জনবল সংকটে মুগদা হাসপাতাল, করোনা রোগীদের ভোগান্তি
সিটিস্ক্যান রিপোর্ট পেতে কত সময় লাগতে পারে? এক দিন? খুব বেশি হলে দুদিন?
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে একজন করোনা আক্রান্ত রোগী তার সিটিস্ক্যান রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছেন পাঁচ দিনেরও বেশি সময় ধরে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল মঙ্গলবার ওই রোগীর সন্তান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তিন দিন আগে আমার মা এখানে ভর্তি হন। সেদিনই তার সিটিস্ক্যান করা হয়। তখন থেকে আমরা রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসকরা বলেছেন, বৃহস্পতিবার (আগামীকাল) রিপোর্ট পাবো।’
পরীক্ষা করানোর পাঁচ দিন পর পাওয়া যাবে রিপোর্ট। অর্থাৎ, এই পাঁচ দিনে রোগীর শারীরিক অবস্থা বুঝতে পারছেন না চিকিত্সকরা। রিপোর্ট না পেলে পরবর্তী চিকিত্সা কী হতে পারে সে সিদ্ধান্তও নেওয়া যাচ্ছে না।
ওই রোগীর সন্তান বলেন, ‘আমার মা ডায়ালাইসিসের রোগী। তার অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ। গত রাতের পর থেকে তিনি উন্মাদের মতো আচরণ করছেন। তিনি ঘুমাচ্ছেন না, সন্ধ্যা থেকে অনর্গল কথা বলছেন। প্রতিবারই ডাক্তার এলে আগে পরীক্ষার রিপোর্ট দেখতে চান।’
সিটিস্ক্যান রিপোর্ট দেওয়ার জন্য রেডিওলোজী বিভাগের কেন পাঁচ দিন লাগছে জানতে চাইলে, হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. নুরুল ইসলাম সরেজমিনে বিভাগটি ঘুরিয়ে দেখান।
তিনি জানান, বর্তমানে বিভাগটিতে তিন জন অধ্যাপক ও চার থেকে পাঁচ জন মেডিকেল অফিসার আছেন। করোনা পরিস্থিতিতে পালা করে কাজ করার জন্য একটি ডিউটি রোস্টার তৈরি করা হয়েছে।
ডা. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা একটি ডিউটি রোস্টার তৈরি করেছি যাতে এটা নিশ্চিত করা যায় যে অন্তত অর্ধেক কর্মী সবসময় ডিউটিতে থাকবেন এবং বাকীরা যেন কোয়ারেন্টিনে থাকতে পারেন। বর্তমানে, দুজন ডিউটিতে আছেন।’
তাদের মধ্যে একজন রেডিওলোজিস্ট, অপরজন মেডিকেল অফিসার।
সকাল থেকে তারা ২২টি সিটি স্ক্যান এবং এর কাছাকাছি সংখ্যক এক্স-রে ও আল্ট্রাসনোগ্রামের ফিল্ম নিয়ে কাজ করেছেন। প্রতিটি ফিল্ম নিয়ে রেডিওলোজিস্টকে আলাদা আলাদাভাবে কাজ করতে হয়।
হাসপাতালের রেডিওলোজিস্ট ডা. সমাপ্তি চক্রবর্তী বলেন, ‘আমরা আজ জমে থাকা সব ফাইলের কাজ শেষ করতে পারবো না। আমি দিনে সর্বোচ্চ ১৫টি রিপোর্ট তৈরি করতে পারি।’
অন্তত আরও দুজন কর্মী থাকলে কাজের চাপ সামলানো সহজ হতো বলে জানান হাসপাতালের ল্যাবের দায়িত্বে থাকা জগন বন্ধু হালদার।
তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজেদের কোয়ারেন্টিনের জন্য সময় নেওয়ার সুযোগ নেই। নিয়ম হলো, ১৫ দিন কাজ করে কোয়ারেন্টিনের জন্য দুসপ্তাহের ছুটি নেওয়া। কোনো উপসর্গ আছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা। আমাকে প্রতিদিনই আসতে হচ্ছে, কারণ পর্যাপ্ত কর্মী নেই।’
হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ জানান, প্রায় ১৫ জন চিকিৎসক গত সপ্তাহ থেকে করোনায় আক্রান্ত। করোনায় আক্রান্ত নার্স ও ওয়ার্ড কর্মীদের সংখ্যা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।
হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগও চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
বিভাগটির ইনচার্জ বলেন, ‘আমাদের ৩৫টি ডায়ালাইসিস মেশিন আছে। তবে এর মধ্যে ১৭টিই অকেজো।’
মেশিনগুলো চালু করতে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্য প্রশাসনিক দপ্তরে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে যোগ করেন এই ইনচার্জ।
তিনি বলেন, এই হাসপাতালে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদেরও ডায়ালাইসিস করা হয়। শহরের মাত্র কয়েকটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই এই সুবিধা আছে।
হাসপাতালটিতে রোগীর চাপ অনেক বেশি। করোনা রোগীদের জন্য হাসপাতালে ৩২৯টি সাধারণ শয্যা ও ১৯টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে।
গতকাল সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিলো ৩১৬। হাসপাতালের সক্ষমতা ছাড়িয়ে দুপুরের মধ্যেই সংখ্যাটি ৩৩৫-এ পৌঁছে যায়।
ডা. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আগেই সবগুলো শয্যাতেই রোগী ছিলো। শয্যা সংখ্যা বাড়াতে কয়েকটি অতিরিক্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার ও স্ট্রেচারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে।’
কিন্তু সেটাও সীমিত।
বিকাল থেকে জরুরি ওয়ার্ডে ভর্তিচ্ছু রোগীদেরকে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, তারা অক্সিজেন পাবেন না। কেবল একটি ‘সাধারণ’ শয্যা পেতে পারেন। এই শর্ত মেনে তাদেরকে একটি বন্ডেও সই করতে বলা হয়েছে।
সীমা মনি তাদের মধ্যে একজন। তিনি করোনা পরীক্ষা করতে এসেছিলেন। কিন্তু লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। সেসময় তার সিরিয়াল নম্বর ছিলো ৮৫। জ্ঞান ফিরলে তার স্বামী তাকে কাঠের বেঞ্চে বসিয়ে রেখে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তির জন্য ছুটে যান। হাসপাতালের এক কর্মচারী তখন তাকে ওই বন্ডে সই করতে বলেন। হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন পাবেন না জানতে পেরে ভর্তি না হয়ে সেখানেই কিছুটা ভালো লাগার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন সীমা।
এরপরই হাসপাতালটিতে দুটি অ্যাম্বুলেন্স আসে রোগী নিয়ে। তাদের মধ্যে একটি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই রোগীর পরিবার জানান, তারা বন্ডে সই করেছেন। রোগীর ছেলে বলেন, ‘আমি নিজেই অক্সিজেন নিয়ে আসবো। আমার মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার।’
এদিকে, সারাদিন আইসিইউর ১৯টি শয্যার সবগুলোতেই রোগী ভর্তি ছিলো। বাড্ডা থেকে দুটি অ্যাম্বুলেন্স এসে ‘আইসিইউ বেড খালি নেই’ সাইন দেখে চলে যায়।
নূরুল ইসলাম বলেন, ‘লাইনে চার থেকে পাঁচ জন রোগী থাকা অবস্থায় আমি কীভাবে বাইরে থেকে আইসিইউ রোগীদের ভর্তির অনুমতি দেব? আজ যারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।’
তিনি জানান, গত সোমবার অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকা সবাইকে ভর্তি করতে হলে মঙ্গলবার আইসিইউ শয্যার ২৫ শতাংশ খালি হতে হবে।
করোনা পরীক্ষা করতে আসা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালটিতে অনেকেই রাত থেকেও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। মুগদা মেডিকেলের আরটি-পিসিআর মেশিনে প্রতিদিন ১৮০টি পরীক্ষা করা যায়।
সকাল ৯টায় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ইফতি খান রায়হান জানান, তিনি সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিলাম। সুস্থ হয়ে উঠেছি কিনা তা দেখতে এখানে পরীক্ষা করাতে এসেছি। বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষার খরচ আমার পক্ষে বহন করা সম্ভব না। তাই এই হাসপাতালে আসা।’
প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ফজরের নামাজের পর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন পঞ্চাশ বছর বয়সী মর্জিনা। অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালের সামনের নোংরা রাস্তার ওপর পড়ে যান তিনি। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে এলেও সেখান থেকে সরে যাওয়ার মতো শক্তি তার ছিলো না।
লাইনে থাকা অন্যরা তাকে সামনে যেতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেসব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তিনি পরীক্ষা করাতে এসেছিলেন একা।
তিনি বলেন, ‘আমার এক সপ্তাহ ধরে জ্বর, ডাক্তার করোনা পরীক্ষা করতে বলেছেন। কিন্তু আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।’
Comments