আবার লকডাউন: এবার দায় দেবো কাকে?
বছরখানেক বাদে আবার দেশে লকডাউন দেওয়ার মতো পরিস্থিতি এসেছে। প্রাথমিক ধাক্কার পরে করোনার সংক্রমণ কম ছিলো। এক পর্যায়ে মাস তিনেক আগে পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার তিন শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছিলো। গত সপ্তাহখানেক ধরে সেই হার ঊর্ধ্বমুখী, বিশ শতাংশের বেশি। একইসঙ্গে ঊর্ধ্বমুখী করোনা আক্রান্ত মানুষ শনাক্তের সংখ্যা ও করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা।
এটা যেহেতু মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়, মানুষে-মানুষে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা গেলে এই সংক্রমণের ঝুঁকি কমে। আর তার চূড়ান্ত উপায় মানুষকে ঘরবন্দি করে ফেলা। সব মানুষের ঘরকে ‘লকআপ’-এ পরিণত করার নাম ‘লকডাউন’। সেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথাই সরকার আজ আবার ঘোষণা করলো।
অথচ করোনা সংক্রমণ রোধের জন্য পালনীয় স্বাস্থ্যবিধি সহজ ছিলো। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজ করা আর একে অপরের থেকে অন্তত তিন ফুট দূরে থাকা। মাস্ক পরা না থাকলে হাঁচি-কাশির সময় রুমাল ব্যবহার বা কনুইয়ের ভাঁজে মুখ নিয়ে হাঁচি-কাশি দেওয়া। আর ‘খুব দরকার নেই’ বা ‘না করলেও চলে’ এমন কোনো কাজে অন্যের কাছাকাছি না যাওয়া।
প্রথমদিকে তাও যতটা ছিলো, পরে যেনো মানুষের ভয় ভেঙে গেলো। এখন লকডাউনের মতো চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে সরকারকে। অনেকেই আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখতে শুরু করেছেন, লকডাউনে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় উপার্জনের কী হবে? তারা কীভাবে দিনযাপন করবেন? সার্বিক পরিস্থিতির জন্য তারা সরকারকে দুষছেন।
সরকারের তথা রাষ্ট্রের ঘাড়ে দোষ দেওয়া খুবই সহজ। সবকিছুর একটা সার্বিক দায় তো রাষ্ট্রের আছেই। সুতরাং রাষ্ট্র (এবং সেই যন্ত্র পরিচালনাকারীরা, যাদের আমরা সরকার বলি) দায় এড়াতে পারে না। কিন্তু সংক্রামক ব্যাধির মতো একটি ব্যাপারে রাষ্ট্র বা সরকারের সেই দায় একক নয়। সেই প্রসঙ্গে কথা বলার আগে নিজেদের দিকে একটু তাকাই। গত কয়েক মাসে আমাদের নিজেদের আচরণ করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে কেমন ভূমিকা রেখে থাকতে পারে সেটা একটু দেখি।
গত কয়েক মাসে করোনার সংক্রমণ বাড়ানোর জন্যে আমরা কী না করেছি সবাই মিলে। রাস্তাঘাটে মাস্ক পড়ার বালাই নেই, হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজ করার চর্চায় ভাটা, সামাজিক দূরত্ব নামের তিন ফুটের শারীরিক দূরত্ব না মানার প্রবণতা ছিল।
লেখাপড়া জানা মানুষের মেলা, বইমেলা। বইমেলার যেসব ছবি টিভিতে বিকেলের লাইভে দেখি সেখানেও খুব ব্যতিক্রম নেই। অথচ স্টলে ডিসপ্লে করে রাখা বইগুলোতে কত মানুষ হাত দিয়ে যাচ্ছে একজনের পরে আরেকজন। সবার হাত তো স্যানিটাইজ করা না।
মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। সিগারেট বিক্রেতা যে হাত দিয়ে ক্রেতার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন (টাকাটা অনেক হাত ঘুরে এসেছে ইতোমধ্যে) সেই হাত দিয়েই তো সিগারেটের ফিল্টারটি ধরে ক্রেতাকে দিচ্ছেন। ক্রেতা সেটা মুখে দিয়ে টানছেন। সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এরকম একটা আচরণ করার পরে আপনি হাত স্যানিটাইজ করে মুখে মাস্ক পরে চলে এলেন। আপনি নিরাপদ থাকলেন?
