মহাকালের বুকে বাংলা কবিতায় চিরভাস্বর যে আশ্চর্য শঙ্খ

মেঘনা নদী পাড়ে রোজ সন্ধ্যায় শঙ্খ বাজতো, কাঠের লঞ্চগুলো হুইসেল বাজিয়ে ফিরতো গন্তব্যে, আর যখনই ফিরে আসতো, ভুলিয়ে দিতো মেঘনা, ডাকাতিয়া আর পদ্মার মোহনার স্রোতের শব্দ। ঠিক আজ থেকে বহুকাল পূর্বে মাঘের এক সন্ধ্যায় শঙ্খ বেজেছিল। এখনো কি মেঘনার ধারে রোজ সাঁঝবেলায় শঙ্খের ধ্বনি শোনা যায়? নাকি ফুরিয়ে গেছে কালের পরিক্রমায়? বলছি সেই সন্ধ্যেটা ত্রিশের দশকের, ঠিক তখনই তো রবীন্দ্র গণ্ডি ছেড়ে পাঁচ কবি তৈরি করলেন নতুন এক জগত। পঞ্চ কবির হাতে জন্ম নিলো বাংলা কবিতার নতুন এক ধারা। ঠিক তেমনই এক সন্ধ্যায় যখন বাজছে শঙ্খ, অমলা ঘোষ সেই শাঁখের শব্দের মাঝেই শুনতে পেলেন তার পাশে শুয়ে থাকা আশ্চর্য এক শঙ্খের ডাক। কে জানতো ত্রিশের দশকের মাঘের সেই সন্ধ্যায় পঞ্চ কবির যোগ্য উত্তরসূরির আগমন এমন করেই ঘটবে!
মেঘনা নদীর কূলে চাঁদপুর জন্মভূমি বটে কিন্তু শৈশবের কিছুদিন কেটেছিল কীর্তনখোলার তীরে বরিশাল শহরে। পৈত্রিক ভিটে সন্ধ্যা নদীর কূলে বরিশালের বানারিপাড়ায়। নদীই যার জীবন, নদীই যার স্বজন হয়ে উঠলো তাকে নদী কি করে ভোলে! স্কুলের পাঠ পদ্মার ধার ঘেঁষা ঈশ্বরদীর পাকশি চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে। বাবা মনীন্দ্র কুমার ঘোষ ছিলেন ওই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক।
লিখেছিলেন স্মৃতিকথায়, “গোটা স্কুল জীবনটা আমার কেটেছে পদ্মা নদীর পাড়ের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সংলগ্ন পাকশী নামের এক আশ্চর্য কলোনিতে।” এই আশ্চর্য কলোনি আসলেই ছিল আশ্চর্য কলোনি। সে কলোনিই যেন জীবনের দ্বার খুলে দিয়েছিল চিত্তপ্রিয় ঘোষের। বলা হয়নি ছেলের চিত্তপ্রিয় ঘোষের চিত্ত নামটা মনীন্দ্র ঘোষ রেখেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে মিল রেখে। মনীন্দ্র ঘোষ নিজেও ভীষণ পড়ুয়া ছিলেন। স্কুলই ছিল তার স্বজন। আর সকাল বিকেল নিয়ম করে পদ্মার ধারে গিয়ে গাইতেন অতুল প্রসাদের গান। ভীষণ গানের শখ ছিল মনীন্দ্র ঘোষের। মাঝে মাঝে গ্রীষ্মের এক মাসের ছুটিতে যেতেন ছেলে শঙ্খকে নিয়ে বানারিপাড়ার বাড়িতে। সন্ধ্যা নদীর পাড়ে বানারিপাড়ার বাড়িটা ছিল এক টুকরো স্বর্গ। চারপাশে গাছপালা, মাঝে খাল, এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় যেতে নৌকার ব্যবস্থা। পূর্ব বাংলা যে কতোটা সুন্দর তা শৈশব কৈশোরে অনুধাবন হয়েছিল শঙ্খের। ঈশ্বরদীর পাকশির চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করলেন ঠিক এর কয়েক মাসের মধ্যেই দেশভাগ হয়ে গেল। তারপর ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে।
যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছেন তখনকার ঘটনা এটি। সেবার কলেজে পড়া বেশ কয়েকজন কমবয়সী তরুণ মাঝে মাঝেই সাহিত্যের পাঠচক্রের আয়োজন করতেন। সেখানে কখনও আমন্ত্রণ করা হয় নামীদামি লেখকদের। একবার ঠিক করা হলো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ করা হবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বাংলা সাহিত্য জগত দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
কিন্তু কে সাহস করে যাবে তাকে আমন্ত্রণ করতে? তিনি কি এই অল্পবয়েসি ছেলেছোকরাদের পাঠচক্রে আদৌ আসবেন?
