আমেরিকার ‘দীর্ঘতম যুদ্ধের’ ইতিকথা

ছবি: রয়টার্স

‘আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধ বন্ধের এটাই সময়,’ বলেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

দক্ষিণ-মধ্য এশিয়ার ভূ-বেষ্টিত পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ আফগানিস্তানে ২০০১ সালে বিমান হামলার মধ্য দিয়ে যে যুদ্ধের সূচনা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র আজ প্রায় ২০ বছর পর তার অবসান চাইছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশটি।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের আগেই আফগানিস্তান থেকে সব সেনা সরাতে চায় বাইডেন প্রশাসন।

আজ বৃহস্পতিবার বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনা সরানোর পর, আফগানিস্তানে ‘সামরিক’ সহযোগিতা ছাড়া সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে পাশে থাকতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

এতে আরও বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে ন্যাটো-আফগান মিশনে সেনা রয়েছে ৯ হাজার ৬০০ জন। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা অন্তত আড়াই হাজার।

ছবি: রয়টার্স

মার্কিন গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, বর্তমানে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সেনার সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের কাছাকাছি।

আফগানিস্তানে দীর্ঘ দুই দশকের যুদ্ধ থামাবার যে কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যেই আমেরিকা ও ন্যাটোর কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সহিংসতা বন্ধে তালেবানরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা তারা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

অথচ, এই তালেবানদের বিরুদ্ধেই দুই দশক আগে লড়াইয়ে নেমেছিল যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তি।

সিএনএন জানিয়েছে, গত দুই দশকে আফগানিস্তানে প্রাণ হারিয়েছেন ২৩০০’র বেশি মার্কিন সেনা। আহত হয়েছেন ১০ হাজারের বেশি। আফগান হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে প্রতিবেদনে ব্যবহার করা হয়েছে ‘অগণিত’ শব্দটি।

সংবাদমাধ্যমটি আরও জানিয়েছে, এই যুদ্ধে আমেরিকার খরচ হয়েছে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি।

যুদ্ধের শুরু

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি ও পেনসিলভানিয়ায় সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পর প্রথমেই আফগানিস্তানকে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে যুক্তরাষ্ট্র।

৯/১১ এর হামলায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার যোগসূত্র রয়েছে— এমন ঘোষণা দিয়ে সেসময় তালেবানদের দখলে থাকা আফগানিস্তানে আশ্রয় নেওয়া আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে তৎকালীন বুশ প্রশাসন।

ছবি: রয়টার্স

কোথা থেকে এলো তালেবান

সিএনএন এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত শতাব্দীর আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে থাকা আফগানিস্তানে ‘মুজাহিদিন’ নামে যে প্রতিরোধ সংগঠন গড়ে উঠেছিল সেখানে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনও ছিলেন।

সোভিয়েতবিরোধী সংগঠনগুলোকে অস্ত্রসহ সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনারা সরে গেলে দেশটিতে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে মুজাহিদিনরা। এরপর মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের নেতৃত্বে সংগঠিত হয় মাদ্রাসা শিক্ষার্থী তালেবানরা।

তালেবানরা ২০০১ সালের মধ্যে আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকায় মুজাহিদিনদের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে নেয়। তারা দেশটিকে তথাকথিত বিদেশি সংস্কৃতিমুক্ত রাখার কথা বলে টেলিভিশন ও সংগীতচর্চা বন্ধ করে দেয়। তারা নারী শিক্ষা ও তাদের চলাচলের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

আক্রমণের জন্যে কেন আফগানিস্তান

সিএনএন এর প্রতিবেদন মতে, আসলে তালেবানদের বিরুদ্ধে নয়, বরং আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত আল-কায়েদার বিরুদ্ধে লড়াই করতে আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

তালেবানদের আশ্রয়ে থেকে ওসামা বিন লাদেনসহ যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার অন্য পরিকল্পনাকারীদের ধরতেই শুরু হয়েছিল এই হামলা। তালেবানরা মিত্রশক্তির হামলার মুখেও আল-কায়েদা নেতাদের ত্যাগ করতে রাজি ছিল না বলে তাদেরকেও হামলার শিকার হতে হয়েছিল।

যা বলেছিলেন বুশ

ন্যাটোর সহযোগিতা নিয়ে মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান আক্রমণ করার সময় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ একে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

তিনি আফগানিস্তানে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ও তালেবানদের সামরিক শক্তি ধ্বংস করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি এই অভিযানের নাম দিয়েছিলেন, ‘এনডিউরিং ফ্রিডম’।

বলেছিলেন, ‘১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে আমেরিকার নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার মূল্য, তাদের কর্তব্য ও আত্মত্যাগের বিষয়টি নতুনভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে।’

ছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তানে তালেবান-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল

বর্তমানে আফগানিস্তানে তালেবান-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো দেখতে গিয়েছিলেন সিএনএন এর সংবাদদাতা নিক প্যাটন ওয়ালশ। ১০ বছর আগে মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনাদের হামলায় যেসব এলাকায় বহু মানুষ হতাহত হয়েছিল সেই এলাকাগুলো ঘুরে দেখেছেন তিনি। সেসব এলাকায় এখনো নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

ওয়ালশ লিখেছেন, রাজধানী কাবুলসহ আফগানিস্তানের বড় বড় শহরগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকা তালেবানদের নানা দল-উপদলের দখলে আছে।

হেলমান্দ প্রদেশের মুসা কালা শহরের এক বাসিন্দা সিএনএনকে বলেছেন, ‘দিন শেষে তালেবানদের হাতেই ক্ষমতা। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনো সুযোগই নেই।’

আফগানিস্তানে কী চায় যুক্তরাষ্ট্র

আফগানিস্তানে তালেবানদের হাতে নির্যাতিত নারীদের মুক্তি দেওয়া বা সেখানে তালেবান শাসনের অবসান ঘটাতে কি আমেরিকার এই যুদ্ধ? দেখা যাচ্ছে, বহু বছর ধরে মার্কিন প্রশাসন তালেবানদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেদন মতে, ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার পর সেখানে যেমন ইসলামিক স্টেটের উত্থান হয়েছিল তেমনিভাবে আফগানিস্তানে যাতে আল-কায়েদার মতো কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন ঘাঁটি গাড়তে না পারে তা নিশ্চিত করাই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য।

সেনা সরানোর পর কী হতে পারে

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে দেশটির সরকার ও তালেবানদের মধ্যে শান্তি চুক্তির চেষ্টা চালিয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র।

সেনা কমান্ডারদের আশঙ্কা, আমেরিকান সেনা সরিয়ে নেওয়া হলে তালেবানরা সরকার উৎখাত করে ফেলতে পারে। বাইডেন প্রশাসন সেই আশঙ্কা আমলে নিচ্ছে না।

গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, ‘মিত্রশক্তি সরে গেলে যুদ্ধক্ষেত্রে তালেবানদের এগিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তালেবানদের ঠেকিয়ে রাখা আফগান সরকার পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠবে।’

Comments

The Daily Star  | English

No justifiable reason to delay nat'l polls beyond Dec: Salahuddin

We have been able to make it clear that there is not even a single mentionable reason to hold the election after December, says the BNP leader

2h ago