ওমানে পাসপোর্ট ভোগান্তিতে বাংলাদেশিরা

ওমানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে হঠাৎ করেই যেন ‘সোনার হরিণ’ হয়ে উঠেছে পাসপোর্ট। নবায়নের জন্য দেওয়া পাসপোর্ট সময় মতো না পেয়ে সীমাহীন ভোগান্তিতে আছেন হাজারো বাংলাদেশি কর্মী।
ওমানের রাজধানী মাস্কাটে বাংলাদেশ দূতাবাস। ছবি: এজাজ মাহমুদ

ওমানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে হঠাৎ করেই যেন ‘সোনার হরিণ’ হয়ে উঠেছে পাসপোর্ট। নবায়নের জন্য দেওয়া পাসপোর্ট সময় মতো না পেয়ে সীমাহীন ভোগান্তিতে আছেন হাজারো বাংলাদেশি কর্মী।

এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকা প্রবাসীদের কষ্টের সঙ্গে ক্ষোভ যেমন বাড়ছে, তেমনি ব্যাপক চাপে রয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস ও সার্ভিস কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা মানি এক্সচেঞ্জগুলো।

এমন পরিস্থিতির পেছনে ঢাকা থেকে পাসপোর্ট সরবরাহের ধীর গতিকে দায়ী করা হলেও চলতি মাসেই সংকট কেটে যাবে, এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর।

প্রবাসীরা বলেন, গত ছয় থেকে সাত মাস ধরে পাসপোর্ট সংকট দেখা দিয়েছে ওমানে। দেশে যাতায়াতে ছাড়াও ভিসা, আকামা বা রেসিডেন্ট পারমিট কার্ড, এটিএম কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নসহ নানা জরুরি কাজে ভোগান্তিতে পড়েছেন তারা।

এছাড়াও চিকিৎসা, শিক্ষা, বিভিন্ন পরিষেবা ও আইনি ঝামেলা এড়াতে রেসিডেন্ট কার্ডের প্রয়োজন অনেকগুন বেড়েছে করোনাকালে। কিন্তু পাসপোর্ট নবায়নের দীর্ঘসূত্রিতায় কোনো কিছুই করতে পারছেন না তারা।

ছয় মাস আগে বাংলাদেশ দূতাবাস অনুমোদিত এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে পাসপোর্ট নবায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন মো. পারসুল আলম। সালালার এই বাংলাদেশি বিপণন কর্মী বলেন, ‘তিন মাস ধরে নিয়মিত এক্সচেঞ্জে ধর্না দিয়ে একটাই বার্তা পাচ্ছি, “আপনার পাসপোর্ট প্রিন্টিং প্রসেসিংয়ে আছে।” কিন্তু প্রিন্ট হয়ে কবে হাতে আসবে সেই উত্তর দিতে পারছে না এক্সচেঞ্জ বা দূতাবাস।’

তিনি আরও বলেন, ‘পাসপোর্টের জন্য দেশেও ফিরতে পারছি না, প্রবাসে বসে বেতনের টাকাও তুলতে পারছি না। বেতন আসে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে, তুলতে হয় এটিএম কার্ড দিয়ে। মেয়াদোত্তীর্ণ কার্ড নবায়ন করতে পাসপোর্ট দরকার।’

আরেক বাংলাদেশি কর্মী মেহেদি হাসান পাসপোর্ট না পাওয়ায় ভিসা ও আকামা (ওয়ার্ক পারমিট) নবায়ন করতে পারছেন না। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, ‘দুমাস ধরে আমি ভিসা ছাড়া আছি। যা অবৈধ অভিবাসীর সংজ্ঞায় পড়ে। সাধারণ প্রবাসীর সুবিধা পাওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়েছে।’

আকামা নবায়ন না হলে প্রতিমাসে জরিমানা গুনতে হয়। যদিও করোনাকালে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছে।

তবে বড় সমস্যা হচ্ছে ওমানি কোম্পানিগুলোতে বাংলাদেশি কর্মীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব। সময় মতো ভিসা নবায়ন না হলে কোম্পানিগুলোকে দেশটির শ্রম দপ্তরকে কৈফিয়ত দিতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে কালো তালিকাতেও পড়তে হয়।

এসব তথ্য জানিয়ে চট্টগ্রাম সমিতি ওমানের সভাপতি ও দেশে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে এনআরবি-সিআইপির সরকারি মর্যাদা পাওয়া মোহাম্মদ ইয়াছিন চৌধুরী বলেন, ‘করোনাকালে রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রবাসীরা যখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হতাশায় আছেন, সেখানে পাসপোর্ট নিয়ে এমন ভোগান্তি প্রবাসীদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কী কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি তাদের প্রতিদিন হতে হচ্ছে তা বলে বোঝানো যাবে না।’

ওমান সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, প্রায় পাঁচ লাখ ৪৭ হাজার কর্মী নিয়ে দেশটির বৃহত্তম প্রবাসী গোষ্ঠী বাংলাদেশিরা। এই পরিসংখ্যানের বাইরে পরিবারের সদস্য ও আকামাবিহীন প্রবাসী মিলিয়ে সাত লাখের ওপরে বাংলাদেশি রয়েছেন দেশটিতে।

