বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস: আমাদের অবহেলিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
আজ বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস। ১৯৮২ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস (ICOMOS)’ তিউনিশিয়ায় একটি আলোচনা সভায় ১৮ এপ্রিলকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ সালে দিনটি ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস’ হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের তাগিদ থেকে মূলত দিনটি পালন করা হয়ে থাকে। পরিমেয় এবং অপরিমেয় উভয় সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ দেশ। পাশাপাশি, এদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যতা সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রচুর প্রত্নস্থল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও শুধুমাত্র দুটি প্রত্নস্থল তথা সোমপুর মহাবিহার এবং বাগেরহাট মসজিদ শহরকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ৫২৪টি প্রত্নস্থল সংরক্ষণ করা হয়েছে (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর)। যদিও বাংলাদেশে বর্তমানে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে অনেক ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পর্যটন শিল্পে ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবস্থাপনা’ ভয়ংকরভাবে অবহেলিত রয়ে গেছে। আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘পর্যটন ও হোটেল ব্যবস্থাপনা’র সঙ্গে পরিচিত হতে পারলেও ‘পর্যটন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবস্থাপনা’ বিষয়ের সঙ্গে এখনও পরিচিত হতে পারিনি। তবে, আশার আলো এই যে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ থেকে ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন’ নামক একটি বিষয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে।
কয়েক বছর আগেও এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ‘বাংলাদেশ অধ্যয়ন’ নামক বাধ্যতামূলক কোনো কোর্স ছিল না। যে শিক্ষার্থীরা পাস করে বের হতেন, তারা তাদের নিজের দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। সেটি জানার সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক প্রণীত বাংলাদেশ অধ্যয়ন নামক একটি বাধ্যতামূলক কোর্স। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিষয়ের জন্য বাংলাদেশ অধ্যয়ন নামক ৩ ক্রেডিটের একটা বাধ্যতামূলক কোর্স প্রণয়ন করেছে। এতে শিক্ষার্থী যে বিষয় নিয়েই স্নাতক করেন না কেন, তিনি বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বিশেষ ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মাত্র ৩ ক্রেডিটের একটি কোর্স দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে বাংলাদেশ সম্পর্কে কতটুকু জানা সম্ভব?
এক্ষেত্রে, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোতে ‘বাংলাদেশ অধ্যয়ন’ নামক একটি পৃথক বিষয় চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রেক্ষিত নিয়ে শিক্ষার্থীদের উচ্চতর গবেষণা করার সুযোগ থাকবে। বাংলাদেশ অধ্যয়ন কোর্সটি দীর্ঘদিন পড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেকেই মনে করেন যে, বিসিএসে ভাল করার জন্য এই কোর্সটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নিজের দেশ সম্পর্কে অধ্যয়ন করার উদ্দেশ্য যদি হয় শুধুমাত্র সরকারি চাকরি, তাহলে সেটি হবে দুঃখের বিষয়। একজন শিক্ষার্থী এই দেশের শেকড় অনুসন্ধান না করে শুধুমাত্র বিসিএসের প্রস্তুতির জন্য কোর্সটি পড়বে? দ্বিতীয়ত, এই কোর্সটিকে অনেকেই মনে করে থাকেন ‘রাজনৈতিক ইতিহাস’ নির্ভর কোর্স। বাংলাদেশের ‘রাজনৈতিক ইতিহাস’ পঠনের অন্যতম প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো, ‘অমুক রাজার নাম মুখস্থ করা’। অথচ, এই কোর্সের মধ্যে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, মানববসতি, ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, ভৌগলিক ও রাজনৈতিক বিষয় গভীরভাবে অনুসন্ধানের সুযোগ রয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে গভীরভাবে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ অধ্যয়ন’ নামক একটি পৃথক বিষয় চালু করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
অন্যদিকে, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন নামক একটি বিষয় গত তিন বছর ধরে পড়ানো হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি অনন্য সুযোগ। তবে, এই সুযোগটির বিস্তৃতি বৃদ্ধির জন্য শুধুমাত্র ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ নামক পৃথক বিষয় অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। কেন প্রয়োজন?
