‘আগে খাবার দিন, তারপর লকডাউন বাস্তবায়ন করুন’

‘লকডাউন ঘোষণা করা খুব সোজা। কিন্তু, এর যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় আমাদের মতো মানুষদের। আগে খাবার দিন। তারপর লকডাউন বাস্তবায়ন করুন।’
ছবি: পলাশ খান

‘লকডাউন ঘোষণা করা খুব সোজা। কিন্তু, এর যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় আমাদের মতো মানুষদের। আগে খাবার দিন। তারপর লকডাউন বাস্তবায়ন করুন।’

কথাগুলো বলছিলেন মো. হোসেন। নিম্ন আয়ের এই হকার ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় রাস্তার পাশে সানগ্লাস ও মানিব্যাগ বিক্রি করেন। গত সপ্তাহে তিনি কখনোই তার অস্থায়ী দোকানটি পুরোপুরি খোলা রাখতে পারেননি।

হোসেন বলেন, ‘এ সময় পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে কিছু সময়ের জন্যে দোকান খোলা রাখতে পারলেও জিনিস কেনার মতো কোনো ক্রেতা ছিল না।’

জীবিকার টানে কুমিল্লার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসা হোসেনের পকেট এই মুহূর্তে পুরোপুরি খালি। গত বছরের শুরুর দিকে লকডাউনের সময়কার দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে হোসেন জানান, আয় না থাকায় সে সময় তিনি বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। পুরো দুই মাস ছিলেন কর্মহীন।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে হতাশ হোসেন বলেন, ‘সে সময় ১১ জনের সংসার চালাতে আমাকে অন্যের কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়েছিল। সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা আমরা পাইনি। শুনেছি সরকার সে সময় ত্রাণ দিয়েছিল। আমরা কিন্তু তা চোখেও দেখিনি।’

গতকাল সোমবার হোসেনের সঙ্গে আলাপের সময় ফার্মগেট এলাকায় এমন অনেক হকারকেই পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে দোকান খোলা রাখার চেষ্টা করতে দেখা গেল।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার চলমান লকডাউনের মেয়াদ আগামী ২২ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নতুন করে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে হোসেনের মতো নিম্ন আয়ের মানুষদের কপালে।

হকার, রিকশা কিংবা অটোরিকশাচালকের মতো দিন এনে দিন খাওয়া এই মানুষদের শঙ্কা, সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটবে তাদের! তারা বলছেন, কাজ করতে না পারলে পরিবারসহ হয়তো সবাইকে না খেয়েই থাকতে হবে।

নগরের নিম্ন আয়ের এই মানুষদের ভাষ্য, স্বাস্থ্য সুরক্ষার চেয়ে জীবন-জীবিকার এই সংকটই বেশি ভোগাচ্ছে তাদের।

সপ্তাহব্যাপী চলমান এই ‘সর্বাত্মক লকডাউনে’ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রতিদিন সড়কে রিকশা ও অটোরিকশা চলাচল বাড়ছে। আর এই চলাচল থামাতে চেকপোস্টগুলোতে যে পুলিশি তৎপরতা চলছে, সেটাকে এক ধরনের হয়রানিই বলছেন চালকেরা।

দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছিল চলমান লকডাউন অনেকটা শিথিল হয়ে আসছে। গতকাল সোমবার লকডাউনের ষষ্ঠ দিনে সড়কে পাবলিক বাস ছাড়া প্রায় সব ধরনের যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়। লোক চলাচলও বাড়ে।

দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল লোকেরা বলছেন, ঘরে থাকতে তাদের সমস্যা নেই। কিন্তু, এক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারকে খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।

মোশাররফ ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী একটা বাসে হেলপার হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু, এই মহামারি তার পেশা বদলে দেয়। গত বছরের লকডাউনে কাজ হারানো মোশাররফ ঢাকায় রিকশা চালাতে শুরু করেন।

মোশাররফ বলেন, ‘গত বছর আমরা অনেক সচ্ছল মানুষের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছি। রাস্তাতেই অনেকে রিলিফের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কিন্তু, এবার আমাদের সাহায্য করার মতো কেউ নেই, কিছু নেই। আর একদিনের জন্যে রিকশা চালানো বন্ধ রাখলে হয়তো পরিবারের সবাইকে নিয়ে না খেয়েই থাকতে হবে।’

মহামারিতে জীবন পাল্টে যাওয়া এই ব্যক্তির জিজ্ঞাসা, ‘এখন আমি দৈনিক তিন-চার শ টাকা আয় করতে পারি। ঘরভাড়া দিতে হয় চার হাজার টাকা। তিনটা বাচ্চা। এখন যদি লকডাউন এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে আমি সংসার চালব কীভাবে?’

ফার্মগেট এলাকায় কথা হয় আরেক রিকশাচালক নুরুল ইসলামের সঙ্গে। তার বাড়ি জামালপুর। গতকাল বিকেলে রিকশার ওপরেই তাকে অলস বসে থাকতে দেখা গেল।

নুরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘রাস্তায় মানুষ নাই। প্যাসেঞ্জার পাওয়াই ভাগ্যের বিষয় এখন। আগে ফার্মগেট থেকে গাবতলী পর্যন্ত যাইতে আড়াই শ টাকা নিতাম। এখন ৬০ টাকা দিতে চায়।’

তারা সবাই বলছেন, এই বর্ধিত লকডাউন তাদের জন্য অভিশাপ।

অটোরিকশাসহ হালকা যানবাহনের চালকেরা লকডাউনে টিকে থাকার জন্যে সরাসরি খাদ্য ও আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছেন সরকারের কাছ থেকে।

এক যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ অটোরিকশা লাইট ভেহিক্যাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি আবুল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম ফারুক বলেন, ‘চলমান লকডাউনে এক লাখের বেশি অটোরিকশা ও হালকা যানের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। যা আমাদের গুরুতর সমস্যার মধ্যে ফেলেছে। আমরা কর্মহীন হয়ে পড়েছি। যা দেখা যাচ্ছে, তাতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে এখন না খেয়ে থাকতে হবে।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) এক নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, চলমান মহামারিতে তিন শতাংশের বেশি শ্রমজীবী মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছেন। নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন দেড় কোটির বেশি মানুষ।

ওই গবেষণার তথ্য বলছে, মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় সবচেয়ে বেশি আছেন শহর এলাকায় নির্মাণকাজ ও অনানুষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক, রিকশাচালক এবং লঞ্চ ও নৌ-খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।

পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতা, হকার, চা বিক্রেতা, খাবারের দোকানের মালিক ও সারাইকারীদের অবস্থাও ভালো নয়।

Comments

The Daily Star  | English

9 die of dengue

Highest single-day deaths this year

1h ago