বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় ত্বীন ফল

ত্বীন ফল বাংলাদেশে ডুমুর হিসেবেই বেশি পরিচিত। ইংরেজিতে ত্বীন ফলকে বলা হয় The Fig। বৈজ্ঞানিক নাম ficus carica L., (Moraceae)। genus ficus। সৌদি আরবে এই ফলকে ত্বীন নামে ডাকলেও ভারত, তুরস্ক, মিসর, জর্দান ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে এটি আঞ্জির নামে পরিচিত।
কিশোরগঞ্জের হর্টিকালচার বাগানে উৎপাদিত ত্বীন ফল। ছবি: শামীম আহমেদ

ত্বীন ফল বাংলাদেশে ডুমুর হিসেবেই বেশি পরিচিত। ইংরেজিতে ত্বীন ফলকে বলা হয় The Fig। বৈজ্ঞানিক নাম ficus carica L., (Moraceae)। genus ficus। সৌদি আরবে এই ফলকে ত্বীন নামে ডাকলেও ভারত, তুরস্ক, মিসর, জর্দান ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে এটি আঞ্জির নামে পরিচিত।

ত্বীন একটি পুষ্টি সমৃদ্ধ সুস্বাদু ফল, যা মরু অঞ্চলে ভালো জন্মে। চরম জলবায়ু অর্থাৎ শুষ্ক ও শীতপ্রধান দেশে চাষ হলেও বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতেও ৩৬৫ দিন এ ফল উৎপাদন সম্ভব। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়ার সঙ্গে বেশ মানিয়ে নিয়েছে ত্বীন। শুধু তাই নয় ব্যাপকভাবে চাষ হওয়ায় আমাদের সারাবছরের পুষ্টি ও ফলের চাহিদা পূরণ করে ত্বীন বা ডুমুর রপ্তানির সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

আজকাল কৃষকদের নিজের গাছ বা বাগান থেকে তাজা ফলের স্বাদ নেওয়ার আগ্রহ জমেছে অনেকের। এ ধরনের নির্দিষ্ট বাজারকে কেউ কেউ ফার্ম ফ্রেশ বা অর্গানিক বাগান নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এগ্রো টুরিজমও গড়ে উঠেছে। এসব বাগানে অনেক প্রকৃতির এক্সোটিক ফল বা গৌণ ফলের চাষাবাদ হচ্ছে। ত্বীন বা ডুমুরও তেমন একটি এক্সোটিক ফল।

ডুমুরের অনুমোদিত কোনো জাত নেই। তবে বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে যে ডুমুরের যে গাছগুলো হয় সে ডুমুরগুলো হলো জগডুমুর। এর বৈজ্ঞানিক নাম Ficus racemosa। জগডুমুরের বিভিন্ন প্রজাতি আছে। কোনোটি বিশ-ত্রিশ গ্রাম, আবার কোনোটি পঞ্চাশ-ষাট গ্রাম ওজনের হয়। পাকলে কোনোটি লাল, আবার কোনোটি হলুদ রং ধারণ করে। এছাড়াও আরেক প্রজাতির ডুমুর আছে, যেটিকে মিশরীয় ডুমুর (Egyptian Ficus) বলা হয়। এটি খুব রসালো ও অনেক বড় হয়। এটি সরাসরি কাঁচা কিংবা রোদে শুকিয়ে কাঁচের কন্টেইনারে রেখে সারা বছর খাওয়া যায়।

ত্বীন বা ডুমুর গাছের সাধারণত পাতলা, দ্রুত বর্ধনশীল এবং বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। যার ফলে গাছগুলো উচ্চতার চেয়ে প্রস্থে বেশি হয়ে থাকে। এর কাণ্ড খুব নরম হয়। তাই যেমন কাটিং করে বংশবিস্তার করা যায় তেমনি বীজ থেকেও চারা উৎপাদন করা যায়। প্রতিটি গাছ ছয় থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। প্রতিটি গাছে ন্যূনতম ৭০ থেকে ৮০টি ফল ধরে। খোলা মাঠ ছাড়াও টবের মধ্যে ছাদ বাগানে ত্বীন চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া গেছে। দুই মাস বয়সী চারার পাইকারি মূল্য ৫২০ টাকা ও খুচরা মূল্য ৭২০ টাকা।

প্রতিটি গাছ থেকে প্রথম বছরে এক কেজি, দ্বিতীয় বছরে ৭ থেকে ১১ কেজি, তৃতীয় বছরে ২৫ কেজি পর্যন্ত ফল ধরে। এভাবে ক্রমবর্ধিত হারে একটানা ৩৪ বছর পর্যন্ত ফল দিতে থাকে। গাছটির আয়ু প্রায় ১০০ বছর। তিন মাসের মধ্যেই শতভাগ ফলন আসে। আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ডুমুর আকৃতির এই ফল সবার দৃষ্টি কেড়েছে। প্রতিটি পাতার গোড়ায় গোড়ায় ফল হয়।