অথবা চা খেলেন। একজন চা খাওয়ার পরে ‘কোনোরকমে’ ধোয়া কাপটিতে আপনি চা খাচ্ছেন। দিনের মধ্যে অসংখ্য ক্রেতা এই একই কাপে ‘কোনোরকমে’ ধোয়ার পরে চা খাচ্ছেন। দোকানদার একের পর এক ক্রেতাকে চা-সিগারেট দিচ্ছেন। হাত ধুচ্ছেন না। তার মুখে মাস্কও নেই। ঝুঁকিতে ফেললেন না নিজেকে?
গণপরিবহনে গাদাগাদি করে উঠলেন (বলতে পারেন, বাসের সংখ্যা কম, করবো কী), মাস্কটা তো সবাই পড়তে পারতেন। হেল্পারের কাছে তো হাত স্যানিটাইজ করার স্প্রে থাকতে পারতো। যেটা দিয়ে হাত না ভিজিয়ে কেউ বাসে উঠবে না, আবার নামার সময়ও হাতে স্প্রে করা হবে। যাত্রীর পকেটে স্যানিটাইজার থাকলে তো কথাই নেই। এসব আমরা মানিনি।
করোনা একটু কমতেই পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে বার্ষিক ছুটির সময়ের মতো ভিড় লেগে গেলো। কক্সবাজারের এমন অবস্থা হলো যে স্থানীয় প্রশাসন যত আন্তরিকই থাকুক, লাখো মানুষের ওই ভিড়ে সংক্রমণ ঠেকানোর ব্যবস্থা নেওয়া তাদের সাধ্যের বাইরে চলে গেলো। অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রেরও একই অবস্থা। বাদ গেলো না কিশোরগঞ্জের সূর্যমুখীর খেতও।
সেফটি প্রিকশনস নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সেফটি প্র্যাকটিস সবচেয়ে বড় ব্যাপার। সেটা নিজেকেই করতে হয়। তা না হলে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা কোনো কাজে আসে না। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ নিজের নিরাপত্তার জন্য সচেষ্ট না হবে ততক্ষণ অন্য কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
এবার আসি সরকারি ব্যবস্থায়। দীর্ঘ অব্যবস্থাপনায় অতি দুর্বল হয়ে পড়া স্বাস্থ্য অবকাঠামো নিয়ে সরকার ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সঙ্গে জড়িতরা যা করেছেন, তা অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
ডাক্তার বা নার্সকে বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছেন না বাড়িওয়ালা, করোনায় মৃত মানুষের মরদেহ দাফনে বাধা দেওয়া হচ্ছে, করোনা রোগী আছে জানতে পারলে সেই বাড়িকে মোটামুটি অচ্ছ্যুৎ করে ফেলা, এমনকি অত্যাবশ্যকীয় সেবা গ্রহণে বাধা দেওয়া, সবই করেছে এই সমাজের কিছু মানুষ।
এইসবের মধ্যে কাজ করেছেন স্বাস্থ্যসেবাদানের সঙ্গে জড়িতরা। লক্ষণ লুকিয়ে ডাক্তার বা নার্সকে সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলার খবরও পত্রিকায় এসেছে। স্বাস্থ্যসেবাদানের সঙ্গে জড়িত অনেকে জীবন দিয়েছেন।
তারপর করোনা যখন একটু কমলো তখন সামাজিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন ধরনের জনসমাগম শুরু হলো। সরকারের নির্দেশনা ছিলো এসব না করার বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে করার। কিন্তু এসবের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। ফলত যা হওয়ার তাই হলো। মানুষ ‘এখনই না করলেও চলে’ এমন সব আয়োজন করতে শুরু করলো। বন্ধুদের আড্ডা, পুনর্মিলনী, জন্মদিন, বিশাল আকারে বিয়ের অনুষ্ঠান ইত্যাদি ইত্যাদি। যেখানে আসতে ৫০ জন মানুষ ৫০টি যানবাহন ব্যাবহার করেছেন– বাস, রিকশা, সিএনজি, গাড়ি যাই হোক। সেই বাহনটিতে ওইদিন আরও ৫০ জন উঠেছেন, প্রত্যেকটা অতিথিও তার আগের দিন বিভিন্ন জায়গায় গেছেন, বিভিন্নজনের সঙ্গে মিশেছেন।
