বিশেষায়িত চিকিৎসক, কর্মী ছাড়াই চলছে রাজশাহীর আইসিইউ

গত ৪ এপ্রিল বিকেলে যখন মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী আঘাত হানে, তখন সম্ভাব্য বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন ছিলেন মোকাররম হোসেন। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) তার ভাই মুহিবুল্লাহ বাহারের পরিচর্যায় নিয়োজিত ছিলেন।
ছবি: সংগৃহীত

গত ৪ এপ্রিল বিকেলে যখন মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী আঘাত হানে, তখন সম্ভাব্য বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন ছিলেন মোকাররম হোসেন। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) তার ভাই মুহিবুল্লাহ বাহারের পরিচর্যায় নিয়োজিত ছিলেন।

অগ্রণী ব্যাংকের পাবনা শাখার প্রধান কর্মকর্তা মুহিবুল্লাহ বাহার হাসপাতালের ২০ শয্যাবিশিষ্ট আইসিইউতে ‘সন্দেহভাজন কোভিড-১৯ রোগী’ হিসেবে ভর্তি ছিলেন।

পাবনা সুধীর কুমার হাইস্কুল ও কলেজের শিক্ষক বড়ভাই মোকাররম এটা জেনে আশ্বস্ত ছিলেন যে, রামেক হাসপাতালে একটি জেনারেটর আছে এবং আইসিইউতে দুটি বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। সেখানে তাৎক্ষণিক ও স্বয়ংক্রিয় বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থাও আছে।

কিন্তু, তার স্বস্তি ক্ষণস্থায়ী হয়।

সেদিন বিকেল ৩টা ৫৫ মিনিটে শুরু হওয়া প্রায় দুই ঘণ্টার ঝড়ে পুরো রাজশাহী শহর অন্তত সাত ঘণ্টা অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।

আইসিইউ’র যে কক্ষে তারা ছিলেন সেখানেও কিছু সময়ের জন্য অন্ধকার নেমে আসে। মোকাররমকে তখন তার ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাতে হয়েছিল। ঘরের অন্যান্য রোগীদের পরিচারকরাও একই কাজ করেন।

সম্প্রতি, মোকাররম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। এমনকি, কেউ কেউ তাদের প্রিয়জনের কী হবে তা ভেবে কাঁদতে শুরু করেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসক ও নার্সরা ছুটে আসেন। তারা বিদ্যুৎ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু, তাদের দেখে অসহায় বলে মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, তাদের করণীয় কী তা তারা জানেন না। বহনযোগ্য মেশিন নিয়ে কয়েকজন কর্মী ছুটাছুটি করছিলেন।’

রামেকের আইসিইউতে এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

জানা গেছে, করোনা মহামারি মোকাবিলায় গত বছর হাসপাতালের আইসিইউ পাঁচ শয্যা থেকে ২০ শয্যাতে উন্নীত করা হলেও সেখানে কোনো দক্ষ ও বিশেষায়িত কর্মী নিয়োগ করা হয়নি।

ফলে, রোগীদের নিয়মিত দেখাশোনা করতে তাদের নিকটাত্মীয়রা পালা করে আইসিইউতে থাকতে হয়।

যদিও আইসিইউ’র মতো হাসপাতালের একটি বিশেষ বিভাগের ভেতরে যেখানে রোগীদের নিবিড় যত্ন নেওয়া হয় সেখানে দক্ষ ও পেশাদার চিকিৎসক-কর্মী ছাড়া অন্য কারো সার্বক্ষণিক প্রবেশাধিকার থাকে না, বিশেষ করে মহামারির সময়ে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, আইসিইউতে যদি অতি অল্প সময়ের জন্যও বিদ্যুৎ না থাকে তাহলে রোগীদের জীবন হুমকিতে পরতে পারে। যদি রোগীর অক্সিজেনের স্তর একবারের জন্যও বেশি নিচে নেমে যায় তাহলে পরবর্তীতে চিকিৎসাগুলো খুব কমই কার্যকর হয়।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য ডেইলি স্টারকে বলেছে যে, সংকট মোকাবিলায় তাদের বিকল্প বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তাদের অন্যান্য সীমাবদ্ধতাও আছে, যা তারা সমাধান করার চেষ্টা করছে।

রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানি গত বৃহস্পতিবার ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, আইসিইউতে যে ১০০ জনের কম চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান ও ক্লিনার রয়েছেন তাদের সবাইকে হাসপাতালের অন্যান্য বিভাগ থেকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘অল্প কয়েকজনের সামান্য অভিজ্ঞতা আছে, তবে তারা কেউই আইসিইউ’র জন্য বিশেষায়িত নন। একটি ২০ শয্যা বিশিষ্ট আইসিইউতে কমপক্ষে ১৫০ জন দক্ষ কর্মী প্রয়োজন। সেখানে প্রতি রোগীর জন্যে অন্তত একজন চিকিৎসক ও দুই জন নার্স সার্বক্ষণিক থাকবেন।’

রাজশাহী বিভাগের অন্যান্য জেলাগুলোর অবস্থাও ভিন্ন নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, বিভাগের আটটি জেলার মধ্যে শুধুমাত্র রাজশাহী ও বগুড়ায় চারটি আইসিইউতে ৫১টি শয্যা রয়েছে। সেগুলোয় দক্ষ চিকিৎসক-কর্মীর অভাব আছে। তবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্যে অল্প কয়েকজনকে নূন্যতম প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও জানিয়েছেন, রামেক হাসপাতালে ২০ শয্যা বিশিষ্ট আইসিইউ ছাড়াও বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে আট শয্যার আইসিইউ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩ শয্যার আইসিইউ ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে একটি ১০ শয্যার আইসিইউ রয়েছে।

মোকাররমের ভাই মুহিবুল্লাহকে গত ২ এপ্রিল আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছিল।

তিনি গত ১ এপ্রিল অসুস্থ হয়ে পড়লে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে সেদিনই রাজশাহীতে স্থানান্তর করা হয়।

পরদিন ২ এপ্রিল নেওয়া নমুনা পরীক্ষায় দেখা যায় যে তিনি করোনায় আক্রান্ত নন। কিন্তু, হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে ‘সন্দেহভাজন কোভিড-১৯ রোগী’ হিসেবেই নথিভুক্ত করেছেন। তারা জানিয়েছেন যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংক্রমণের শেষ পর্যায়ে রোগীদের করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট আসে।

তার ভাই ও স্ত্রী পালা করে আইসিইউতে মুহিবুল্লাহর সঙ্গে ছিলেন।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে দক্ষ ও পর্যাপ্ত কর্মী না থাকায় রোগীদের স্বজনদের আইসিইউতে থাকতে দেওয়া হয় রোগীর অবস্থা ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণের জন্য।

মোকাররম গত ৪ এপ্রিল ঝড়ের সময় মুহিবুল্লাহর সঙ্গে ছিলেন।

মুহিবুল্লাহর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি আইসিইউর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেছিলেন ঝড়টি শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে তার ভাই শান্তভাবে ঘুমাচ্ছেন এবং তার অক্সিজেনের পরিমাপ যন্ত্র স্বাভাবিক ৯৫ শতাংশ দেখাচ্ছিল।

পর মুহূর্তে যখন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে, মুহিবুল্লাহ অস্থির হয়ে উঠেন।

তিনি মুহিবুল্লাহর অক্সিজেনের স্তর দ্রুত কমতে দেখেন এবং এক মুহূর্তেই তা কমে ৩৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল বলে জানান।

তিনি বলেন, ‘মুহিবুল্লাহ ঘামতে শুরু করলেন... আমি তার আতঙ্কিত মুখ ভুলতে পারব না। আমিও আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।’

কিছুক্ষণ পর বিদ্যুৎ ফিরে আসে।

মোকাররম বলেন, ‘প্রায় আট মিনিট বিদ্যুৎ ছিল না। কিন্তু তখন আমার কাছে খুব অল্প সময়ও অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেদিন, আইসিইউতে বিদ্যুৎ অন্তত ১০ বার যাওয়া-আসা করেছে। প্রতিবারই বিদ্যুৎ তাড়াতাড়ি চলে আসলেও ওই একবার আসতে অন্তত আট মিনিট সময় নেয়... আমার মনে হয় ক্ষতি যা হওয়ার তখনই হয়েছিল।’

কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলে মুহিবুল্লাহর অক্সিজেন স্তর শিগগির আবার ৯২ শতাংশে উন্নীত হয়। তবে রাত ২টা থেকে তার অক্সিজেনের স্তর আবার কমতে শুরু করে।

তিন বছরের এক ছেলের বাবা মুহিবুল্লাহ ৫ এপ্রিল ভোর ৫টায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৩২ বছর।

‘আমি মুহিবুল্লাহর মৃত্যুর জন্য কাউকে দোষ দিতে চাই না। আমি শুধু চাই, আইসিইউর সেবা আরও ভালো হোক। সব যন্ত্রপাতি থাকা স্বত্বেও আমার ভাইকে অক্সিজেন ছাড়াই কিছু সময় পার করতে হয়েছিল। এমন যেন আর কারো না হয়। আইসিইউতে আরও দক্ষ কর্মী দরকার,’ বলেন মোকাররম।

আইসিইউতে আরও এক রোগীর পরিচর্যাকারীর সঙ্গে কথা হয় ডেইলি স্টারের। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ঝড়ের সময় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলে একবার ফিরে আসতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল।’

তার রোগীর চিকিৎসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পরতে পারে, এই ভয়ে তিনি বিস্তারিত বলতে চাননি।

আইসিইউ’তে কর্মরত চিকিৎসক ও কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তারা কথা বলতে রাজি হননি। হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আইসিইউতে বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য সময় নেন।

রামেক হাসপাতালের পরিচালক পরে ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আইসিইউ থেকে তাকে জানানো হয়েছে যে ঝড়ের সময় সেখানকার বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি ঘটেনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আইসিইউতে যদি আট মিনিট বিদ্যুৎ না থাকে (মোকাররমের বক্তব্য অনুসারে) তাহলে সব রোগী মারা যেত। সেখানে মুমূর্ষু রোগীরাই থাকেন।’

‘আমাদের সিস্টেমটি আধুনিক। বিদ্যুৎ চলে গেলে ২৬ সেকেন্ডের মধ্যে বিকল্প বিদ্যুৎ চালুর ব্যবস্থা করা আছে। আপনি যে রোগীর কথা বলছেন তিনি হয়ত বাতি নিভে যাওয়ায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। বিদ্যুৎ বিভ্রাটে কিছু সময়ের জন্য বাতিগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে অক্সিজেন সরবরাহ ও ভেন্টিলেটরগুলো চালানোর জন্য স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আছে,’ যোগ করেন তিনি।

তবে রামেক হাসপাতালের পরিচালক স্বীকার করেছেন যে ঝড়ের সময় মুহিবুল্লাহ বাহারের অক্সিজেনের স্তর কমেছিল এবং সেটা কিছুক্ষণ পরেই স্বাভাবিক হয়েছিল।

তিনি জানান, রাজশাহী ও এর আশেপাশের জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আইসিইউতে চাপ সামলানো তাদের পক্ষে আরও কঠিন হয়ে উঠছে।

রামেক হাসপাতাল পরিচালক বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে আইসিইউতে বিশেষায়িত জনবল সরবরাহ করতে বলেছি। তবে, আমাদের মনে রাখতে হবে যে দেশজুড়ে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। আশা করি, শিগগির আমরা তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে উত্তর পাব।’

রাজশাহী মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ ও ৫ এপ্রিল রামেক হাসপাতালের আইসিইউতে অন্তত তিন ‘কোভিড-১৯ ও সন্দেহভাজন করোনা রোগী’ মারা গেছেন। হাসপাতালটিতে ১ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত আট দিনে কোভিড-১৯ ও সন্দেহভাজন করোনা রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা ২৩ জন।

তবে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ১ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় কোভিড-১৯ রোগীদের মোট নয় জন মারা গেছেন এবং নতুন শনাক্ত হয়েছেন ৯৫০ জন।

(এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন শরিফ শফিক।)

Comments

The Daily Star  | English

Floods cause Tk 14,421 crore damage in eastern Bangladesh: CPD study

The study highlighted that the damage represents 1.81 percent of the national budget for fiscal year (FY) 2024-25

2h ago