‘কবরীকে দেখলে মনে হতো পাশের বাড়ির খুব আপনজন’
সদ্য প্রয়াত হয়েছেন মিষ্টি মেয়ে খ্যাত ঢাকাই সিনেমার সফল নায়িকা কবরী। ১৯৬৪ সালে সিনেমায় তার আগমন হয়েছিল সুতরাং সিনেমা দিয়ে। আজ কবরী বেঁচে নেই। কিন্তু, তিনি বেঁচে আছেন এদেশের মানুষের মনে। তাকে নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের কাছে স্মৃতিচারণ করেছেন উজ্জল, সোহেল রানা, ববিতা, সুজাতা, তারিক আনাম খান, রোজিনা।
জীবনের প্রথম নায়িকা হিসেবে কবরীকে পেয়েছিলাম: উজ্জল
আমার প্রথম সিনেমার নায়িকা ছিলেন কবরী। তখন আমি একেবারেই নতুন। টেলিভিশনে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক করেছি। সিনেমায় প্রথম, অন্যদিকে কবরী তখন তুমুল জনপ্রিয় নায়িকা। সারাদেশের মানুষ তাকে চেনেন।
আমার প্রথম সিনেমার নাম বিনিময়। সুভাষ দত্ত আমাকে কবরীর বিপরীতে নায়ক বানান। জীবনের প্রথম নায়িকা হিসেবে কবরীকে পেয়েছিলাম।
প্রথম শুটিং ছিল আউটডোরে। নতুন নায়ক হিসেবে আমি আউটডোরে আগে চলে যাই। চারদিকে শুধু এক কথা কবরী আসছেন, কবরী আসছেন। তারপর কবরী এলেন। চারপাশ যেন আলোকিত হয়ে উঠল। কবরী এমনই একজন আলোকিত নায়িকা ছিলেন। নতুন নায়ক হলেও তিনি আপন করে নিলেন। সেটা সারাজীবন ছিল।
কবরী প্রযোজিত বলাকা মন সিনেমায় আমাকে নায়ক করেন কবরী। বলাকা মন সিনেমাও সুভাষ দত্ত পরিচালনা করেছিলেন। এই সিনেমা করতে গিয়ে কত স্মৃতি আমাদের। সব স্মৃতি আজ মনে পড়ছে।
কবরী ছিলেন সত্যিকারের নায়িকা। সত্যিকারের শিল্পী। শতভাগ বাঙালি বলতে যা তাই ছিলেন। তার বড় আকর্ষণ ছিল এটাই, তাকে দেখলে মনে হত পাশের বাড়ির খুব আপনজন। বাঙালির নারীর সবগুণ কবরীর মধ্যে ছিল।
কবরী নিজেকে নিজে গড়েছিলেন। সিনেমার নায়িকা থেকে রাজনীতির সবচেয়ে চূড়ান্ত জায়গায় এমপিও হয়েছিলেন। কবরীর চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে দেশের চলচ্চিত্র একজন অভিভাবককে হারাল।
কবরী ছিলেন সত্যিকারের লিজেন্ড: সোহেল রানা
আমরা বলি শিল্পী। কিন্ত সবাই কি শিল্পী? কবরী ছিলেন সত্যিকারের শিল্পী। আমরা লিজেন্ড বলি? সবাইতো লিজেন্ড না। কবরী ছিলেন সত্যিকারের লিজেন্ড। কবরী ছিলেন আনপ্যারালাল। কবরী এই বাংলার মেয়ে। বাঙালি মেয়ে বলতে যা বোঝায় কবরী তাই ছিলেন।
আমার প্রথম পরিচালিত সিনেমা মাসুদ রানা। এই সিনেমার নায়ক ছিলাম আমি। প্রযোজকও আমি। তখন আমি প্রথম সিনেমার নায়িকা খুঁজছিলাম। কেউ কেউ অনীহা দেখিয়েছেন। কিন্ত, যখন কবরীর কাছে যাই, তিনি ফিরিয়ে দেননি আমাকে।
কবরী বলেছিলেন, আমি আপনার সঙ্গে কাজ করব। এটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিলাম। তারপর তো কাজ করি। মাসুদ রানা হিট হয়।
কবরীর প্রযোজনায়ও কাজ করেছি। বড় কথা হচ্ছে তার মধ্যে শেখার আগ্রহটা ছিল। এজন্যই তিনি এত বড় শিল্পী হতে পেরেছিলেন। প্রবল ভালোবাসা ও আগ্রহ না থাকলে এটা পারতেন না।
শিল্পের বাইরে রাজনীতি করতে গিয়েও সফলতা পেয়েছিলেন তিনি।
কবরীর অভিনয় নিয়ে বলব- কবরী যা করতেন তাই ছিল অভিনয়। ওর সবকিছুতে ক্যামেরার ভাষাটা বোঝার ক্ষমতা ছিল। অন্যদের অভিনয় করতে হয়, কবরীর করতে হত না। বরং কবরী যা করতেন তাই অভিনয় হয়ে উঠত। এই অসাধারণ ক্ষমতা সবার ভেতরে থাকে না।
কবরী আপার জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে যেতাম: ববিতা
খুব করে আশায় ছিলাম কবরী আপা ফিরে আসবেন। কখনোই ভাবিনি এমনটি ঘটবে। মনটা ভেঙে গেছে। লাইফ সাপোর্ট থেকে অনেকেই ফিরে এসেছেন। কবরী আপার বেলায়ও তাই ভেবেছিলাম। আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলাম। রাত থেকে খবরটি শোনার পর মনটা সত্যি সত্যি ভেঙে গেছে।
স্মৃতির তো শেষ নেই তার সঙ্গে। সর্বশেষ রাজা সূর্য খাঁ সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় করেছিলাম। মনে আছে, কবরী আপা তখন সংসদ সদস্য। আমি তাকে ফোন করে রাজি করিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আপা আসুন দু’জনে মিলে রাজা সূর্য খাঁ সিনেমাটি করি।
রাজা সূর্য খাঁ সিনেমা করার সময় এফডিসিতে অনেক স্মৃতি আছে। অনেক আড্ডা দিয়েছি। আমি সে সময় বাসা থেকে খাবার রান্না করে নিয়ে যেতাম। দু’জনে একসঙ্গে খেতাম। তিনি খুব খুশি হতেন।
মস্কোতে চলচ্চিত্র উৎসবে রাজ্জাক, কবরী, আমি, খান আতাসহ একসঙ্গে যাওয়ার অনেক স্মৃতি আছে। অনেক গল্প করেছি তখন।
আজ সব ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। একটি সময়ের ইতিহাস ছিলেন তিনি। সেই ইতিহাসের সমাপ্ত হলো। কিন্তু, চলে যাওয়া মানেই সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়। কবরী আপা বেঁচে থাকবেন যতদিন এ দেশের সিনেমা থাকবে।
বড় মনের মানুষ ছিলেন কবরী: সুজাতা
কবরী এদেশের অন্যতম প্রধান নায়িকা ছিলেন। তার ভাগ্যে মিষ্টি মেয়ে তকমা জুটেছিল। তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। যার ফলে এত বড় নায়িকা হতে পেরেছিলেন। বহুবছর রাজত্ব করে গেছেন এদেশের সিনেমায়। এটা কজনের ভাগ্যে জুটে?
সবকিছু ছাড়িয়ে কবরী ছিলেন বড় মনের মানুষ। বড় হৃদয়ের মানুষ। তার সঙ্গে না মিশলে এটা বুঝতে পারতাম না। মানুষ হিসেবে, শিল্পী হিসেবে অনেকেই বড় হোন, কিন্তু, বড় মনের কজন হতে পারেন? কবরী সেটা হতে পেরেছিলেন।
অনেকদিনের রিলেশন ছিল তার সঙ্গে। আমরা এক এক করে প্রিয়জনদের হারাচ্ছি। হুট করে এভাবে কবরী চলে যাবেন ভাবিনি। তার জন্য মনটা ছটফট করছে।
তারপরও কবরীর জন্য আমার ভালোবাসা চিরকাল থাকবে। তার জন্য দোয়া করব মন ভরে ।
সুতরাং দেখে কেঁদেছিলাম: তারিক আনাম খান
আমার প্রথম সিনেমার নায়িকা কবরী। সিনেমার নাম লাল সবুজের পালা। পরিচালক সৈয়দ হাসান ইমাম।
হঠাৎ করেই পরিচালক আমাকে নায়ক বানিয়ে দিলেন। তাও আবার কবরীর সঙ্গে। আমি তো অবাক? সংকোচ ও ভয় দুটিই কাজ করছে।
কবরী সেটে যাওয়ার পর মিষ্টি হেসে আমাকে বললেন, এই যে কাছে আসেন, এইটা এভাবে করেন, এভাবে বলেন।
ব্যস। করা হলো। একসময় তিনি বললেন, আপনি তো ভালোই অভিনয় করেন । এটা বলেছিলেন বিটিভির ধারাবাহিক নাটক মাটির কোলেতে অভিনয় করার পর। ওই নাটকে আমরা একসঙ্গে অভিনয় করেছিলাম।
তার অভিনীত সুতরাং সিনেমা দেখে কৈশোরে কেঁদেছিলাম। এবার ভেবেছিলাম তিনি ভালো হয়ে যাবেন। কিন্তু তা আর হলো না।
চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি: রোজিনা
কবরী আপা আপনিও চলে গেলেন? সবাই চলে যাব একদিন, কিন্তু, এত তাড়াতাড়ি কেন চলে গেলেন? কত কি দেওয়ার বাকি ছিল এখনো। আপনার নতুন স্বপ্নের কাজটি শেষ করেও যেতে পারলেন না। আপনার চলে যাওয়ার খবরটি পাওয়ার পর থেকে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। অনেক কান্না করেছি।
আকাশের ঠিকানায় ভালো থাকবেন প্রিয় কবরী আপা। আপনি যখন স্টার, তখন আমি সিনেমা জগত থেকে বহুদূরে। আপনার নাম কে না জানে? সেই সময়ে আপনার সিনেমা কে না দেখেছে? বাংলার ঘরে ঘরে আপনার নাম। আমিও আপনার নাম জেনেছি একটা সময়ে।
তারপর সিনেমায় এলাম। নতুন আমি। আপনার সঙ্গে পরিচয় হলো একসময়। কতই না আপন করে নিলেন। এটাই বুঝি শিল্পী হৃদয়। যার জন্য আপনি এত বড় শিল্পী হতে পেরেছিলেন। আপনার তুলনা আপনি নিজেই।
Comments