করোনা একটু কমতে না কমতেই একের পর এক সরকারি অনুষ্ঠান শুরু হলো। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ– উৎসব তো হবেই। সরকার অনেক আনুষ্ঠানিকতা স্থগিত করেছিলো, পিছিয়ে দিয়েছিলো। করোনা একটু কমতেই যেনো ‘আর কোনো ভয় নেই’ টাইপের মানসিকতা নিয়ে আমরা আবার লাফিয়ে পড়লাম একের পর এক আয়োজনে।
জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানমালায় স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারটি প্রশ্নাতীত ছিলো সন্দেহ নেই। কিন্তু অন্যগুলোতে? কয়েকশো মানুষের ম্যারাথন বলেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের রিহার্সাল বলেন, উদ্যানে, লেকের ধারে ওপেন এয়ার কনসার্ট বলেন, সবকিছুতে একই মানের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক সাবধানতা মানা হয়েছিলো? টিভিতে কনসার্টের কভারেজ দেখে তো তা মনে হয় না।
সদ্য শুরু হয়েছে বাংলাদেশ গেমস। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সব খেলোয়াড় ও অন্যান্য কর্মীদের করোনা পরীক্ষা করে (করোনা নেগেটিভ নিশ্চিত করে) তারপর অন্য সবার থেকে একবারে আলাদা করে ফেলা হয়েছে এবং গেমস চলাকালীন সময়ে শুধু তাদের মধ্যেই ইন্টার্যাকশন হবে এরকম ব্যবস্থা নেওয়ার খবর দেখিনি।
এমনিতেই গা না করা মানুষ সরকারি আয়োজনগুলো দেখে আরও উৎসাহিত হয়েছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পর্যায়ে বিভিন্ন আয়োজন করতে। কারণ সরকারের তখন জোর করে অন্যকে নির্দেশনা মানানোর নৈতিক জোর থাকে না।
এসবের মধ্য দিয়ে করোনার টিকার ক্ষেত্রে সরকারের যে ব্যাপক সাফল্য সেটা একটু হলেও ম্লান হয়ে গেছে। টিকা নিয়ে তো অঘোষিত যুদ্ধই চলছে পৃথিবীতে। এর মধ্যেই একেবারে শুরুর দিকে যে কয়েকটি দেশ করোনার টিকা দেওয়া শুরু করতে পেরেছে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। সরকারের এই সাফল্যের চূড়ান্ত ফলাফল হওয়ার কথা করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়া। তার জন্য ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সরকার সবাইকেই সচেষ্ট থাকতে হবে।
শেষ করি করোনার শুরুর দিকে কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত একজন বাংলাদেশির একটি ফেসবুক পোস্টের কথা বলে। করোনা শুরুর পরে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা শিক্ষার্থীরা নিজ দেশে ফিরতে শুরু করলেন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘চীনে তো অবস্থা সবচেয়ে খারাপ (তখন পর্যন্ত), তোমরা সেখানে ফিরে যাচ্ছো কেন?’ তাদের নাকি কমন উত্তর ছিলো, ‘করোনার যে গতি-প্রকৃতি দেখছি, তাতে সারাবিশ্বে এটা ছড়াবে। চীন জোর করে মানুষকে নির্দেশনা মানিয়ে এটা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলবে। তোমরা (কানাডা) পারবে না। তোমাদের বিভিন্ন রাইটস আছে, এটা আছে, ওটা আছে। সেসবের দিকে খেয়াল রাখতে হয়।’
বাস্তবে হয়েছেও তাই।
বাংলাদেশ সরকারও আজ লকডাউন বিষয়ক যে নির্দেশাবলী দিয়েছে সেখানে এই কথারই প্রতিফলন দেখি, ‘আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’।
সরকারের দিক থেকে এই কঠোরতা আর জনগণের দিক থেকে সচেতনতা দুইয়ে মিলে আমাদের সবার সুরক্ষা নিশ্চিত হোক।
তাপস বড়ুয়া, প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর, এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ (ইটিআই); গার্মেন্টস সেক্টরে কোভিড রেসপন্স প্রজেক্টে কাজ করছেন।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments