শরৎকুমার রায়ের অমরকীর্তি বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম
কুমার শরৎকুমার রায় ছিলেন নাটোরের দিঘাপতিয়ার জমিদার বংশের সন্তান ও দয়ারামপুরের খ্যাতিমান রাজা।
তিনি নিজে ও তার বংশের রাজা-মহারাজা-জমিদাররা ছিলেন ভীষণ বিদ্যানুরাগী ও প্রজাহিতৈষী। তারা বাংলার ইতিহাস-সংস্কৃতি, বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের লুপ্ত ইতিহাস-ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও বিকাশে রেখেছেন কৃতিত্বপূর্ণ অবদান।
‘রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন’, ‘রাজশাহী কলেজ’, ‘রাজশাহী সাধারণ পুস্তকালয়’ (বর্তমান রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরি) ও ‘বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম’— এই চারটি বুনিয়াদি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের নাম জড়িয়ে আছে নিবিড়ভাবে।
শরৎকুমারের বড় ভাই মহারাজা প্রমদানাথ রায় রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ৪০ বছর— ১৮৮৪ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত।
শরৎকুমার রায়ের ১৮ বছর (১৯২৫ সাল থেকে ১৯৪২ সাল) এবং এই বংশের শেষ রাজা প্রতিভানাথ রায়ের সাত বছরসহ (১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫২ সাল) এই বংশের তিন রাজা মিলে প্রায় ৬৫ বছর লাইব্রেরির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাদের সুযোগ্য পরিচালনায় রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরি তখন উপমহাদেশের অন্যতম বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল।
রাজশাহীর ‘বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম’র প্রতিষ্ঠাতা কুমার শরৎকুমার রায় বাংলার ইতিহাসচর্চার এই শ্রেষ্ঠ পাদপীঠ প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
নাটোরের বর্তমান উত্তরা গণভবন ছিল সেসময়ের দিঘাপতিয়ার জমিদার বাড়ি। এই বাড়িতেই শরৎকুমার রায় জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭৬ সালের ২২ এপ্রিল এবং মারা যান ১৯৪৫ সালের ১২ এপ্রিল।
তার বাবা মহারাজা প্রমথনাথ রায়, মা দ্রবময়ী দেবী ও পরিবারের অন্য সদস্যরাও ছিলেন ইতিহাসের প্রতি গভীর অনুরাগী। শৈশবেই শরৎকুমার ইতিহাসপ্রেমী হয়ে উঠেন।
কুমার শরৎকুমার রায়ের শিক্ষা জীবন শুরু হয় রাজশাহী শহরে। তিনি সেখানকার কলেজিয়েট স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। এরপর তিনি পড়ালেখা করেন কলকাতায়।
১৮৯০ সালে শরৎকুমার রায়ের বড় দুই ভাই প্রমদানাথ ও বসন্তকুমারের এন্ট্রাস পাশের পর বাবা মহারাজা প্রমথনাথ রায় তার চার ছেলেকে (প্রমদা-বসন্ত-শরৎ-হেমেন্দ্র) পড়াশোনার জন্য এক সঙ্গে কলকাতায় পাঠান।
শরৎকুমার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৮৯২ সালে প্রবেশিকা ও ১৮৯৪ সালে রিপন কলেজ থেকে এফএ (ফাস্ট আর্টস) পাশ করেন।
কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে শরৎকুমারের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন আচার্য স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। কলেজে পড়ার সময় শরৎকুমারের অধীত বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ানোর জন্য পণ্ডিত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে গৃহশিক্ষক হিসেবে রাখা হয়। প্রখ্যাত মনীষীদের সংস্পর্শে এসে শরৎকুমার ঋদ্ধ হন।
কলকাতায় ছাত্রজীবনে শরৎকুমার খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদসহ অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসেন এবং তাদের সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে যোগসূত্র ঘটান। তারা হলেন— সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়, ‘পলাশীর যুদ্ধ’খ্যাত কবি নবীন সেন, সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা বিনয় কৃষ্ণদেব বাহাদুর প্রমুখ।
কুমার শরৎকুমার রায় ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদ। তিনি ছিলেন প্রথিতযশা লেখকও। সমাজসেবা ও নানা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনের কারণে তিনি সাহিত্যচর্চায় পুরোপুরি নিবেদিত হতে পারেনি।
শরৎকুমারের বেশ কয়েকটি বই ও অনেক প্রবন্ধের মধ্যে ৫৪৭ পৃষ্ঠার ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘মোহনলাল’ শ্রেষ্ঠ কীর্তি ও ইতিহাসের অমূল্য দলিল। তার ‘শিখগুরু ও শিখজাতি’ বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এতে বোঝা যায় যে তাদের সম্পর্ক কতোটা গভীর ছিল।
কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৯৯ সালে স্নাতক ও ১৯০০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে এমএ পাশের পর কুমার শরৎকুমার রায় অনুজ হেমেন্দ্র কুমার রায়কে নিয়ে ইউরোপ যান। তিনি থিবস, পম্পেইসহ ইতিহাস সমৃদ্ধ প্রাচীন নগরী এবং বিখ্যাত জাদুঘর ঘুরে দেখেন। সফরে গিয়ে প্রাচীন ঐতিহাসিক নগরী দেখে তারা মুগ্ধ হন এবং মাতৃভূমির ইতিহাসচর্চায় ব্যাকুল হয়ে উঠেন।
বরেণ্য পণ্ডিতদের নিয়ে ইতিহাসচর্চার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান করা যায় কি না— এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে থাকেন কুমার শরৎকুমার রায়।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তখন ছিলেন রাজশাহী বারের প্রখ্যাত আইনজীবী ও রমাপ্রসাদ চন্দ ছিলেন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক। তারা মাতৃভূমির ইতিহাস রচনায় গভীর অনুরাগী হিসেবে বাংলাজুড়ে তখন খ্যাতিমান।
মাতৃভূমির ইতিহাস রচনার অভাববোধ থেকে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস নাই, নহিলে বাঙ্গালার ভরসা নাই।’
বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস রচনার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাসপ্রেমী বাঙালিদের গভীর অনুরাগে অনলসভাবে উদারচিত্তে ডেকে বলেছিলেন, ‘আইস আমরা সকলে মিলিয়া বাংলার ইতিহাস অনুসন্ধান করি।’
বঙ্কিমচন্দ্রের কাঙ্ক্ষিত সেই বাঙালি হয়ে ওঠেছিলেন রাজশাহীর তিন সন্তান— কুমার শরৎকুমার রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও রমাপ্রসাদ চন্দ।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রথম সম্মেলনের তৃতীয় অধিবেশন ১৯১০ সালের প্রথম দিকে (১, ২ ও ৩ ফাল্গুন ১৩১৬) বিহারের ভাগলপুরে অনুষ্ঠিত হয়। রাজশাহী তথা উত্তরবঙ্গের প্রতিনিধি হিসেবে তারা তিনজন সম্মেলনে অংশ নেন।
সম্মেলন শেষে তারা ভাগলপুর এলাকার পুরাকীর্তি দেখেন এবং বরেন্দ্রভূমির প্রত্নসম্পদ আহরণে উদ্বুদ্ধ হন। ভাগলপুর থেকে ফেরার সময় ট্রেনে বসেই সিদ্ধান্ত নেন তারা অচিরেই একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন।
রাজশাহীতে ফিরে তারা সেখানকার প্রখ্যাত আইনজীবী হরিমোহন চৌধুরীর সঙ্গে পরামর্শ করে ১৯১০ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসন্ধানে বের হন।
প্রথমে তারা রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও এর আশপাশের প্রাচীন গ্রামগুলোতে পাঁচদিন অনুসন্ধান করে ৩২টি দুষ্প্রাপ্য প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ করেন।
সে বছর জুনে দ্বিতীয় অভিযানে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তারা বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুরের বিভিন্নস্থান থেকে বিপুল সংখ্যক প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ করেন।
প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহের পর তারা একটি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেন। ১৯১০ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’ গঠন করা হয়। তবে, এই সমিতি অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রথম গঠিত হয় সেই বছর এপ্রিলের প্রথম দিকে।
আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন কুমার শরৎকুমার রায়। এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও অনারারি সেক্রেটারি ছিলেন রমাপ্রসাদ চন্দ।
সমিতির প্রথমদিকেই কলকাতা মিউজিয়ামের তদানীন্তন সুপারিন্টেনডেন্ট ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রামকমল সিংহসহ প্রখ্যাত ব্যক্তিরা মিলিত হন।
কুমার শরৎকুমার রায়ের বড়ভাই রাজা প্রমদানাথ রায় বাহাদুর মিউজিয়ামের জন্য ৫ বিঘা ২ কাঠা ২ ছটাক জমি কিনে তা ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’কে মিউজিয়াম তৈরির জন্য দান করেন এবং ভবিষ্যতে মিউজিয়াম সম্প্রসারণের জন্য জমি দান করেন বাবু দুর্গাদাস ভট্টাচার্য।
এই জমির ওপর প্রধানত কুমার শরৎকুমার রায়ের অর্থে (৬৩ হাজার টাকা) ১৯১৬-১৯১৯ সালের মধ্যে নির্মিত হয় এক দৃষ্টিনন্দন ভবন।
১৯১৬ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম ভবন নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর করেন। প্রাচীন গৌড়ের স্থাপত্যকলা অনুসরণ করে মিউজিয়াম ভবনের নকশা করেন কুমার শরৎকুমার রায় নিজে।
১৯১৯ সালে ২৭ নভেম্বর বাংলার গভর্নর লর্ড রোনাল্ডসে এই ভবনের দ্বারোদঘাটন করেন। এরপর মিয়াপাড়াস্থ পাবলিক লাইব্রেরিতে থাকা প্রত্ননিদর্শনগুলো বর্তমানের এই ভবনে এনে সংরক্ষণ ও সর্বসাধারণের জন্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়।
কালক্রমে ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’ নাম রূপান্তরিত হয়ে ‘বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম’ হয়। এই মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করাকে ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা’ হিসেবে তখনই অভিহিত করেন ইতিহাসবিদরা। এরপর বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের সুখ্যাতি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯১৪ সালে ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’ নিবন্ধিত হয় ১৮৬০ সালের রেজিস্ট্রি অ্যাক্ট অনুযায়ী। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিকে সেই মর্যাদা দেওয়া হয় ১৯১০ সাল থেকেই।
এর আগে, বেঙ্গল গভর্নমেন্ট ১৯১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এক আদেশে (নং-১১) ‘রাজশাহী শহরে একটি বেসরকারি মিউজিয়াম’ স্থাপনের অনুমতি দেয়।
১৯১০ সাল থেকে ১৯৩৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’ পরিচালিত হতো সমিতির ‘কাউন্সিল অব ম্যানেজমেন্ট’র দ্বারা। এরপর, ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলার গভর্নরের শিক্ষা বিভাগের অধীন আনা হয় এবং পরিচালনা পরিষদের নাম হয় ‘কমিটি অব ম্যানেজমেন্ট’।
সরকারি সিদ্ধান্তে ১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর থেকে মিউজিয়ামটির মালিকানা লাভ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’ প্রাথমিক সময়েই ‘প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ’, ‘গবেষণা’ ও ‘প্রকাশনা’— এই তিনটি কাজকে আবশ্যক করে নেয়।
মিউজিয়ামে বর্তমানে প্রায় ১৭ হাজার প্রত্ননিদর্শন রয়েছে। এখানে পাঁচ হাজার বছর আগের সিন্ধুসভ্যতার (হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো) প্রায় তিন শ প্রত্ননিদর্শন রয়েছে। এতো প্রাচীন নিদর্শন বাংলাদেশের আর কোনো মিউজিয়ামে নেই।
রঙিন ছবি সম্বলিত তালপাতায় লিখিত এক হাজার বছর আগের পাণ্ডুলিপি এই মিউজিয়ামে আছে, যা বিশ্বে দুর্লভ এবং দেশের আর কোনো মিউজিয়ামে নেই। এখানে রয়েছে মূল্যবান কৃষ্ণপ্রস্তর বা কষ্টিপাথরের ভাস্কর্যের বড় মজুদ। এখানে এই শ্রেণির ভাস্কর্য আছে প্রায় দুই হাজার।
কুমার শরৎকুমার রায় নিজে ১২৭টি মূল্যবান কষ্টিপাথরের ভাস্কর্য সংগ্রহ করে মিউজিয়ামকে দিয়েছিলেন।
