দ. আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট: টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়

দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু হু হু করে বাড়ছে। গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সংক্রমণ যখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, অনেকেই হয়তো ভেবে বসেছিলেন দেশে করোনা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি একরকম গা-ছাড়া ভাব দেখা দেয়। চারদিকে বিয়ে-শাদি, সভা-সমাবেশ, ঘোরাঘুরির ধুম পড়ে যায়।
ছবি: রয়টার্স

দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু হু হু করে বাড়ছে। গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সংক্রমণ যখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, অনেকেই হয়তো ভেবে বসেছিলেন দেশে করোনা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি একরকম গা-ছাড়া ভাব দেখা দেয়। চারদিকে বিয়ে-শাদি, সভা-সমাবেশ, ঘোরাঘুরির ধুম পড়ে যায়।

কিন্তু, মাঝ ফেব্রুয়ারি থেকে সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করে। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে এসে সংক্রমণ ক্ষিপ্রগতিতে ঊর্ধ্বমুখী হয়। এপ্রিলের প্রথম অংশে এসে নতুন শনাক্তের সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে টানা কয়েক দিন সাত হাজারের উপরে অবস্থান করে। গত কয়েকদিন নতুন শনাক্তের সংখ্যা আপাতদৃষ্টিতে নিম্নমুখী হলেও পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। এতে মনে হতে পারে, নতুন শনাক্তের সংখ্যার এ নিম্নগতি হয়তো অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক পরীক্ষার ফল।

বিশ্বের অনেক দেশেই করোনার নতুন ঢেউ আঘাত হেনেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশেও এটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবে, ধারণা করা হচ্ছিল, এটা শীতে আসবে। কিন্তু, বাস্তবে এসেছে গরমে। তবে, নতুন এ ধাক্কার পেছনে হেতু কী? নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যবিধি মানায় সাধারণের গাফিলতি এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষিপ্রগতি এখানে ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল। অবশেষে, সিএইচআরএফ ও আইসিডিডিআর,বি পরিচালিত দুটি গবেষণা থেকে বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায়। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, সাম্প্রতিক করোনা রোগীদের ৮০-৮১ শতাংশ করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ও ১০-১২ শতাংশ যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হয়েছেন। দেশে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের যুক্তরাজ্যে ও দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয় যথাক্রমে ৬ জানুয়ারি ও ৬ ফেব্রুয়ারি। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, মার্চের ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়তে থাকে। এরপর দ্রুত এর জায়গা দখল করে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট। যার শতকরা হার মার্চের শেষ নাগাদ ৮১ শতাংশে পৌঁছে যায়। যদিও এ গবেষণাসমূহ স্বল্প সংখ্যক নমুনার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছে, তথাপি এগুলো থেকে দেশে এসব ভ্যারিয়েন্টের বিস্তৃতির সামগ্রিক গতিপ্রকৃতির একটি মোটামুটি চিত্র অবশ্যই পাওয়া যাচ্ছে।

একটি ভাইরাস যখন বংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তার প্রতিলিপি তৈরি করে, তখন মাঝে মাঝে এর জেনেটিক মেটেরিয়ালে ছোট-খাট ত্রুটি ঘটে। একেই আমরা মিউটেশন বলি এবং এভাবেই নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব ঘটে। ভাইরাস জগতে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ২০১৯ সালের শেষে আবির্ভাবের পর থেকে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের চার হাজারের অধিক ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান মিলেছে। এধরণের একটি ভ্যারিয়েন্ট কেবল তখনই বিজ্ঞানীদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন তা দ্রুত গতিতে ছড়ায়, রোগের লক্ষণে পরিবর্তন আনে কিংবা অধিক শারীরিক সমস্যা বা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, শনাক্তকরণের নিয়মিত পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে যায়, প্রচলিত ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, অথবা ক্ষেত্র বিশেষে ইতোপূর্বের সংক্রমণ কিংবা টিকা গ্রহণের ফলে কারো শরীরে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় তার প্রতি সাড়া না দেয়। এ ধরণের ভ্যারিয়েন্টগুলোকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ নামে অভিহিত করা হয়। বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের এই ধরণের চারটি ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো- যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭), দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৩৫১), ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (পি.১) ও ক্যালিফোর্নিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৪২৭ এবং বি.১.৪২৯)।

দেশে গত মার্চে ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্টও শনাক্ত হয়েছে বলে রিপোর্ট এসেছে। তবে সম্ভবত এখনও ক্যালিফোর্নিয়া ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতির কোনো তথ্য মেলেনি।

যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের ভ্যারিয়েন্ট- এদের সবগুলোর স্পাইক প্রোটিনে N501Y নামে একটি কমন মিউটেশন ঘটেছে। যা তাদেরকে মানবকোষের ACE2 রিসেপ্টরের সঙ্গে আরও ভালোভাবে আবদ্ধ হতে সাহায্য করে। এটিই এদের করোনাভাইরাসের মূল সংস্করণ (wild type)-এর চেয়ে বেশি সংক্রামক হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ।