প্রথম কারণ হলো, বাংলাদেশে ইউনেস্কো স্বীকৃত দুটি বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে— বাগেরহাট ষাটগম্বুজ মসজিদ শহর ও সোমপুর মহাবিহার (পাহাড়পুর)। দুটি প্রত্নস্থল যেহেতু বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে এরই মধ্যে মর্যাদা পেয়ে গেছে, তাহলে আমরা কেন সেগুলোর জন্য বিশেষ পরিকল্পনা প্রণয়ন করবো না? এক্ষেত্রে ভারতের ‘নালন্দা মহাবিহার’-এর উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, যাকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দাবি করা হচ্ছে। ভারত সরকার প্রায় দেড় হাজার বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ বিহারটিকে আবার নতুন করে ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’ নাম দিয়ে এর কার্যক্রম শুরু করেছে। ফলে স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকরা জানতে পারছেন যে, সে দেশে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো সোমপুর মহাবিহারকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল— প্রায় ১ হাজার ২০০ বছর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য সোমপুর মহাবিহারে আসতেন। সেটি ছিল একটি আবাসিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আপাতদৃষ্টিতে আমরা খুব গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে, আমাদের সোমপুর মহাবিহার ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এ প্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষকের মধ্যে ছিলেন শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর, যার জন্ম বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে। ভারত সরকার নালন্দা মহাবিহারকে নতুন করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নাম দিয়ে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু করতে পারলে আমরা কেন আমাদের সোমপুর মহাবিহারকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে পারব না?
আমাদের আরেকটি বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো ঐতিহাসিক বাগেরহাট মসজিদ শহরের স্থাপনাসমূহ, যা পঞ্চদশ শতকে খান জাহান আলী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। সুলতানি আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে যখন ইসলামী স্থাপত্য নির্মাণ করা কঠিন ছিল, ঠিক সে সময়ে খান জাহান আলী নিজেই তার স্থাপত্যিক পরিকল্পনা দিয়ে বৃহৎ পরিসরের সুদৃশ্য ইসলামী স্থাপনা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে বাগেরহাটের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয়।
এ দুটি বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছাড়াও আমাদের আছে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন উয়ারী-বটেশ্বর নামে একটি নগর। আরও আছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ বছর আগের প্রাচীন নগর মহাস্থানগড়। এছাড়া দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শত শত প্রত্নস্থল। মুন্সীগঞ্জ জেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে ‘বিক্রমপুর বিহার’ নামে সোমপুর মহাবিহারের সমসাময়িক আরেকটি বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে। বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্ম নেয়া শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থানের পাশেই আবিষ্কৃত বিহারটি দেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ-এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগ গত তিন বছর ধরে সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার ক্ষিরতলা গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও জরিপ পরিচালনা করছে। অনুসন্ধানে লক্ষ্য করা গেছে যে, স্থানীয়রা সেখানকার প্রাচীন ধ্বংসাবশেষগুলো নিজেদের কাজে ব্যবহার করে থাকেন। একই অবস্থা লক্ষ করা গেছে মহাস্থানগড়ের পরশুরামের ঢিবিতে। বাংলাদেশ একটি অতি জনবহুল দেশ। ইচ্ছে করলেই, একটি প্রত্নস্থলকে সংরক্ষণের নামে স্থানীয়দের উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। তাহলে প্রত্নস্থল সংরক্ষণ হবে কিভাবে? এক্ষেত্রে, আমাদের প্রস্তাব হলো, যে কোন প্রত্নস্থল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্থানীয়দের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয়দের মধ্যে সেই বোধটুকু সঞ্চারিত করতে হবে যে, এই প্রত্নস্থলগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার তারাও। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যভিত্তিক পর্যটন শিল্পের বিকাশে টেকশই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। যার মাধ্যমে একদিকে দেশের প্রত্নসম্পদ সংরক্ষিত হবে এবং অন্যদিকে স্থানীয়দের অর্থ উপার্জনের একটি পথ উন্মুক্ত হবে। প্রত্নস্থল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ইউনেস্কো নীতিমালা, ভেনিস সনদ, নারা চার্টার ইত্যাদি অনেক আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনগুলো প্রয়োগের পূর্বে নিজের দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে সবকিছু আইন দিয়ে বাস্তবায়ন করা অনেক দুরুহ একটি বিষয়। প্রয়োজন হলে, প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ নীতিমালা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করুন। পরিত্যক্ত প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণের নামে ‘লিভিং হেরিটেজ’ –কে কোনভাবেই ধ্বংস করা সমীচীন হবে না।
এসব কারণে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ নামক একটি পৃথক বিষয়ের পঠন জরুরি বলে মনে করি যেখানে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ ও পুনরানয়নের উপর গভীরভাবে গবেষণা করার সুযোগ ঘটবে। পাশাপাশি, পর্যটন শিল্পের সাথে এদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহের সমন্বয় ঘটাতে হবে। আমরা জাতিগতভাবে ‘অতিথিপরায়ণ জাতি’ হিসেবে পরিচিত। শুধুমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে, বাংলাদেশ হবে পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম প্রধান গন্তব্য।
মো. রিফাত-উর-রহমান, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments