে এরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদেরও ছাড় দিতেন না।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি তৌফিক হাসান এমন একজন ঠিকাদার যিনি এই দুই ভাইয়ের রোষানলে পড়েছিলেন।
জেলার নিবন্ধিত ঠিকাদার হিসেবে ২০১৮ সালে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের তিনটি দালান মেরামত কাজের জন্য দরপত্র জমা দিয়েছিলেন তৌফিক।
তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তরের সঙ্গে সর্বমোট ১৫ লাখ টাকার কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু বিষয়টি বরকত-রুবেল সিন্ডিকেটের পছন্দ হয়নি। তৌফিককে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়।
তৌফিক জানান, ২০১৮ সালের ২৪ মে তাকে বরকত-রুবেলের লোকেরা নির্দয়ভাবে পেটান এবং একটি হত্যা মামলায় তাকে মিথ্যা আসামি করে ফাঁসিয়ে দেন।
সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘আমার একমাত্র দোষ ছিল— আমি তাদের কমিশন না দিয়েই দরপত্র জমা দিয়েছিলাম। জেলায় তাদের কমিশন না দিয়ে কেউ দরপত্র জমা দিতে পারেন না, আমি অলিখিত এই নিয়মটি ভঙ্গ করেছিলাম।’
সিআইডির তদন্তে বের হয়ে এসেছে, সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত, এলজিইডি, স্বাস্থ্য বিভাগ, বিআরটিএ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও মেডিকেল কলেজের সব দরপত্রে নিয়ন্ত্রণ ছিল বরকত-রুবেল সিন্ডিকেটের।
বিভিন্ন হাট-বাজারসহ জেলা ভূমি রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে তারা কমিশন নিতো। চাঁদা তুলতো পরিবহন থেকেও।
গত বছর বরকত ও রুবেলের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অর্থপাচারের মামলার অভিযোগপত্রে সিআইডি উল্লেখ করেছে, বাবর ও ফুয়াদের নিরাপদ আশ্রয়ে সিন্ডিকেটটি হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেছে।
ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আলিম হায়দার তুহিন বলেন, ‘তাদেরকে কমিশন না দিয়ে কারও পক্ষে কোনো কাজ করা সম্ভব ছিল না।’
তবে এই দুই ভাই গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে গেছে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক ও সহায়তাকারীরা চাপের মধ্যে পড়েছেন।
এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হোসেন জানান, বরকত ও রুবেল গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে ঠিকাদারের সংখ্যা এবং দরপত্র জমা দেওয়ার হার অনেক বেড়েছে। এই দুই ভাইকে দেওয়া ৪১টি কার্যাদেশও বাতিল করা হয়েছে।
২০২০ সালের ১৬ মে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলার অভিযোগে ৭ জুন ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বরকত ও ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি রুবল গ্রেপ্তার হন। তাদের সঙ্গে আরও পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একই বছরের ২৬ জুন এই দুই ভাইসহ অন্যদের বিরুদ্ধে সিআইডির পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ রাজধানীর কাফরুল থানায় অর্থপাচার আইনে একটি মামলা করেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির বাড়িতে হামলার পর থেকেই ঘটনার মোড় ঘুরে যায়।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, বরকত-রুবেলসহ ১০ আসামির নিজস্ব জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট এবং ব্যক্তিগত যানবাহন রয়েছে।
স্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বরাতে জানা গেছে, তারা গত এক দশকে দরপত্রের কারসাজি, জমি দখল, তদবির বাণিজ্য, চাঁদাবাজি এবং কমিশন বাণিজ্য করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
অভিযোগপত্রে উল্লিখিত বাকি আট আসামির মধ্যে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বাবর ও ফরিদপুর জেলা যুব লীগের সাবেক আহ্বায়ক ফুয়াদের নাম আছে।
বাবরের উত্থান
স্থানীয় নেতারা জানান, অর্থপাচার মামলার তৃতীয় আসামি বাবর (৬৩) আগে কখনোই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তার ভাই মোশাররফ ২০০৯ সালে মন্ত্রী হওয়ার পর কার্যত পুরো ফরিদপুর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ তার হাতে চলে আসে।
রুবেল তার জবানবন্দিতে বাবরকে ‘বাবর চাচা’ সম্বোধন করে বলেন, ‘জেলা কাউন্সিল মিলনায়তন নির্মাণের কাজটি পেতে বাবর চাচাকে আমার এক কোটি টাকা দিতে হয়েছে।’
সিআইডির তদন্তকারীরা জানান, জবানবন্দিতে রুবেল আরও স্বীকার করেন যে, উপজেলা প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ কাজের ৪০ লাখ এবং পাট গবেষণা বাজার নির্মাণের জন্য আরও ৪০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন বাবর।
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিপুল ঘোষ জানান, ২০০৯ থেকে ফরিদপুরে চলতে থাকা জমি দখলের এবং লুটপাটের মতো ঘটনাগুলোর জন্য মূলত বাবরই দায়ী।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় বাবর একটি ৫০ সিসি মোটরসাইকেল চালাতেন। কাজ করেছেন বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে। পরবর্তীতে তিনি ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন, যা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে বলে জানান স্থানীয় কয়েকজন নেতা।
নির্বাচনের আগে বাবর ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ২০০৮ সালে তিনি ফরিদপুরে ফিরে আসেন এবং পৈত্রিক জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একটি পোলট্রি ফার্মের কাজ শুরু করেন।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফরিদপুর শহরে পাঁচ একর জমির ওপর প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ করে প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করেছেন বাবর। ফরিদপুর শহর ও আশপাশের এলাকায় বাবরের প্রচুর সম্পত্তি আছে বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সিআইডি সূত্র জানায়, বাবরের অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি এবং সিঙ্গাপুরে ব্যবসা আছে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ তিনি এই দুই দেশসহ অন্যান্য দেশে পাঠিয়েছেন।
ফোন না ধরা এবং মেসেজের উত্তর না দেওয়ায় এ বিষয়ে বাবরের বক্তব্য জানতে পারেনি দ্য ডেইলি স্টার।
গত ৩ মার্চ ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন এসব অভিযোগের বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তারা কীভাবে এতো টাকা বানিয়েছে সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। তারা দরপত্রের মাধ্যমে কার্যাদেশ পেত। আমি তাদেরকে কোনো কাজ দিইনি, কারণ এটি একজন সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। এটি সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব।’
দরপত্রের কারসাজি এবং চাঁদাবাজিতে অভিযুক্ত ভাইয়ের বিষয়ে তিনি জানান, বাবর কোনো ডকুমেন্টে সাক্ষর করেননি এবং তিনি এ ধরনের কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত নন।
ফুয়াদের ‘হেলমেট বাহিনী’
খন্দকার মোশাররফের ব্যক্তিগত সহকারী এ এইচ এম ফুয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, গণস্বাস্থ্য প্রকৌশল এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর থেকে কার্যাদেশ এনে দেওয়ার বিনিময়ে ১৫ শতাংশ হারে কমিশন আদায় করতেন।