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, মূল করোনাভাইরাসের তুলনায় যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট ৫০ শতাংশ এবং ব্রাজিলের ভ্যারিয়েন্ট ১৫০ শতাংশ অধিকতর সংক্রামক।

দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনে E484K এবং K417N নামে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশন দেখা যায়। এই মিউটেশনের কারণে করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে মূল ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এন্টিবডি ঠিক মতো যুক্ত হতে পারে না। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, ইতোপূর্বে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, এমন কেউ এই ভ্যারিয়েন্টে পুনরায় আক্রান্ত হতে পারেন। তাছাড়া, মূল করোনাভাইরাসকে টার্গেট করে ইতোমধ্যে যেসব টিকা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সুরক্ষা নাও দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. এন্থনি ফ’সির বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টটি সবচেয়ে উদ্বেগের। কারণ এতে যে মিউটেশন ঘটেছে তা একে টিকা গ্রহণ বা ইতোপূর্বে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার ফলে শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তা থেকে “লুকিয়ে” থাকতে সাহায্য করে। ফলে এর বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতা হ্রাস পেতে পারে।’ (Covid mutations could prolong the pandemic another year, health officials warn | DailyMail, Jan 29, 2021) উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রাজিলের ভ্যারিয়েন্টেও অনুরূপ মিউটেশনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে (E484K, K417T)।

এবার আসুন, রোগীর ভোগান্তি ও মৃত্যুর নিরিখে এসব মিউটেশনের অবস্থান বিবেচনা করা যাক।

যুক্তরাজ্য সরকারের নিউ অ্যান্ড ইমার্জিং রেসপিরেটরি ভাইরাস থ্রেটস এডভাইজরি গ্রুপ (নার্ভট্যাগ)-এর মতে, যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টে মৃত্যুর ঝুঁকি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট অধিকতর প্রাণঘাতী বলে প্রতীয়মান না হলেও দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা গেছে, সংক্রমণ বৃদ্ধির ফলে হাসপাতালগুলোতে চাপ বেড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে। এদেশেও দিনের পর দিন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুসারে, দেশে চিকিৎসকরা দেখছেন সম্প্রতি অনেক রোগীর দ্রুত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে (৩০ থেকে ৪০ শতাংশ) ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশেরই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। তাছাড়া, রোগের উপসর্গেও এসেছে পরিবর্তন। সর্দি-কাশি কিংবা জ্বরের মতো প্রথাগত উপসর্গের পরিবর্তে অনেকেই মাথাব্যথা, ডায়রিয়া, অস্বাভাবিক আচরণসহ নানা উপসর্গ নিয়ে আসছেন এবং টেস্টে পজিটিভ প্রমাণিত হচ্ছেন। এবারের সংক্রমণে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, তরুণরাই আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। (করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় দফা সংক্রমণে তরুণদের আক্রান্তের হার বেশি | চ্যানেল আই, মার্চ ১৬, ২০২১)

এই মুহূর্তে সম্ভবত একটি প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব ভ্যারিয়েন্ট। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে বিদ্যমান টিকাগুলো কতটুকু সুরক্ষা দিতে সক্ষম সেটা। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের মৃদু সংক্রমণ ঠেকাতে প্রায় অকার্যকর। অন্য একটি গবেষণা মতে, এক্ষেত্রে নোভাভ্যাক্সের কার্যকারিতা প্রায় ৫০ শতাংশ। তবে, তীব্র সংক্রমণের বিরুদ্ধেও অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা নোভাভ্যাক্স কতটা সুরক্ষা দিতে পারবে তা স্পষ্ট নয়। জনসন এন্ড জনসনের ভ্যাকসিন নিয়ে পরিচালিত একটি বড় পরিসরের গবেষণায় এটি দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের তীব্র সংক্রমণ রোধে ৮৫ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফাইজারের ভ্যাকসিন নিয়ে পরিচালিত একটি অপেক্ষাকৃত ছোট গবেষণায় এটি এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের মৃদু সংক্রমণ ঠেকাতেও শতভাগ কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। (Vaccines And Variants: What We Know So Far : Goats and Soda : NPR, April 09, 2021)

দেশে ইতোমধ্যে টিকাদান কর্মসূচি চালু হয়েছে। আমরা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিচ্ছি। যেহেতু, এই মুহূর্তে নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট প্রধান ভূমিকা রাখছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে, এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কার্যকারিতা প্রশ্ন সাপেক্ষ, সেহেতু আমাদের এ ব্যাপারে আরও খোঁজ-খবর নেওয়া ও বিকল্প টিকা সংগ্রহের বিষয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা দরকার।

পাশাপাশি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে এমন এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বড় পরিসরে সমীক্ষা চালিয়ে করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের অঞ্চলভিত্তিক বিস্তৃতি নির্ধারণে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। তা না হলে, টিকাদান কর্মসূচি কাঙ্ক্ষিত ফল দানে ব্যর্থ হতে পারে।

সবাই ভালো থাকুন।

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Don’t stop till the job is done

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus yesterday urged key organisers of the student-led mass uprising to continue their efforts to make students’ and the people’s dream of a new Bangladesh come true.

5h ago