প্লাস্টিক সার্জারির ‘ভুতুড়ে ডাক্তার’
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের বাসিন্দা কিওন তায়ে হুন এক শুক্রবার রাতে অপরিচিত নম্বর থেকে একটি ফোন পান। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘আপনি কি কিওন দায়ে হির ভাই? আপনার ভাই জরুরি বিভাগে আছেন। আপনি কি একটু হাসপাতালে আসতে পারবেন?’
তাকে জানানো হয়, তার ভাইয়ের অবস্থা ‘উদ্বেগজনক নয়’। কিওন তায়ে হুন ধরেই নিয়েছিলেন যে ভাই মদ্যপ হয়ে মারামারি করে আহত হয়েছেন। ট্যাক্সি করে হাসপাতালে যাওয়ার সময় তিনি ভাইকে বকা দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
কিন্তু, সে সুযোগ তিনি আর পাননি। তায়ে হুন হাসপাতালে পৌঁছে জানতে পারেন, তার ২৪ বছর বয়সী ভাই অচেতন অবস্থায় আছে। নিজের চোয়ালকে আকর্ষণীয় করার জন্য অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে তার ভাইয়ের এত বেশি রক্তক্ষরণ হয়েছিল যে, তার মুখের চারপাশে বেধে রাখা ব্যান্ডেজটি পুরোপুরি লাল হয়ে গিয়েছিল।
কিওন দায়ে হি আর সুস্থ হতে পারেননি। সাত সপ্তাহ পর হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
সিএনএন জানিয়েছে, কিওনের পরিবার মনে করছে তিনি ‘ভুতুড়ে চিকিৎসক’র অবহেলার শিকার হয়ে মারা গিয়েছেন। রোগী যখন চেতনানাশকের প্রভাবে অচেতন থাকেন, তখন অনেক ক্ষেত্রে একজন ‘বদলি’ বা অজ্ঞাতনামা চিকিৎসক এসে তার ওপর অস্ত্রোপচার চালিয়ে থাকেন। এদেরকেই ভুতুড়ে চিকিৎসক বলা হচ্ছে। কারণ কাগজে-কলমে তাদের পরিচয় কিংবা তাদের কাজের কোনো রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায় না।
দক্ষিণ কোরিয়ায় গড়ে উঠেছে বছরে ১০ হাজার ৭০ কোটি মার্কিন ডলারের প্লাস্টিক সার্জারির শিল্প।
এ ধরনের ভুতুড়ে চিকিৎসকের ব্যবহার বেআইনি। কিন্তু, এর বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, দুর্বল আইনি ব্যবস্থার কারণে সেখানে বেশিরভাগ ক্লিনিকেই এ চর্চাটি চলছে।
দেশটিতে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য ক্লিনিকের অনেকগুলোতেই অভিজ্ঞ ও দক্ষ শল্যচিকিৎসকের অভাব আছে। কখনো কখনো অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা একইসঙ্গে একাধিক অস্ত্রোপচারের কাজ করেন। সেক্ষেত্রে তাদের কিছু কাজ করে দেওয়ার জন্য তারা বদলি ডাক্তারের ওপর ভরসা করেন, যাদের মাঝে রয়েছে নতুন পাশ করা প্লাস্টিক সার্জন, দন্ত চিকিৎসক, নার্স অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেডিকেল যন্ত্রপাতির বিক্রয়কর্মী।
আইনজীবীরা বলছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার আইনে কোনো লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তি বেআইনিভাবে চিকিৎসার কাজ করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল কিংবা প্রায় ৪৪ হাজার মার্কিন ডলার জরিমানার বিধান আছে। এমনকি লাইসেন্স আছে এমন চিকিৎসকও যদি বেনামে বা বদলি হিসেবে চিকিৎসা সেবা দেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা যায়। তবে এ ধরনের অপরাধ প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার, কারণ এই বদলি বা ভুতুড়ে চিকিৎসকরা প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের কাজের কোনো প্রমাণ রেখে যান না এবং অনেক ক্লিনিকেই সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা নেই। আর যদিওবা কোনো ভুতুড়ে চিকিৎসককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়, তারা ন্যূনতম জরিমানা দিয়েই পার পেয়ে যান। আর ক্লিনিকগুলো যথারীতি তাদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে।