ওমানের রাজধানী মাস্কাটে বাংলাদেশ দূতাবাসে একজন কাউন্সেলরের অধীনে থাকা পাসপোর্ট শাখা প্রবাসীদের সেবা দিয়ে থাকে। তারা নবায়ন বা নতুন পাসপোর্ট আবেদন এনরোলড করে ঢাকায় পাসপোর্ট অধিদপ্তর পাঠান। ঢাকা থেকে প্রিন্ট হয়ে যাওয়ার পরই প্রত্যাশীদের মধ্যে পাসপোর্ট বিতরণ করা হয়।

তবে এমন দীর্ঘ জটের রেকর্ড এর আগে ছিল না।

প্রবাসীরা জানান, সাধারণত ৪৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পাওয়া যেত। করোনাকালে এসে তা তিন মাসে গড়ায়। তবে এই সময়ে বাংলাদেশি দুটি মানি এক্সচেঞ্জকে আবেদন গ্রহণ ও পাসপোর্ট বিতরণের দায়িত্বে আনায় সেবা অনেকটা সহজ হয়। কিন্তু, গত নভেম্বরে হঠাৎ করেই পাসপোর্ট বিতরণে স্থবিরতার দেখা দেয় এবং ফেব্রুয়ারি-মার্চে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।

এক্সচেঞ্জ সূত্র বলছে, আগে প্রতিমাসে সাত থেকে আট হাজার, অনেক সময় ১০ হাজার পর্যন্ত পাসপোর্ট বিতরণ হতো। তা কমে হয়েছে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০।

এ বিষয়ে গাল্ফ ওভারসিজ এক্সচেঞ্জের সিইও ইফতেখার হাসান চৌধুরী বলেন, ‘গত জুনে দায়িত্ব পাওয়ার পর করোনার কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা দূতাবাসের পাসপোর্ট শাখার সঙ্গে সমন্বয় করে রাত-দিন প্রবাসীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই গত বছরের শেষে এসে অপ্রত্যাশিত “জট” লেগে যায়। এ বছরের শুরুতে সেটা আরও জটিল হয়ে ওঠে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সময় মতো পাসপোর্ট ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের কাছে বিব্রতকর অবস্থার  মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিলম্বের কারণে হিসেবে জানতে পারি, এমআরপি বই সংকটের কারণে ঢাকা থেকে পাসপোর্ট সরবরাহ স্থবির হয়ে পড়েছে।’

ঢাকা থেকে সরবরাহে ধীরগতির কথা জানিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (পাসপোর্ট) আবু সাইদ বলেন, ‘মার্চে মুদ্রণে প্রায় ৩০ হাজার পাসপোর্ট ঢাকায় আটকা পড়ে।  আমরা বারবার তাগাদা দেই। এমআরপি বই সংকটের কারণে আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও অধিদপ্তর সময় মতো পাসপোর্ট সরবরাহ করতে পারেনি বলে এই সংকট দেখা দেয়। এটা আগে কখনো হয়নি।’

তিনি জানান, এমন পরিস্থিতিতে ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মিজানুর রহমান চিঠি দিয়ে এবং ফোনে পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে তাগাদা দিয়ে জট খোলার ব্যবস্থা করেন।

‘গত দুসপ্তাহে পাসপোর্ট আসার পরিমাণ বাড়ছে। ফলে জট খুলতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ১০ হাজার পাসপোর্ট আমরা পেয়ে গেছি এবং দ্রুত বিতরণও শুরু করেছি। এখন প্রায় ২০ হাজার পাসপোর্ট ঢাকায় মুদ্রণ প্রক্রিয়ায় আছে। আমরা আশা করছি করোনা পরিস্থিতির অবনতিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা না হলে চলতি মাসের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে পাসপোর্ট সেবা,’ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন কাউন্সেলর পাসপোর্ট।

প্রবাসীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক (পাসপোর্ট ও বিচার) সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর করোনাকালের কঠিন সময়েও আমরা শুধুমাত্র প্রবাসীদের জন্য নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে গেছি। বছরের শেষে এবং এ বছরের শুরুতে এসে ই-পাসপোর্ট যুগে প্রবেশের পদ্ধতি ও কৌশলগত কারণে এমআরপি বইয়ের সাময়িক সংকট দেখা দেয়। ফলে কিছু জট দেখা দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু তা সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। ওমানসহ বাংলাদেশের সব মিশনেই সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে আসছে।’

এক্সচেঞ্জ হাউস ও প্রবাসীরা বলেন, এ মাসের শুরু থেকে  পাসপোর্ট বিতরণে কিছুটা গতি দেখা যাচ্ছে। তবে আগের মতো স্বাভাবিক নয়। পাঁচ থেকে ছয় মাস আগের আবেদন করা অনেকের পাসপোর্ট এখনও পৌঁছেনি।

মোহাম্মদ ইয়াছিন চৌধুরী বলেন, ‘এখন যে গতিতে বিতরণ চলছে তাতে এই মাসের মধ্যে অপেক্ষমাণ সবাই পাসপোর্ট পাবেন বলে মনে হচ্ছে না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়াও অনেকে ঈদকে সামনে রেখে দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। তাছাড়া এরই মধ্যে নতুন অনেকের নবায়ন আবেদনও জমা পড়েছে। কাজেই পাসপোর্ট অধিদপ্তর যদি আগের আটকে পড়া পাসপোর্ট দ্রুত প্রিন্ট করে একসঙ্গে ওমান পাঠানোর বিশেষ ব্যবস্থা করে, তবে সংকট সহনীয় হয়ে আসবে।

তিনি আরও বলেন, ‘আশা করি প্রবাসীদের স্বার্থে পাসপোর্ট অধিদপ্তর সেটা করবে।’

এজাজ মাহমুদ: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

12h ago