যারা তার বিরুদ্ধে বলতেন কিংবা তার অনুমতি না নিয়ে বা তাকে কমিশন না দিয়ে দরপত্র জমা দিতেন, তাদেরকে তিনি তার ‘হেলমেট বাহিনীর’ মাধ্যমে শাস্তি দিতেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানা যায়, ফরিদপুর শহরের চরকমলপুর এলাকার সুমন টাওয়ারে তার পাঁচটি ফ্ল্যাট, ঝিলটুলী মহল্লার জামান টাওয়ারের ১০ ও ১১ তলায় দুটি ফ্ল্যাট, রাজধানীর ধানমন্ডি ও সিদ্ধেশ্বরীতে আরও দুটি ফ্ল্যাট আছে। এ ছাড়াও, ফরিদপুরে তার আছে বিপুল পরিমাণ জমি।
ফুয়াদের ফোন বন্ধ থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
অন্য আসামিরা
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে অভিযোগপত্রে উল্লেখিত ১০ আসামির কারও কোনো উল্লেখযোগ্য সম্পত্তি ছিল না।
খন্দকার মোশাররফ মন্ত্রী হওয়ার পর ফরিদপুর জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি খন্দকার নাজমুল ইসলাম লেভি ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন।
তিনি বরকত, রুবেল ও ফুয়াদের সিন্ডিকেটের সঙ্গে মিলে দরপত্র কারসাজি এবং জমি দখলে জড়িয়ে পড়েন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফরিদপুর শহরে লেভির একাধিক ফ্ল্যাট এবং একটি বড় প্লট আছে। ঢাকায় তিনটি বাড়ি এবং গজারিয়া হাটের ইজারা তার নামে আছে।
এ ছাড়া, খন্দকার মোশাররফের মিছিল ও সমাবেশে অংশ নিতেন ফরিদপুর শহর যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান ফারহান ও ফরিদপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ফাহাদ বিন ওয়াজেদ ফাহিম।
এই তিন জনের মধ্যে লেভি এবং ফাহিম বর্তমানে কারাগারে আছেন।
ঢাকার মিরপুরে ফারহানের চারটি ফ্ল্যাট এবং ফরিদপুর শহরের বাখুন্দা এলাকায় ছয় একর জমি আছে। গোয়েন্দা রিপোর্ট আরও জানায় যে, তিনি শহরে একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টও চালান।
ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার দক্ষিণে পৌরসভা থেকে ইজারা নেওয়া জমিতে তিনি একটি দোতলা বাড়ি তুলেছেন।
ফরিদপুর শহরে ফাহিমের অন্তত পাঁচটি ফ্ল্যাট আছে এবং ডিজিটাল প্রেস ও ফাহিমা কনস্ট্রাকশন নামে দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরও মালিক তিনি।
স্থানীয়দের ভাষ্য এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, সিন্ডিকেটের নেতারা ফাহিমকে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থা, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দরপত্র নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
অভিযোগপত্রে উল্লেখিত আসামিদের মধ্যে আরও আছেন, ফরিদপুর শহর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক কামরুল হাসান ডেভিড, জেলা যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক মোহাম্মদ আলী মিনার এবং ফরিদপুর শহর যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক তারিকুল ইসলাম ওরফে নাসিম।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এই তিন জনই ফুয়াদের ‘হেলমেট বাহিনীর’ সদস্য ছিলেন। তাদের কাজ ছিল বিভিন্ন সরকারি অধিদপ্তরে রাখা দরপত্রের বাক্সগুলোকে পাহারা দেওয়া এবং তাদের নিজেদের লোক ছাড়া অন্য কাউকে দরপত্র জমা দেওয়া থেকে বিরত রাখা।
ফুয়াদের নির্দেশে তারা তাদের সমালোচক এবং প্রতিপক্ষদের কুপিয়ে কিংবা মারধর করে নিরস্ত করতেন। তাদের সম্পদের পরিমাণ স্থানীয় সূত্র থেকে জানা যায়নি। তবে অভিযোগপত্রে সিআইডি উল্লেখ করেছে যে, তারা বরকত ও রুবেলের অবৈধ পথে অর্জিত টাকার ভাগ পেতেন।
অভিযোগপত্রে উল্লিখিত এই ১০ আসামি ছাড়াও সিআইডি আরও ৪২ জনের নাম পেয়েছে, যারা বিভিন্নভাবে এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। তবে যথাযথ তথ্য-প্রমাণের অভাবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়নি।
একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, তাদের বিরুদ্ধে এখনো তদন্ত চলছে এবং কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।
Comments