অনেক আলোচনার পর আমন্ত্রণ জানানোর দায়িত্ব পড়লো একজনের উপর। দুরুদুরু বুকে এক সকালে রওনা দিলো সে। তখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থাকেন বরানগরে। সে কিশোরের মাথায় নানা চিন্তা। এতো বড় সাহিত্যিকের বাড়ি কেমন হবে? কী ভাবে কথা শুরু করবে সে!
বাস থেকে নেমে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে যখন পৌঁছালো বেশ খানিকটা অবাকই হলো সে। নেহাতই সাধারণ ছোটখাটো একটি বাড়ি। সামনে বিশাল মাঠ। বুকে অনেকটা সাহস জড়ো করে দরজায় কড়া নাড়লো। দরজা খুললেন একজন মহিলা। ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো ‘‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কি আছেন?’’
‘‘বাজারে গেছেন।’’
লেখক আবার বাজারও করেন! বিস্মিত গলায় বললো সেই ছেলেটা।
কেন কিছু বলবেন তাকে? প্রশ্ন মহিলার।
না, আমি এই মাঠটায় একটু ঘুরে বেড়াই। উনি ফিরলে কথা বলবো।
প্রথম অংশ বলতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় আধঘণ্টা মাঠে চক্কর দেওয়ার পর সে দেখল, একজন লম্বা কালো দেহের মানুষ লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে, দুই হাতে দুই থলে নিয়ে ওই বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
ইনিই মানিকবাবু নাকি? মনে মনে ভেবে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো সেও।
মানিক তাকে আড়চোখে দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আপনি কি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন?’’
‘‘হ্যাঁ।’’
‘‘আসুন ভেতরে। আমি বাজারটা রেখে দিয়ে আসছি,’’ বলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলেন ভেতরের ঘরে।
সামনের যে ঘরের চৌকিতে ছেলেটি বসল, চারদিকে তাকিয়ে দেখল ঘরে ওই চৌকি ছাড়া আছে একটা নড়বড়ে টেবিল। ব্যস, আর কিছুই নেই! এমনকী টেবিলের ওপরে কোনো বইখাতাও রাখা নেই। মানিক ভেতরের ঘর থেকে ফিরে এসে বললেন, ‘‘বলুন কী চান? গল্প? পত্রিকা করেন বুঝি?"
কীভাবে কথা শুরু করবে বুঝে পাচ্ছে না সেই ছেলেটি।
মানিক তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘কী ভাবছেন? ভাবছেন যে একজন লেখকের ঘর এমন ফাঁকা কেন? আপনারা পাঠকেরা কিছু দেন না সেইজন্য ফাঁকা। ভাবছেন যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে হাতে বাজার করেন কেন?’’ ছেলেটি শুনেই হতবাক। ঠিক এই কথাগুলোই তো ভাবছিল। মানিক জানলেন কী করে!
মানিকই উত্তর দিলেন, ‘‘না করে আর উপায় কী বলুন। লিখবার সময় পেতে হলে এসবের জন্য যে কোনও ঝি-চাকর রাখব, সে-রকম টাকা কে দেবে আমাকে? দেন কি আপনারা? পড়েন কি কেউ আমার লেখা? আপনি যে এসেছেন এখানে? আমার কোনও লেখা কি পড়েছেন?’’ অমন কথা শুনে মনে মনে বেজায় অপমানিত হলো যুবক। কী বলছেন উনি? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়িনি! মুখে বলল, ‘‘পড়েছি অনেক।’’ ‘‘তাতে কী সুবিধে হলো? কোনও বই কিনেছেন?’’ চাঁচাছোলা গলায় ফের প্রশ্ন করলেন মানিক।
‘‘না, কিনে পড়িনি, সবই এর ওর কাছ থেকে চেয়ে কিংবা লাইব্রেরি থেকে। কলেজ ছাত্রদের অত বই কেনার টাকা কোথায়?”
‘‘তবে! পাঠকেরা কেউ বই কিনবেন না, প্রকাশক বলবেন বই বিক্রি হয় না, টাকাটা আসবে কোথা থেকে? লেখকের ঘরটাও তাই এমনই থাকবে। দুঃখ পেলে চলবে কেন?’’ মানিকের কথায় মাথা নিচু করল সেই তরুণ ছেলেটি।
ঠিক তখনই মানিক গম্ভীর গলায় বললেন, ‘‘বলুন এবার কী জন্য এসেছেন? গল্প চাই একটা’’? এ বার নিজের নাম পরিচয় দিয়ে পাঠচক্রের কথা জানাল ছেলেটি। আর মনে মনে ভেবেই নিয়েছিলো যে এই আমন্ত্রণে মানিক সাড়া দেবেন না।
কিন্তু তাকে একেবারে চমকে দিয়ে মানিক বললেন, ‘‘ঠিক আছে যাব। কোথায় কবে কখন সব লিখে দিয়ে যান চিরকুটে। নিশ্চয়ই যাব’’ এ বার আনন্দে উচ্ছ্বসিত গলায় ছেলেটি বললো, ‘‘আমরা এসে নিয়ে যাব আপনাকে।’’
কিন্তু অবাক হওয়ার আরও কিছু বাকি ছিল তার। মানিক বললেন, ‘‘কিচ্ছু দরকার নেই। আপনারা পয়সা পাবেন কোথায়? যেতে পারব একাই। শুধু কিভাবে যেতে হবে সেটাই বলে যান।”
তারপর আরও দু-চার কথা সেরে লেখকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল সেই কলেজ পড়ুয়া যুবক।
ফেরার সময় বাসভাড়াটুকু পকেটে থাকলেও আর বাসে চাপতে ইচ্ছে হলো না তার। শরীর আনন্দে যেন পালকের মতো হালকা হয়ে গেছে। ওই বরানগর থেকে হাঁটতে হাঁটতেই কলেজস্ট্রিট, সেখান থেকে বউবাজারে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে তারপর কলেজ। কলেজে এসেই বন্ধুদের হইহই করে জানাল সেই মহা সুখবর। সেদিনের সেই ঊনিশ বছরের ছেলেটির নাম শঙ্খ। সেই প্রথম কোনো বিখ্যাত সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচয় তার।
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ। একই বছরের ঘটনা। কোচবিহারে খাবারের দাবিতে একটি মিছিলে ১৬ বছরের একটি মেয়েকে গুলি করে মারলো ভারতের পুলিশ। সে খবর শুনে ছেলেটি লিখল, “যমুনাবতী” নামের একটি কবিতা।
“নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে
আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি বাঁচার আনন্দে।”
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো তাল মিলিয়ে এই কবিতা লেখার জন্য কবিতার শুদ্ধতায় বিশ্বাসী বুদ্ধদেব বসুর নিন্দাও সহ্য করতে হয়েছে তাকে।
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকেই বাংলায় প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় হয়ে স্নাতক পাশ করলো শঙ্খ। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, শঙ্করী প্রসাদ বসু, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য , আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতো কিংবদন্তী সাহিত্যিক, ভাষা বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু ছাত্রদের কাছে শিক্ষক হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন টেনিদার জনক প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র শঙ্খ। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ঘরে ফেরেন তো পিছনে পিছনে ঘোরে শঙ্খ। প্রমথনাথ বিশী ঠাট্টা করে বলতেন “ছোট নারায়ণ”।
স্নাতকোত্তর অবশ্য তার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাও বাংলায়। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন কিংবদন্তী ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে। সে বছরই বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শেষ হয়েছিল সুনীতিকুমারের।