মিউজিয়ামে তুলট কাগজে ও তালপাতায় লেখা পাঁচ হাজারের বেশি পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি আছে। এর মধ্যে কুমার শরৎকুমার রায়ের সংগ্রহ করা ১ হাজার ১১০টি পুঁথি রয়েছে।
মধ্যযুগে গৌড়ের অন্যতম প্রধান কবি শেখ জাহেদের ‘আদ্য পরিচয়’ পাণ্ডুলিপি কুমার শরৎকুমার রায় মালদহ জেলা থেকে সংগ্রহ করেন। ইতিহাসবিদ পারসি ব্রাউন ১৯১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি মিউজিয়াম দেখতে এসে লিখিত মন্তব্যে বলেছিলেন, ‘এই মিউজিয়াম বঙ্গীয় শিল্পকলা সংগ্রহে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।’
বাঙালি জাতির লেখ্য ইতিহাস সৃষ্টিতে বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম ও এর প্রত্ননিদর্শন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ১৯১২ সালে এই মিউজিয়াম থেকেই বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস রচনা ও চর্চার সূচনা ঘটে রমাপ্রসাদ চন্দ রচিত ‘গৌড়রাজমালা’ ও অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের ‘গৌড়লেখমালা’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
এই দুইটি গ্রন্থ প্রকাশের পর বাংলার সুধী সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার তার ‘বাংলাদেশের ইতিহাস প্রাচীন যুগ’ গ্রন্থে অভিমত দেন যে, ‘গৌড়রাজমালা আধুনিক জ্ঞানসম্মত প্রণালীতে লিখিত বাংলার প্রথম ইতিহাস।’
‘গৌড়রাজমালা’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও আপ্লুত করেছিল।
বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে গ্রন্থাগারও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শরৎকুমার রায়। তার সংগ্রহে থাকা দুষ্প্রাপ্য বই ও জার্নাল দিয়েছিলেন সেই গ্রন্থাগারে। এখানে এমন অনেক দুষ্প্রাপ্য বই রয়েছে যা বাংলাদেশের আর কোনো গ্রন্থাগারে নেই। অধিকাংশ বই প্রকাশের ব্যয়ভার তিনিই বহন করতেন।
‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’ সেই অঞ্চলে বিভিন্ন প্রত্নস্থল খনন করে ও অমূল্য প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ করে বাংলার ইতিহাস বিনির্মাণ করেছে। এ ক্ষেত্রে বড় কৃতিত্ব হলো ‘পাহাড়পুর মহাবিহার’ খনন। কুমার শরৎকুমার রায়ের একক অর্থায়নে ‘পাহাড়পুর মহাবিহার’-এ সর্বপ্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক আনুষ্ঠানিক খনন শুরু হয় ১৯২৩ সালের ১ মার্চ। এটি টানা পাঁচ বছর চলেছিল।
‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের যৌথ উদ্যোগে এই খনন হয়। পাহাড়পুর খননে পাওয়া প্রায় ৩০০ প্রত্ননিদর্শন বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে রয়েছে।
কুমার শরৎকুমার রায়, ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, ঐতিহাসিক রমাপ্রসাদ চন্দ, প্রত্নতত্ত্ববিদ নীরদবন্ধু স্যানাল, প্রত্নতত্ত্ববিদ ননীগোপাল মজুমদারসহ প্রখ্যাত ব্যক্তিরা পাহাড়পুর খননে অংশগ্রহণ নিয়েছিলেন।
১৯১৬ সালে নওগাঁর ধামুরহাটের মাহিসন্তোষসহ আর বহু খননের নেতৃত্ব ও অর্থায়ন করেছিলেন কুমার শরৎকুমার রায়। তার ধনভাণ্ডার বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে জন্য সবসময় উন্মুক্ত ছিল। ভবন নির্মাণ, প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ, প্রত্নস্থল খনন, প্রকাশনাসহ যাবতীয় খরচ বলা যায় তিনি একাই দিয়ে গেছেন।
বাংলার ইতিহাসের মহানসেবক শরৎকুমার রায় ১৯৪৫ সালের ১২ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসারত অবস্থায় কলকাতায় মারা যান। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তার জীবন আবর্তিত হয়েছিল মিউজিয়ামটিকে ঘিরেই।
শরৎকুমারের গড়া এই মিউজিয়ামের বিপুল প্রত্নসম্পদ অতীত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
মো. সফিকুল ইসলাম, উপ-রেজিস্ট্রার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Comments