পোল্ট্রি শিল্পে বিপর্যয়ের আশঙ্কা
করোনার কারণে গত বছরের অর্থনৈতিক ক্ষতির ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই নতুন লকডাউনে ফের বিপাকে পড়তে হয়েছে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের পোল্ট্রি খামারিদের। করোনার প্রথম ঢেউয়েই ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়ে অনেক ব্যবসায়ীকে তাদের ব্যবসা সংকুচিত করতে হয়। অনেকের ব্যবসাই বন্ধ হয়ে যায়।
গত বছরের ডিসেম্বর থেকে আবারও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান শুরু হতে থাকায় এবং পর্যটন খাত চাঙা হয়ে ওঠায় পোল্ট্রি মুরগি ও ডিমের চাহিদা বাড়তে থাকে। খামারিরাও লোকসান কাটিয়ে উঠতে বেশি দামে মুরগি বিক্রি করতে শুরু করেন।
খামার পর্যায়ে প্রতি কেজি সোনালি মুরগির দাম ১৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়। আর ব্রয়লার মুরগির কেজি ১০০ টাকা থেকে হয়ে যায় ১৩০ টাকা।
চলতি মাসের পাঁচ তারিখ থেকে সাত দিনের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে সরকার। তখন থেকেই খুচরা বাজারে পোল্ট্রি পণ্যের দাম কমে যায়।
গতকাল শনিবার খামার পর্যায়ে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১২০ টাকা ও প্রতি কেজি সোনালি মুরগি ২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
এছাড়া লাল ডিম প্রতিটি পাঁচ টাকা চার পয়সায় ও সাদা ডিম চার টাকা চার পয়সায় বিক্রি হয়।
গত ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। একইদিন থেকে রমজানও শুরু হওয়ায় পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের আরও বেশি লোকসানে পড়তে হয়। স্বাভাবিক সময়েও রমজানে সাধারণত বেকারি ও কনফেকশনারিগুলোতে ডিমের চাহিদা কমে যায়। ফলে রমজানে দাম কমে যায় ডিমের।
এছাড়া লকডাউনও ডিমের বিক্রি কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ বলে মনে করেন পোল্ট্রি খামারি শিমুল হক রানা।
রানা বলেন, ‘প্রতি পিস সাদা ডিমে খামারিদের তিন টাকা করে লোকসান হচ্ছে। পরিস্থিতি যদি এমনই থাকে, তাহলে পোল্ট্রি খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের (বিপিকেআরজেপি) তথ্য অনুসারে, দেশে প্রায় ৯৮ হাজার পোল্ট্রি খামারি রয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৮ শতাংশ মহামারিকালে খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
পোল্ট্রি ব্যবসায় ডিম ও মাংস উৎপাদন এবং হ্যাচিংয়ের মতো কয়েকটি ভাগ রয়েছে। বড় খামারগুলোতে সবগুলো কাজ করা হলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারগুলোতে সাধারণত এগুলোর একটি বা দুটি কাজ করা হয়।
মহাতাব আলি মণ্ডল নামের এক ব্যবসায়ী জানান, জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে তার হ্যাচারি ব্যবসা আছে। বাচ্চা ফুটানোর জন্য তিনি ১৮ টাকা দরে সোনালি মুরগির ডিম কিনেছেন। আর তার হ্যাচিং খরচ হয়েছে পাঁচ টাকা। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা ২৫ টাকা বা তারও বেশি দামে বিক্রি করা যাবে বলে ধারণা করেছিলেন তিনি।
কিন্তু লকডাউনের কারণে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দাম নেমে এসেছে মাত্র আট থেকে নয় টাকায়। ফলে শুধু এক ব্যাচ হ্যাচিংয়েই প্রায় দুই লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে তাকে।
এক দশক ধরে পোল্ট্রি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত মহাতাব আলি বলেন, ‘১৬টি ব্যাচ হ্যাচিং করার সক্ষমতা আছে আমার। কিন্তু দাম পড়ে যাওয়ার পর হ্যাচিং বন্ধ করে দিয়েছি।’
শুধু মহাতাবই নন, গত বছর একই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন আরও অনেক খামারি। ফলে সীমিত আকারে মুরগি হ্যাচিং করেছেন তারা।
মোহাম্মদ সুরুজ শেখ ডিমের ব্যবসা করেন। বগুড়ায় সততা পোল্ট্রি খামার নামে একটি ডিমের খামার আছে তার। তিনিও জানান, মুরগির বাচ্চার দাম অনেক বেশি কমে গেছে। সুরুজ শেখ বলেন, ‘যদি খুচরা বাজারে মুরগির দাম ১০ শতাংশ বাড়ে, তাহলে বাচ্চার দাম প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।’
কোভিড-১৯ এর প্রভাব ছাড়াও মৌসুমি রোগবালাই ও মুরগির খাবারের দাম বাড়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামার ব্যবসায়ীদের ক্ষতি আরও বেড়েছে। গত মাসে মৌসুমি রোগে মহাতাব আরও ১২ লাখ টাকার লোকসানের মুখে পড়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমার খামারে ছয় হাজার মুরগি ছিল। হঠাৎ করেই তিন-চারটা মারা গেলো। তাই অন্যগুলোর কিছু হওয়ার আগেই আমি তাড়াহুড়ো করে সব বিক্রি করে দিয়েছি।’
বিপিকেআরজেপির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মহসিন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, অনেক খামারিই পরপর দুবারের লোকসানের ধাক্কা সামলে উঠতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত হয়তো পোল্ট্রি ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে তাদের।
লকডাউনের সমস্যার পাশাপাশি মুরগির খাবারের দাম বাড়ায় ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়েছে। টেস্টিং কিটের অভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রচুর মুরগির খাবার ছাড়পত্র পাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
খন্দকার মহসিন বলেন, ‘ছাড়পত্র দেওয়ার আগে এসব খাবার পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু টেস্টিং কিটের অভাবে গত চার থেকে পাঁচ মাস ধরে এগুলো পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।’
খাবার পরিবহন খরচ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের সভাপতি মশিউর রহমান বলেন, ‘পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা গত বছরের লোকসান থেকে বের হয়ে এসে ব্যবসায় লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু নতুন লকডাউনে আবারও লোকসানে পড়তে হচ্ছে তাদের।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমনও হয়েছে যে, দাম কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা ঢাকার বাজার থেকে মুরগি ফেরত নিয়ে গেছেন। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে এটা পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ পোল্ট্রি খামারি সরকারের কাছ থেকে ১০ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত নগদ প্রণোদনা পেয়েছেন।
খন্দকার মহসিন বলেন, ‘এ প্রণোদনা হয়তো ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কিছুটা সাহায্য করবে। কিন্তু যদি করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে, তবে পোল্ট্রি খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে।’
Comments