আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ অমিয় চক্রবর্তী
অমিয় চক্রবর্তী, ত্রিশের দশকে যে পাঁচ কবি রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে গিয়ে আধুনিক সাহিত্যের জন্ম দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রথমদিকে তার কবিতায় রবীন্দ্র প্রভাব থাকলেও অচিরেই কবিতায় নিজস্ব এক ধারার জন্ম দিয়েছিলেন অমিয় চক্রবর্তী।
রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে গিয়ে রচনা করলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীর ছিল আত্মার বন্ধন। আট বছর রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব ছিলেন এই কিংবদন্তি কবি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জার্মানিতে আইনস্টাইন, আমেরিকায় বার্নার্ড শ'র সঙ্গে দেখা করেছিলেন। অমিয় চক্রবর্তীর বিয়ের পাত্রীও পছন্দ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। পাত্রী হিয়োর্ডিস সিগার্ডের বাংলা নাম রবীন্দ্রনাথ রেখেছিলেন "হৈমন্তী"। ১৯৫১ সালে স্বয়ং আইনস্টাইন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাকে সাহিত্যে বিশেষ বক্তৃতার জন্য। প্রচণ্ড ভবঘুরে ছিলেন তিনি। অসংখ্য দেশ ভ্রমণ করেছেন। তাকে নির্দ্বিধায় বলা যায় বিশ্ব নাগরিক। বিশ্ববিখ্যাত বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে করেছেন অধ্যাপনা, কিন্তু এতো কিছুর বাইরে সর্বাগ্রে ঠাঁই দিয়েছেন কবিতাকে।
অমিয় চক্রবর্তীর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শ্রীরামপুরে মায়ের মামার বাড়িতে ১৯০১ সালের ১০ এপ্রিল। বাবা দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন আসামের গৌরীপুরের রাজা প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়ার দেওয়ান। তৎকালীন সময়েই দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী ইংরেজিতে এম এ এবং বি এল পাশ করেছিলেন। মা অনিন্দিতা দেবী ছিলেন সাহিত্যিক ও কবি। বঙ্গনারী ছদ্মনামে তিনি নিজে কবিতা লিখতেন, প্রবন্ধ পাঠাতেন পত্রিকায়। অনিন্দিতা দেবী সংস্কৃত জানতেন, চার সন্তানকে নিজেই বাড়িতে সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন। অনিন্দিতা দেবীর বাবা উপেন্দ্রনাথ ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক। সন্তানদের কালিদাস ভবভূতি, ভারবি'র রচিত কিরাতার্জ্জুনীয় পাঠের জন্য গৌরীপুরের সংস্কৃত টোল থেকে নামজাদা এক পণ্ডিতকে মাসিক মাইনে দিয়ে রেখেছিলেন অনিন্দিতা দেবী। এর ফলে বাংলা তো বটেই সংস্কৃতে শৈশবেই অসামান্য দখল হয়ে উঠে অমিয় চক্রবর্তীর। অমিয় চক্রবর্তীর শৈশব ও কৈশোরের অনেকটা সময় কাটে আসামের গৌরীপুর এস্টেটে বাবার চাকরির সুবাদে। ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানকার প্রতাপচন্দ্র ইন্সটিটিউশনে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। শৈশবে বেশ ছটফটে স্বভাবের ছিলেন অমিয়। খেলা থেকে শুরু করে সার্বক্ষণিক সবকিছুতেই ছিল তার চাঞ্চল্য। কিন্তু বড় ভাই অরুণ চক্রবর্তী আত্মহত্যা করলে ভাই হারানোর তীব্র শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন অমিয়। স্বভাবের চঞ্চল ভাব উধাও হয়ে যায়, অনেকটা ভাবুক ও স্বল্পবাক প্রকৃতির হয়ে উঠেন তিনি। কৈশোর থেকেই দেশ বিদেশের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের সঙ্গে পত্রালাপ জমে উঠে তার। রবীন্দ্রনাথ, রোমা রোলাঁ, জর্জ বার্নার্ড শ'র মতো বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের সঙ্গে তার পত্রালাপ তার সেই বয়সের জন্য ছিল অকল্পনীয়। শৈশবে ইংরেজি প্রবন্ধ, সাহিত্য সমালোচনা পড়তেন তিনি। তার এই মনোজগৎ গড়ার পেছনে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন তার বড় মামা নিখিলনাথ মৈত্র। তার বন্ধুস্থানীয় আরেক মামা সোমনাথ মৈত্রের কথা বলতেই হয়। তিনিই মূলত অমিয় চক্রবর্তীকে বীরবল, সবুজপত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। অমিয় চক্রবর্তী স্মৃতিকথায় লিখেছিলেনও ‘সবুজ পত্রের আসরে এবং পরে বিচিত্রার সভ্যরূপে সাহিত্যে সঙ্গীতের প্রেরণা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলো।’ এই সময় অমিয় চক্রবর্তী থাকতেন তার বড় মামা নিখিলনাথ মৈত্রের বাসায়। পড়তেন কলকাতার হেয়ার স্কুলে।
১৯১৬ সালে কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯১৮ সালে আইরিশ মিশনের সেন্ট কলাম্বাস কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করার পর একই কলেজ থেকে ইংরেজিতে সাহিত্য ও দর্শনে ১৯২১ সালে স্নাতক পাশ করেন তিনি। মাত্র ২০ বছর বয়সেই রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে জড়িয়ে পড়লেন তিনি। অথচ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার আশৈশব স্বপ্ন ছিল তার কিন্তু এক নিমেষেই যেন তা উবে গেল। বিশ্বভারতীতে চাকরির কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ সংকীর্ণ হয়ে গেল। এরপর তিনি এম. এ পরীক্ষা দিলেন বটে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র হিসেবে নয়, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাইভেট ছাত্র হিসেবে। শেষঅব্দি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ ডিগ্রি নিলেন ১৯২৬ সালে। একই বছর শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিবের দায়িত্ব পেলেন তিনি। শান্তিনিকেতনে তার কাজ ছিল বিদেশী অতিথিদের পরিচর্য করা, ক্লাস নেওয়া, রবীন্দ্রনাথকে নানা গ্রন্থ-তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করা এবং বিদেশ যাত্রার সঙ্গী হওয়া। মাত্র পনেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার পত্রালাপ এই ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীর প্রথম সাক্ষাৎ হয় প্রমথ চৌধুরীর বাড়িতে। প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীর পত্রালাপের মাধ্যমেই পরিচয় হয়েছিল। ডাকঘর নাটকে এবং পরে ফাল্গুনী নাটকে অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে অভিনেতা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম দর্শন হয় অমিয় চক্রবর্তীর। প্রমথ চৌধুরীর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে ১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। সেখানেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সূত্রপাত। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যোগাযোগ অমিয় চক্রবর্তীর জীবনের মোড় যেন ঘুরিয়ে দিলো। ১৯২৭ সালে স্থায়ীভাবে শান্তিনিকেতনে চলে এলেন অমিয় চক্রবর্তী। পরের বছর রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগেই তার বিয়ে হলো ড্যানিশ কন্যা হিয়োর্ডিস সিগার্ডের সঙ্গে। হিওর্ডিস শান্তিনিকেতনে এসছিলেন রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীর পালিতা কন্যা নন্দিনীর শিক্ষক হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ বিদেশিনী নববধূর নাম রেখেছিলেন হৈমন্তী। এ বিয়েতে কন্যা সম্প্রদান করেছিলেন চার্লস এফ অ্যান্ড্রুজ।
তিনি স্মৃতিকথায় বলেছিলেনও শান্তিনিকেতনের জীবন প্রসঙ্গে। তিনি লিখেছিলেন “একান্ত উৎসাহে ভাস্বর সেই অভিজ্ঞতা আজ পর্যন্ত আমার মানসিক অধিকারের বাইরে রয়ে গেছে। শালবীথির তপ্ত ছায়াবৃত মর্মর, ছাতিমতলার শুভ্র স্তব্ধ পাথর এবং উৎকীর্ণ মন, রবীন্দ্রনাথের গভীর বাক্যালাপ এবং অজস্র আতিথ্য, প্রমথবাবুর হাস্যকৌতুকময় প্রখর মননশীল আলোচনা ও বন্ধুত্বের অযাচিত দান একটি অপরিণত, অজ্ঞাত বাঙালি ছেলের সাহস আশা-কল্পনাকে ছাপিয়ে অপরূপ হয়ে দেখা দিয়েছিল। আজও বুকে জেগে আছে আকাশ মাঠ খোয়াইয়ের পাণ্ডুর উজ্জ্বল বলয়-চক্র, দারুণ গ্রীষ্মে উৎফুল্ল আমলকী-সারি এবং বহু দূরে পাড়-বসানো সবুজ তালতড়ি। আশ্রমেরই অভিন্ন অন্তর্গত রূপে সেই দৃষ্টি আমার কৈশোর জীবনে প্রসারিত।”
১৯২৭ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব ছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। সাহিত্য সচিব হিসেবে যে-কাজ তাকে করতে হয়েছে অমিয় চক্রবর্তী স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, “কবিতা এবং অন্যান্য সব রচনার পাণ্ডুলিপি রক্ষাভার ছিল আমার ওপরে। তা’ ছাড়া নবরচিত গানের দ্রুত কয়েকটি কপি ক’রে দিনুবাবু (দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) এবং শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণীদের হাতে তা’ বিলি করতাম।”
বারবার নিজের পাণ্ডুলিপি সংশোধন করতেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকি ছাপা হ’য়ে যাওয়ার পরও খুঁতখুঁতে রবীন্দ্রনাথ সংস্কার করতেন। এর ফলে ফর্মা ছাপা হয়ে যাওয়ার পরও বিশ্বভারতীর প্রেসে ছুটে যেতে হতো অমিয় চক্রবর্তীকে। খসড়ার পর বারবার ঘষা-মাজার অভ্যাস দাঁড়িয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের সবুজপত্রের যুগ থেকে। ফলে একই রচনা বারবার কপি করতে হতো। এই কপি করার কাজেও রবীন্দ্রনাথের সার্বক্ষণিক সঙ্গি ছিলেন অমিয় চক্রবর্তী ও হৈমন্তী। একবার রবীন্দ্রনাথের জরুরি প্রয়োজনে সারারাত জেগে তাকে ''মুক্তধারা'' নাটকের কপি তৈরি করতে হয়েছিল।
সাহিত্য সচিবের দায়িত্ব ছাড়াও পরে অবশ্য বিশ্বভারতীর প্রায় সকল কাজেই অমিয় চক্রবর্তীকে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ও রথীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে তাকে অনেক কাজ সামলাতে হতো। বিশ্বভারতীর কাজে রথীন্দ্রনাথ, প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ, রবীন্দ্রনাথের একান্ত সচিব অপূর্বকুমার চন্দের সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তী ধীরে-ধীরে নেতৃস্থানীয় দায়িত্ব পালন করতেন। তার প্রাথমিকভাবে কাজ ছিল রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পনাগুলোর ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে সবাইকে জানিয়ে সেসব বাস্তবায়নের সূত্রপাত করা।
একবার ঠিক হলো ১৩৩৯ সন থেকে ১৩৪৭ সন পর্যন্ত লিখিত কবিতাগুলো রবীন্দ্রনাথের ১৩৪৭-এর জন্মদিনে একত্রে গ্রন্থনা করে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু কবিতা সবগুলো এক ধাঁচের ছিল না। অমিয় চক্রবর্তী প্রস্তাব করলেন অন্তত দু’টি গ্রন্থে ভিন্নধর্মী এই কবিতাগুলো সংকলনের জন্য। একগুচ্ছ কবিতায় রয়েছে সুরের প্রাধান্য, ভাব-রুচির চেয়ে হৃদয়বৃত্তির আলাপ; সেগুলো গ্রন্থিত হল ''সানাই'' নামে। আর অন্য গুচ্ছ যেগুলোতে রবীন্দ্রনাথ “জীবনের দর্শন দুঃখ-মৃত্যু ছায়াকে অতিক্রম করে গেছে” সেগুলো সংগ্রন্থিত হলো ''নবজাতক'' নামে।
প্রখ্যাত দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ শিবনারায়ন রায় তার ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত “কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা" নামের গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন অমিয় চক্রবর্তীকে। তিনি সেখানে লিখেছিলেন “কবি ও মনীষী সহৃদয় বিশ্বনাগরিক অমিয় চক্রবর্তী শ্রদ্ধাভাজনেষু”। আদতেই অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন একজন বিশ্বনাগরিক। পৃথিবীর নানা দেশে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। কখনও জীবিকার তাগিদে, কখনোবা নিজস্ব ভ্রমণের তাগিদে, নিছক পরিব্রাজক হিসেবে। ভ্রমণে আমৃত্যু তিনি ছিলেন অক্লান্ত পথিক। অমিয় চক্রবর্তীর বিশ্ব ভ্রমণের শুরুটা অবশ্য হয়েছিল এক আমন্ত্রণের মধ্য দিয়ে। অমিয় চক্রবর্তীর বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চার্লস এফ অ্যান্ড্রুজের বন্ধু হরেস আলেকজান্ডার। তিনি অমিয় চক্রবর্তীকে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের উডব্রুক কলেজে আমন্ত্রণ জানালেন। ১৯৩০ সালে সেই কবির প্রথম বিদেশ যাত্রা। সেখানে প্রায় এক বছর ধরে ভারতবর্ষ ও আন্তর্জাতিক বিষয় এবং ধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হয়েছিলো তার। এই সময়ে বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলিয়ল কলেজ থেকে ইংরেজ কবি টমাস হার্ডির কাব্য নিয়ে তিন বছর গবেষণার জন্য অমিয় চক্রবর্তী ডি. ফিল ডিগ্রি লাভ করেছিলেন ১৯৩৭ সালে। আর ব্রেজনোস্ কলেজে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন ১৯৩৭ থেকে ১৯৪০ সাল অব্দি। এসময় অমিয় চক্রবর্তী ব্যাপকভাবে ভারতবর্ষ-ইরান-আফগানিস্তান সফর করেছেন আধুনিককালে ধর্ম আন্দোলন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্যে।
রবীন্দ্রনাথের সহকারীরূপেও বেশ কয়েকটি দেশে গিয়েছেন অমিয় চক্রবর্তী। ১৯৩০ সালে জার্মানি, ডেনমার্ক, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী হিসেবে। পরে আরও দু’বার রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পারস্য ও মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ করেছেন ১৯৩২ সালে। পরবর্তীতে অমিয় চক্রবর্তী প্রশান্ত এবং আটলাণ্টিক মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, পূর্ব এবং পশ্চিম এশিয়া, দূরপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং জাপান ও কোরিয়াসহ পৃথিবীর নানা দেশ বহুবার ভ্রমণ করেছিলেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়, বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বখ্যাত বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। এছাড়া ভারতের কলকাতা ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকবছর অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি। বিশ্বের বহু দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন বক্তৃতা দেয়ার জন্যে। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এবং রবার্ট ওপেন্হাইমারের আমন্ত্রণে ১৯৫১ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজে তিনি ফেলো হিসেবে ভ্রমণ করেছিলেন। ওই সময়টাতে পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানির বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ধর্ম এবং প্রাচ্য সাহিত্য বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। একাধিকবার অস্ট্রেলিয়াতে গিয়েছেন শিবনারায়ণ রায়ের আমন্ত্রণে। তার অসামান্য বক্তৃতা ও মোহনীয় আকর্ষণে মুগ্ধ হয়েছিল মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যা শিবনারায়ণ রায় নিজের আত্মকথায় উল্লেখ করেছিলেন।
এই ভ্রমণের সূত্রে বিশ্বখ্যাত বহু সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী, দার্শনিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে অমিয় চক্রবর্তীর। ১৯৪৮ সাল থেকে ভারত ছেড়ে স্থায়ীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়েছিলেন অমিয় চক্রবর্তী।
এই সময় জাপানের জেন সুজুকির সঙ্গে, বিশ্বখ্যাত রুশ সাহিত্যিক বরিস পাস্তেরনাক, আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, বিশ্বখ্যাত আইরিশ দার্শনিক, সাহিত্যিক ও নাট্যকার জর্জ বানার্ড শ, মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্ট, বিশ্বখ্যাত বেহালা বাদক ও সঙ্গীতজ্ঞ পাবলো কাসলসের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু এই সময়ে দেশের প্রতি তার মায়া একটুও কমেনি। টানা ৩০ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার পর ১৯৭৮ সালে আবার দেশে ফিরে আসেন অমিয় চক্রবর্তী। এই ফেরার জন্য তাকে বারেবারে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন তার স্ত্রী হৈমন্তী চক্রবর্তী। শিবনারায়ণ রায় কবির ফেরার প্রসঙ্গে লিখেছিলেন "তার আশঙ্কা ছিল শান্তিনিকেতন তাকে স্থানু করে রাখবে। যে ভ্রাম্যমাণতা তার চারিত্র্য এবং কবি কল্পনাকে অবসিত হতে দেয় না, শান্তিনিকেতনে এসে তা হারিয়ে ফেলবেন। তিনি চেয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত নিউ পলজ্-এই থাকবেন এবং সেখান থেকে সাধ্যমতো ঘোরাফেরা করবেন। কিন্তু বয়স আশি পেরিয়েছিল, শরীর জীর্ণ হয়ে পড়েছিল, হৈমন্তী চক্রবর্তী তাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসাই সংগত বিবেচনা করলেন।”
অমিয় চক্রবর্তীর প্রথমদিকের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকলেও তিনি অচিরেই স্বকীয়তা অর্জন করেছিলেন। অমিয় চক্রবর্তী তার প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ কবিতাবলী এবং উপহার প্রকাশের পর ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ খসড়া।
ত্রিশের দশকের পঞ্চপাণ্ডবের অন্য চার কবি জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে এক পঙক্তিতে স্থান দখল করে নেন। তার প্রথম দুটো কাব্য গ্রন্থে অবশ্য রবীন্দ্র প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
এ সময় বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদনায় প্রকাশিত কবিতা পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, “খসড়া প্রকাশের পর অমিয় চক্রবর্তীকে উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবিদের অন্যতম বলে মেনে নিতে আমাদের দ্বিধা করা উচিত নয়।" রবীন্দ্রনাথ তার মধ্যে দেখেছিলেন অনুভূতির বিচিত্র সূক্ষ্ম রহস্য ও বিশ্বসাহিত্যের স্পর্শ। কেবল তাই নয় প্রথমে সাহিত্যের ছাত্র ও পরবর্তীতে সাহিত্যের অধ্যাপক, ধর্মতত্ত্ব-রাজনীতি, দশর্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত, বিশ্বসাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন দারুণ মননশীল মানুষ। তার একটা কবিতা পড়লে দেখা যায়, যেখানে তিনি উঠিয়ে এনেছেন প্রগাঢ় দার্শনিকতার মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে যাওয়া সময় আর সমাজ-সচেতনতা।
"বাঙলার মেয়ে, এসে ছিল তার জীবনের দাবি নিয়ে,
দুদিনের দাবি ফলন্ত মাঠে, চলন্ত সংসারে;
কতটুকু ঘেরে কত দান ফিরে দিতে।
সামান্য কাজে আশ্চর্য খুশি ভরা।
আজ শহরের পথপাশে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কোথা
সভ্যতা ছোটে তেরোশো পঞ্চাশিকে।"
ছন্দ, শব্দ চয়ন, শব্দ ব্যবহারের ধাঁচ, পঙ্ক্তি গঠনের কায়দা সবকিছু মিলিয়ে বাঙালি কবিদের মধ্যে অনন্য অসাধারণ অমিয় চক্রবর্তী। কঠিন সংস্কৃত শব্দও তার কবিতায় প্রবেশ করেছে অনায়াস অধিকারে। তার কবিতায় জাগ্রত চৈতন্যের সঙ্গে সঙ্গে অবচেতনার প্রক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়েছিল বারেবারে।
কেবল কি কবিতা! গানেও এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন অমিয় চক্রবর্তী। বিশেষ করে ছেলেবেলা থেকেই সঙ্গীতে তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। শৈশব কৈশোরে আসামের গৌরীপুরে থাকার সময় যাত্রা-নাটক আর জারি-সারি, বাউল-কীর্তণের আসরে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। অন্যদিকে মামার বাড়িতে ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় ঘটেছিল। ইয়োরোপীয় ধ্রূপদী সঙ্গীতের সঙ্গে তার এই পরিচয় পরবর্তীতে তাকে সঙ্গীতের প্রতি দারুণ অনুরক্ত করে তোলে। রাশিয়ার ববোডিন, জার্মানির প্রাতিভ এবং পিয়ানো, ভায়োলিন ও অর্কেষ্ট্রার শ্রেষ্ঠ কম্পোজারদের সঙ্গীতের সঙ্গে-সঙ্গে ভারতীয় মার্গসংগীতের নিত্য শ্রোতা ছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। সেই থেকেই একটা সময় একের পর এক গান লিখতে শুরু করেন তিনি। আর তাতে বেশিরভাগ গানে তিনি নিজেই ছিলেন সুরকার। কবিতা কিংবা গান নয়, সাহিত্য সমালোচনা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী সমস্তেই সৃষ্টির অভিধান রেখে গেছেন অমিয় চক্রবর্তী।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু তো অসংকোচে অমিয় চক্রবর্তীকে ‘কবির কবি’ উপাধিতে আখ্যায়িত করেছিলেন। আর বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক, দার্শনিক আবু সয়ীদ আইয়ুব অমিয় চক্রবর্তীকে তার ‘প্রিয়তম কবি’ বলেছিলেন। শিবরারায়ণ রায় লিখেছিলেন “তিরিশ এবং চল্লিশের দশকে বাংলা সাহিত্যে বহুজনিক প্রতিভার সেই একই সঙ্গে প্রস্ফুটন আজও অপ্রতিম। বঙ্কিমের পরে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে রবীন্দ্রনাথ এই সাহিত্যের বস্তুত: একচ্ছত্র সম্রাট; তার অনিঃশেষ প্রতিভা তাকে নানাভাবে পরিপুষ্ট এবং চালিত করে এসেছে; শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী এবং নজরুল ইসলাম তার সমকালের শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী লেখক হওয়া সত্ত্বেও সাহিত্যে পর্বান্তর ঘটাননি। বিষয় নির্বাচনে, প্রতিন্যাসে, রীতিসংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যাঁদের মৌলিকতা আজ প্রশ্নাতীত। কবিতায় জসীমউদদীন, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্র, অমিয়, বুদ্ধদেব, বিষ্ণু, সমর সেন; কথাসাহিত্যে প্রেমেন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, অন্নদাশঙ্কর, মানিক, ধূর্জটিপ্রসাদ প্রত্যেকের সাহিত্যসৃষ্টি নিজস্বতার দ্বারা চিহ্নিত এবং সমবেতভাবে নতুন পর্বের স্বাক্ষরবাহী।”
রবীন্দ্রনাথের এতো কাছের মানুষ হয়েও পরবর্তীতে বিন্দুমাত্র রবীন্দ্র সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত হননি অমিয় চক্রবর্তী। তাইতো বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর জগৎ মূলত এক হ’লেও উপাদানে ও বিন্যাসে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রধান কথাটা এই যে রবীন্দ্রনাথের স্থিতিবোধ, অর্থাৎ ব্যক্তিগত জীবনে স্থায়িত্বের ভাব অমিয় চক্রবর্তীতে নেই। কোন আধুনিক কবিতেই তা সম্ভব নয়। উপাদানের আয়তন ও বৈচিত্র্য তাঁকে বৈশিষ্ট্য দিয়েছে; রবীন্দ্রনাথের কাছে যা পেয়েছেন তার ব্যবহারের ক্ষেত্র আলাদা বলে তাঁর কবিতার রসবস' স্বতন্ত্র; তাঁর কাছে আমরা যা পাই, রবীন্দ্রনাথ তা দিতে পারেন না।”
আজ আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ, বিশ্বখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অমিয় চক্রবর্তীর জন্মদিন। জন্মদিনে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র-
কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা/ শিবনারায়ণ রায়।
বিশ্বপথিক অমিয় চক্রবর্তী/ শুভাশিস চক্রবর্তী।
অমিয় চক্রবর্তীর স্মৃতিকথা ও পত্রাবলী/ ভূঁইয়া ইকবাল
বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান/ সম্পাদনা- সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম।
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
আরও পড়ুন-
সাহিত্যে আবুল মনসুর আহমেদ আজও প্রাসঙ্গিক
যুগের পর যুগ ধরে অবহেলার এক চূড়ান্ত নিদর্শন ভাষা শহীদ আবদুস সালাম
মেঘ ছাপিয়ে যাওয়া এক স্বপ্নবান স্থপতি ফজলুর রহমান খান
এক দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিবেটি কাঁকন হেনইঞ্চিতা
‘যদি চলেও যাই, কোনো আক্ষেপ নিয়ে যাব না’
স্বাধীনতাই একমাত্র গন্তব্য পূর্ব পাকিস্তানের: মওলানা ভাসানী
যার ওভারকোটের পকেট থেকে বেরিয়েছিল আধুনিক রুশ সাহিত্য আর সাহিত্যিকেরা
Comments