তবে, কিওনের পরিবারের দায়ের করা মামলাটি গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে এবং এ ধরনের অসাধু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সব চিকিৎসাকেন্দ্র এখন নতুন করে মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। কিওনের পরিবার শুধু ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েই থামেননি, তারা এ সংক্রান্ত আইনের পরিবর্তনের জন্যও তৎপরতা চালাচ্ছেন।
তার পরিবার জানায়, কিওন দায়ে হি একজন নম্র ও ভদ্র, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ছিলেন, যিনি পরিবারকে ভালবাসতেন। তার ভাই বলেন, তিনি একজন উচ্চাভিলাষী মানুষ ছিলেন। কিন্তু, একইসঙ্গে তিনি তার নিজের চেহারা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতেন এবং ভাবতেন যে প্লাস্টিক সার্জারি তাকে আরও সাফল্য এনে দেবে।
মৃত্যুর অল্পদিন আগে তোলা কিছু ছবিতে দেখা যায় তিনি নিজের চেহারাকে অ্যাপের মাধ্যমে ইংরেজি অক্ষর ‘ভি’ আকৃতির চোয়ালযুক্ত কে-পপ শিল্পীদের মতো বানিয়েছেন।
বড় ভাই তায়ে হুন ও মা, লি না জিউমের অনুরোধকে উপেক্ষা করে দায়ে হি চোয়াল সার্জারির জন্য বিখ্যাত একটি ক্লিনিকে গোপনে বুকিং দিয়েছিলেন। ক্লিনিকটি সিওলের ‘গ্যাংনাম’ এলাকায় অবস্থিত, যেখানে দেশের বেশিরভাগ বিখ্যাত কে-পপ সংগীত প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিস রয়েছে।
তার মায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সেপ্টেম্বরে একজন চিকিৎসক কিওন দায়ে হির চোয়ালের আকৃতি পরিবর্তনের জন্য অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে একটি হাড় কেটে ফেলেন। পূর্ব এশিয়াতে এ ধরনের শল্যচিকিৎসা খুবই জনপ্রিয় এবং এতে এক থেকে দুই ঘণ্টার মতো সময় লাগে। এতে খরচ হয় ৬৫ লাখ ওন (প্রায় ৫ হাজার ৭৬৬ মার্কিন ডলার)।
তবে, কিওন দায়ে হির অস্ত্রোপচারটি পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়নি।
অতিরিক্ত রক্তপাত ঘটার পর তাকে পরেরদিন সকাল ৯টায় অন্য একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার সার্জন সে হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে পরিবারকে জানান যে অস্ত্রোপচার ঠিকমতোই হয়েছিল এবং এটি প্রমাণ করার জন্য তিনি সিসিটিভি ফুটেজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন।
কিওনের মা এই ফুটেজটি প্রায় ৫০০ বারেরও বেশি দেখেছেন।
ফুটেজে লি দেখতে পান কিওনের চোয়ালের হাড় কেটে ফেলা সার্জনটি পুরো অস্ত্রোপচার শেষ করেননি। অন্য একজন চিকিৎসক সেটি শেষ করেন, যিনি একজন সাধারণ চিকিৎসক। ওই চিকিৎসক সম্প্রতি মেডিকেল স্কুল থেকে পাস করেছেন এবং প্লাস্টিক সার্জারি করার জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স তার নেই। তবে, ক্লিনিকের বিজ্ঞাপনে পরিষ্কার বলা ছিল যে, সব সার্জারি তাদের প্রধান সার্জন সম্পাদন করবেন।
কিওন তায়ে হুন বলেন, ‘আমার ভাই হেড সার্জনের ওপর ভরসা করতেন এবং সে কারণেই তিনি ওই ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।’
ফুটেজে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সার্জারিটি শেষ হতে প্রায় তিন ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। কোরিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব প্লাস্টিক সার্জনসের সাবেক আইন বিষয়ক পরিচালক কিম সেওন উং বলেন, ‘এ ধরনের চোয়ালের সার্জারিতে একজন অভিজ্ঞ সার্জনের সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় ঘণ্টা কিংবা তারচেয়েও কম সময় লাগে।’ কিম নিজেই একটি প্লাস্টিক সার্জারি ক্লিনিক পরিচালনা করেছেন ২৫ বছর ধরে।
ফুটেজে দেখা যায়, সার্জারি শেষে কিওনের দুজন চিকিৎসকই ঘরে ফিরে যান, আর তাকে নার্সদের দায়িত্বে রেখে যান। লি জানান, তিনি ফুটেজে দেখতে পান, তার ছেলের রক্তপাত বন্ধ হচ্ছিল না, আর এর মাঝে চিকিৎসা সহকারীরা তাদের সাজসজ্জা ঠিক করছিলেন এবং মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারা মোট ১৩ বার মেঝে থেকে রক্ত পরিষ্কার করেন। মেডিকেল বিশেষজ্ঞরা ফুটেজ পরীক্ষা করে জানিয়েছেন যে স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেশি রক্তক্ষরণ হয়েছিল কিওন দায়ে হির শরীর থেকে।
তার মা আরও বলেন, ‘আমার মনে হয় না যে আমার ছেলের কী পরিমাণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা ওই ভুতুড়ে চিকিৎসক পরীক্ষা করেছিলেন। যদি একজন চিকিৎসকও ভালো করে আমার ছেলেকে পরীক্ষা করতেন, তাহলে হয়তো তার এ পরিণতি হতো না। তবে কেউ তা করেনি।’
কিওনের মৃত্যুর পরেও ক্লিনিকটি বেশ কিছুদিন খোলা ছিল। কিন্তু, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে গত বছর এটি বন্ধ হয়ে যায়।
কিওনের পরিবার দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গিয়ে জানতে পারে, ভুতুড়ে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তেমন কঠিন কিংবা স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো আইন নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সার্জন সিএনএনকে জানান, তিনি ২০১২ সালে দেশের বৃহত্তম একটি প্লাস্টিক সার্জারি ক্লিনিকে কাজ শুরু করেন। তবে, বর্তমানে সেখানে তিনি আর কাজ করেন না। সেখানে তিনি প্রায়ই প্রধান সার্জনের পরিবর্তে ভুতুড়ে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতেন। তার বর্ণনায়, বেজমেন্টে লাইন ধরে বদলি চিকিৎসকরা অপেক্ষা করতেন এবং রোগীদের সার্জারির সময় তাদের ডাক পড়ত। এসব ভুতুড়ে চিকিৎসকরা ক্লিনিকের ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত ছিলেন না এবং ক্লিনিক সব সময়ই, সকল সার্জারিকে মূল সার্জনদের কাজ হিসেবে উল্লেখ করতেন।
তিনি আরও জানান, ওই ক্লিনিকে চেহারার আকৃতি পরিবর্তন করার সার্জারিগুলো (কিওন যেটি করাতে গিয়েছিলেন) সাধারণত বদলি চিকিৎসকরাই করতেন এবং তারা ছিলেন মূলত দন্ত চিকিৎসক।
প্লাস্টিক সার্জনটি বলেন, ‘ভুতুড়ে চিকিৎসকদের মাধ্যমে ক্লিনিকরা তাদের লাভ বাড়াতে পারে। কারণ তারা তাদের মূল চিকিৎসকদের বদলে কাজ করে থাকেন। এর মাধ্যমে তরুণ ও অনভিজ্ঞ চিকিৎসকদের কর্মসংস্থান হয়, আর একইসঙ্গে ক্লিনিক কম খরচে বেশি সেবা দিতে পারে।’
কিওনের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী পার্ক হো কিউন বলেন, ‘রোগীরা জানতে পারেন না যে তাদের অস্ত্রোপচার করেছেন ভুতুড়ে চিকিৎসকরা। সেসব চিকিৎসকরা তাদের সম্পৃক্ততার কথা কোনো মেডিকেল চার্টে লেখেন না এবং অনেক অপারেশন থিয়েটারে সিসি ক্যামেরা থাকে না। এসব কিছু মিলিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এনে তা প্রমাণ করা খুবই কঠিন।’
বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও কিওনের পরিবার ন্যায়বিচার পেতে সংকল্পবদ্ধ ছিল। সার্জারির বিপদ সম্পর্কে রোগীকে না জানানো এবং রোগীকে বাঁচানোর জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে গাফিলতির অভিযোগ আনেন তারা ক্লিনিকটির বিরুদ্ধে। অবশেষে তারা মামলায় জয়লাভও করেন এবং ২০১৯ সালের মে’তে তারা প্রায় ৪৩০ মিলিয়ন ওন (৩ লাখ ৮১ হাজার মার্কিন ডলার) ক্ষতিপূরণ পান। কিওন যদি ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচতেন, তাহলে সাধারণ কর্মী হিসেবে তার গড় বেতন যা হতো, তার ওপর ভিত্তি করে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে।
দায়ী চিকিৎসক ও ভুতুড়ে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা চলছে। তাদের সঙ্গে থাকা নার্স ও সহকারীরাও অভিযুক্ত হয়েছেন।
কিওনের মা প্রতিদিন দক্ষিণ কোরিয়ার সংসদ ভবনের বাইরে একটি প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রতিটি অপারেশন থিয়েটারে সিসি ক্যামেরা থাকাকে বাধ্যতামূলক করে আইন তৈরির দাবি তার প্ল্যাকার্ডে লেখা। তার এই প্রস্তাবিত বিলটি ‘কিওন দায়ে হি বিল’ নামে মানুষের মুখে মুখে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
Comments