করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে পদ্মাপাড়ি
রোববার সকাল সাড়ে ৯টায় মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে যানবাহনের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল একটি পিকআপ। গাড়িতে বাড়ির মালামালের সঙ্গে ছিলেন একই পরিবারের আট সদস্য।
দুই ভাই অটোচালক মো. মুসলিম ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পিয়ন মো. সাত্তার হোসেনের পরিবার পদ্মাপার হতে ফেরির অপেক্ষায়। নতুন বিধি-নিষেধের কারণে তারা ঢাকা স্থায়ীভাবে ঢাকা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সাত্তারের স্ত্রী রুজিনা আক্তার ও মুসলিমের স্ত্রী মরিয়ম গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। শাশুড়িসহ রুজিনার এক ছেলে ও মরিয়মের এক ছেলে ও এক মেয়েও আছে সঙ্গে। সবার গন্তব্য শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলা। সেখানে তারা নতুনভাবে সংসার শুরু করবেন।
মো. সাত্তার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘২২ বছর ধরে ঢাকায় বসবাস করছিলাম। দুই পরিবারের নয়জন সদস্যের মধ্যে চারজন উপার্জনক্ষম ছিলাম। সরকারের নতুন বিধি-নিষেধের কারণে ঢাকায় টিকে থাকা এখন সম্ভব না। সবাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। পরিবারে তিনজন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তায়। এমন পরিস্থিতিতে নিজ গ্রামে গিয়ে সেখানে দিনমজুরের কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সরকার সাত দিনের বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। তখন আমাদের জন্য শহরে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়াঘাটে রবিবার ভোর থেকে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। লঞ্চঘাটে যাওয়ার প্রবেশপথে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন ছিল সারাদিন। গায়ে গা ঘেঁষে দীর্ঘসময় যাবত অপেক্ষা করতে হয়েছে যাত্রীদের। বেশিরভাগ যাত্রী মাস্ক পরেননি। ৩-৪টি লঞ্চ ঘাটে আসলে টার্মিনালে পা রাখার জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটের ৮৭টি লঞ্চে উভয়মুখী যাত্রীদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। ঘাট কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি না মানায় মাইকিং করা হলেও অনেক যাত্রী তাতে কর্ণপাত করেননি।
আজ ভোর থেকে নৌরুটে পদ্মা পারের জন্য ১৫টি ফেরি চলাচল করেছে। তবে ফেরি পারের অপেক্ষায় যাত্রীদের চাপ দুপুর পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। বিকাল ৪টায় পারের অপেক্ষায় যানবাহনের সংখ্যা কম ছিল। তবে, তিন শতাধিক পণ্যবাহী যানবাহন পারের অপেক্ষায় থাকলেও যাত্রীবাহী যানবাহনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে ঘাট কর্তৃপক্ষ।
লঞ্চঘাটের যাত্রী সেলিম হোসেন জানান, সকাল ৮টায় ঢাকার মিরপুর থেকে রওনা দিয়েছিলাম। শিমুলিয়া ঘাট এসেছি বিকাল ৩টার দিকে। লঞ্চঘাটে এসে দেখি যাত্রীদের অনেক ভিড়। ঢাকায় শ্রমিক হিসাবে কাজ করছিলাম। কিন্তু, বন্ধের খবর পেয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছি।
লঞ্চযাত্রী আকলিমা বলেন, ‘ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় গৃহকর্মীর কাজ করতাম। কিন্তু, মালিক এক মাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়ে গ্রামে চলে যেতে বলেছেন। সোমবার থেকে নৌযান বন্ধ থাকবে তাই দেরি না করে বাড়িতে চলে যাচ্ছি। সকাল ৬টায় রওনা দিয়ে শিমুলিয়া ঘাটে এসেছি ১১টায়। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি।’
বরিশালগামী যাত্রী আওলাদ হোসেন জানান, সরকার যদি বিধি-নিষেধ আরোপের মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ মোকাবিলা করতে চায়, তবে সে সিদ্ধান্ত অনেক আগে নেওয়া উচিত ছিল। দুইদিন সময় দিয়ে আমাদের বিপদে ফেলেছে। এখন নৌযানগুলোতে যেভাবে যাত্রীরা যাচ্ছেন, তাতে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
আরেক যাত্রী মো. আদনান হোসেন বলেন, ‘ঢাকার একটি রেস্টুরেন্ট কাজ করছিলাম। বন্ধের কারণে নিজ জেলা ফরিদপুরে চলে যাচ্ছি। ঢাকার বাসাবো থেকে সকাল ৮টায় রওনা দিয়ে শিমুলিয়াঘাটে এসেছি সকাল সাড়ে ১১টায়। লঞ্চঘাটে এসে দেখি অনেক মানুষের ভিড়। বাধ্য হয়ে গাদাগাদি করে গন্তব্যে যাচ্ছি। করোনার মধ্যে ঢাকায় থাকা ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ।’
বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক প্রফুল্ল চৌহান বলেন, ‘রবিবার সকাল ৬টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত শিমুলিয়াঘাট থেকে ছয় শতাধিক যাত্রীবাহী যানবাহন পার করা হয়েছে। অন্যদিকে, মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাট থেকে তুলনামূলক কম গাড়ি শিমুলিয়া ঘাটে এসেছে। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক সোমবার সকাল ৬টা থেকে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে সবধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে। মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স পারের জন্য দুইটি ফেরি চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে কোন যাত্রী বহন করা হবে না।’
বিআইডব্লিউটিএ’র শিমুলিয়াঘাটের সহকারী পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) মো. শাহাদত হোসেন বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৬টায় লঞ্চ চলাচল শুরু হয়ে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে। এরমধ্যে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে লঞ্চে পারাপার হয়েছে।’
Comments