ডুমুর ‘ফল’ একটি সমন্বিত বা কম্পজিট আকৃতির ফল যা মূলত ফাঁকা শেলের মধ্যে অভ্যর্থনা টিস্যুতে ( receptacle tissue) ঘেরা  আলাদা আলাদা স্ত্রী ফুল থেকে শত শত পেডিকেলেট ড্রপলেটস আকারের অভ্যর্থনা প্রাচীরের আস্তরণ থেকে বিকশিত হয়। কম্পজিট আকৃতির ফলকে বলা হয় ‘syconium’। একটি পরিপক্ক ডুমুর ফলের ত্বক শক্তচামড়া বিশিষ্ট সাদা রঙের হয়ে থাকে। ভেতরে একটি মিষ্টি জিলেটিনাস সজ্জা সমন্বিত পৃথক পৃথক পাকা ড্রপলেটের অস্তিত্ব বিশিষ্ট বীজ বিদ্যমান। এই পুরো আভ্যন্তরীন অংশটিই খাওয়া যায়। স্বতন্ত্র ফলের পাশাপাশি ডুমুর পরাগায়ন বায়োলজিতেও বেশ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট ধারণ করে। জংলি ডুমুর গাছে একই  ‘syconium’ এ কার্যকরী পুরুষ ও স্ত্রী উভয় ফুলই বিদ্যমান। খাওয়ারযোগ্য ডুমুরের স্ত্রী ফুল সাধারণত বড় আকৃতির হয় এবং রসালো ফ্রুটলেট তৈরি করে।

পুষ্টি গুণাবলী

ডুমুরে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি ১, ভিটামিন বি ২, ছাড়াও প্রায় সব রকমের জরুরি নিউট্রিশনস যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, সোডিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম ইত্যাদি আছে। ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের অভাবজনিত রোগে এটি বেশ কার্যকরী। কার্বোহাইড্রেট, সুগার, ফ্যাট, প্রোটিন, থায়ামিন, রিবোফ্লাবিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন ছাড়াও বিভিন্ন পুষ্টিগুণে ভরপুর এই ডুমুর। পুষ্টিগুণের পাশাপাশি ডুমুরের অনেক ওষধী গুণও রয়েছে ।

এছাড়াও ডুমুর কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়, ওজন কমানো, পেটের সমস্যা দূর করা এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হৃদপিণ্ড সুস্থ রাখাসহ নানা উপকার করে। মৃগীরোগ, প্যারালাইসিস, হৃদরোগ, ডিপথেরিয়া, প্লীহা বৃদ্ধি ও বুকের ব্যথায় ডুমুর কার্যকরী। ডুমুর শরীরে এসিডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। শরীরে পিএইচের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। ডুমুর ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও ডুমুর গাছের কষ পোকার কামড় বা হুল ফুটানো ব্যথা নিরাময়ে কার্যকরী।

চাষাবাদ পদ্ধতি

ত্বীন ফলের গাছ কোনো রাসায়নিক সার ছাড়াই, মাটিতে জৈব ও কম্পোজড সার মিশিয়ে রোদে মাঠে ও ছাদে টবে লাগিয়ে ফল উৎপাদনে সাফল্য পাওয়া গেছে। তাই ছাদ বাগানীদের মধ্যে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য ফল গাছের তুলনায় এ গাছে খুব দ্রুত ফল ধরে। একটি ত্বীনের কাটিং চারা লাগানোর ৪/৫ মাস পর থেকেই ফল দিতে শুরু করে। তাই গাছ লাগানোর ২-৩ মাস পর থেকেই টবের গাছকে নিয়মিত অল্প অল্প করে সরিষার খৈল পচা পানি দিতে হবে। এক বছর পর টবের আংশিক মাটি পরিবর্তন করে দিতে হবে। ২ ইঞ্চি প্রস্থে এবং ৬ ইঞ্চি গভীরে শিকড়সহ মাটি ফেলে দিয়ে নতুন সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে তা ভরে দিতে হবে। টবের মাটি পরিবর্তনের কাজটি সাধারণত শীতের আগে ও বর্ষার শেষে করাই ভালো। টব বা ড্রামের মাটি ১০-১৫ দিন পর পর কিছুটা খুঁচিয়ে দিতে হবে।

পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা

পোকামাকড়ের মধ্যে Meloidogyne গোত্রের নেমাটড (Nematodes) এর মাধ্যমে ডুমুর গাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। Arthropod এও গাছের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে বৃষ্টির পরিমান বেশি হলে ফল ভেঙ্গে যাওয়া রোগ (fruit splitting) হতে দেখা যায়। Alternaria, Aspergillus, Botrytis, এবং Penicillium fungi  ফাংগাল রোগ দমনে ফাংগিসাইড প্রয়োগ করতে হয়। ডুমুরের আর একটি কমন রোগ হলো  fig mosaic disease (FMD) যা হলে ডুমুর গাছ মোজাইকের মতো হলুদ রং ধারণ করে। এসমস্ত রোগ বা পোকার আক্রমণ হলে নিকটবর্তী কৃষি অফিসে যোগাযোগ করে পরিমিত ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।

বাণিজ্যিক সম্ভাবনা

সরকারের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ত্বীন ফল রপ্তানি করে আন্তর্জাতিক বাজার ধরা সম্ভব। সম্ভাবনাময় এই ফল চাষ করে দেশের বেকরত্ব দূরের পাশাপাশি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশে চাষাবাদ করা ত্বীন বা ডুমুরের জাতগুলোর মধ্যে নীল, মেরুন, লাল, হলুদসহ বিভিন্ন বর্ণের হয়ে থাকে। এখানকার গাছে প্রতিটি ত্বীন ফল ওজনে ৭০ থেকে ১১০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।

দেশের প্রচার মাধ্যমে ত্বীন ফলের চাষ কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হবে এবং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও বিদেশ থেকে ত্বীনের আমদানি নির্ভরতা কমে আসার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে ঘরোয়া বাজারেও এই ত্বীন ফলের একটি বড় ব্যবসায়ীক সম্ভাবনা রয়েছে। এক্সোটিক বা গৌণ ফল হিসেবে স্ট্রবেরী, ড্রাগন ফ্রুটস কিংবা এভোকেডোর চেয়ে ত্বীন ফলের চাহিদা বেশি বই কম নয়।

লেখক: অতিরিক্ত উপপরিচালক, হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

4h ago