স্নাতকোত্তরে স্নাতকের মতো এবারো দ্বিতীয়। পরের বছরের প্রথম দিকে যোগ দিলেন বঙ্গবাসী কলেজের বাংলা বিভাগে। সেখানে থাকার সময়েই তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “দিনগুলি রাতগুলি” বের হলো, সালটা তখন ১৯৫৬। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ বের হয়েছিল অবশ্য আরো ঢের দেরিতে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ বের হওয়ার ১১ বছর পর। ১৯৬৭ সালে ততোদিনে তিনি জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হয়ে গেছেন। বঙ্গবাসী কলেজ সিটি কলেজ হয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৭ সালে বের হলো "এখন সময় নয়"। এটি দারুণ সাড়া ফেলেছিলো কবি ও কবিতার মহলে। একই বছর বের হয়েছিল আরো একটি কাব্যগ্রন্থ "নিহিত পাতাল ছায়া"।
১৯৬৭ সালে আইওয়া রাইটার্স ওয়ার্কশপের ফেলোশিপ নিয়ে এক বছরের জন্য চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে। ওখানে পাকাপোক্তভাবে থেকে যাওয়ার সুযোগ ছিল তার। একদিকে দেশের অস্থিরতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা মিলিয়ে বেশিরভাগ আত্মীয় স্বজনেরাই বললো থেকে যেতে কিন্তু তিনি থাকলেন না। তখন যুক্তরাষ্ট্রে চলছে মার্টিন লুথার কিং হত্যার প্রতিবাদ, বলিভিয়ার জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন চে গুয়েভারা, চরছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধে জোর প্রতিবাদ। শামিল হয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষও। কিন্তু ১৯৬৮ সালের শেষদিকে চলে এলেন ফের। তারপর কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ১৯৬৫ সালে ভর্তি হয়েছিলেস তিমির বরণ সিংহ নামের এক ছাত্র। শেষ বর্ষের পরীক্ষা কিছুদিন পর। চারদিকে নকশাল আন্দোলনের জোর ছাপ। এদিকে পুলিশের উপর কড়া বার্তা নকশাল পেলেই ছাড় নয়। এমন কতো ছাত্র যে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারালো।
একদিন রাতে পুলিশ ধরলো তিমির বরণকে। ষোলো জন সহবন্দীর সঙ্গে মিলিয়ে সেই তিমিরকে এক রাতে পিটিয়ে মারে পুলিশ। কারো কোনো প্রতিবাদ নেই। কেবল এগিয়ে এলো একটি কলম। যে কলমে প্রিয় ছাত্র তিমির বরণ সিংহের মৃত্যুতে শঙ্খ ঘোষ লিখলেন,
"ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায়
দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ
তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?
নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই
তোমার ছিন্নশির, তিমির।”
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে রাস্তায় দাঁড়ালেন শঙ্খ ঘোষ। প্রতিবাদ জানালেন পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে গণহত্যার। বাঙালি লেখক সাহিত্যিক শিল্পীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ালেন কলকাতা, দিল্লির রাস্তায়। মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের তহবিলে দিলেন নিজের গাঁটের পয়সা। এ যে তার মাতৃভূমি। তাইতো তিনি বলেন, “যে দেশের হাওয়া মাটিতে জলে গোটা কৈশোর কেটেছে সেই দেশই তো আমার। প্রতি মুহূর্তে জীবনের সেই প্রথম ১৫ বছরকেই তো ধারণ করে আছি।”
একাত্তরের তার যে বেদনা আর ছাপ, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার তীব্র ক্ষোভ তা পাওয়া যায় “নিঃশব্দের তর্জনী” গদ্য গ্রন্থে। এর আগে তার যা গ্রন্থ আকারে বেরিয়েছিল সব কবিতা। কেবল “কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক” নামের একটি আলোচনার বই বেরিয়েছিল ১৯৬৯ সালে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বছরে বের হলো তার কাব্যগ্রন্থ “আদিম লতা গুল্মময়”। তার দু বছর পর বের হলো কাব্যগ্রন্থ “মূর্খ বড়, সামাজিক নয়” আর ১৯৭৬ সালে বের হলো “বাবরের প্রার্থনা”। বাবরের প্রার্থনা সাড়া ফেলে দিয়েছিল বাংলার কবিতা ও সাহিত্য অঙ্গনে। এই বইয়ের কবিতা লেখারও একটি ইতিহাস আছে।
শঙ্খ ঘোষ কবিতা "বাবরের প্রার্থনা" লিখেছিলেন ১৯৭৪ সালের হেমন্তের এক বিকেলে। তার বড় মেয়ে অসুস্থ। ডাক্তার নির্ণয় করতে পারছে না রোগটি কী। তিনি তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই বিকেলে হাঁটছেন শঙ্খ ঘোষ। মনটা অস্থির ও বিধ্বস্ত। হাঁটতে হাঁটতে শঙ্খ ঘোষ ভাবলেন দেশজুড়ে কী এক বিষণ্ণ ও অস্থির পরিবেশ। এই যে কিছুদিন আগে নকশাল আন্দোলন গেল, এখন তো প্রায় শেষ, এই ছেলেদের কী হবে! এই ছেলেদের ভবিষ্যৎ কী? ‘কবিতার মুহূর্ত’ গ্রন্থে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, “দু-একটি ছেলেমেয়ে কখনও কখনও পাশ দিয়ে চলে যায়, তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়: কদিন আগেও এখানে যত প্রখরতা ঝলসে উঠত নানা সময়ে, তা যেন একটু স্তম্ভিত হয়ে আছে আজ। কেবল এখানেই তা তো নয়, গোটা দেশ জুড়েই। কিন্তু কেন হল না? আমরাই কি দায়ী নই? কিন্তু কী করেছি আমরা? করতে পেরেছি? আমাদের অল্পবয়স থেকে সমস্তটা সময় স্তূপ হয়ে ঘিরে ধরতে থাকে মাথা। ফিরে আসে মেয়ের মুখ। মনে পড়ে আমার নিষ্ক্রিয়তার কথা।” সূর্যাস্ত হচ্ছে পশ্চিমাকাশে। শঙ্খঘোষ প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসলেন।
তার মনে পড়লো পুত্র হুমায়ুনের রোগ থেকে আরোগ্যের জন্য সৃষ্টিকর্তার দরবারে বাবা বাবরের যে প্রার্থনা, প্রাণের বিনিময়ে হলেও সন্তানের যেন আরোগ্য লাভ হয়। সেই করুণ দৃশ্য যেন দেখতে পেলেন শঙ্খ ঘোষ। সোজা নিজের কক্ষে চলে গেলেন শঙ্খ ঘোষ। কলম তুলে সেই সন্ধ্যায় লিখলেন সেই অমর কবিতা।
“এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত -
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
কোথায় গেল ওর স্বচ্ছ যৌবন
কোথায় কুড়ে খায় গোপন ক্ষয়!
চোখের কোণে এই সমূহ পরাভব
বিষায় ফুসফুস ধমনী শিরা!
১৯৭৭ সালে বাবরের প্রার্থনার কবিতার জন্য শঙ্খ ঘোষ পেলেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। একই বছর তার পূর্বের কাব্যগ্রন্থ "মূর্খ বড়, সামাজিক নয়" এর জন্য পেলেন নরসিংহ দাস পুরস্কার। তারপর তো একে একে বের হলো মিনিবুক, তুমি তেমন গৌরী নও, পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ ও প্রহরজোড়া ত্রিতাল। ১৯৮০ সালে বের হওয়া পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ তো বিখ্যাত হয়ে আছে। পাঁজরের দাঁড়ের শব্দ কাব্যগ্রন্থ শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে গেল এক অনন্য উচ্চতায়।
এই কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত কবিতা "চুপ করো শব্দহীন হও"।
"এতো বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শস্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
ভেঙ্গে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে
স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও।"
চুপ করো শব্দহীন হও যেন কবির নিজের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। নিজেই ছিলেন ভীষণ চুপচাপ, আদিখ্যেতা পছন্দ করেন না। ভিড় সমাগম হৈ চৈ সমস্ত কিছুর বাইরে দারুণ শান্ত, নিভৃত একটি জীবন। কেবল কবিতাই জবানবন্দী দিয়েছে তার। পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ সমালোচকদের তো বটেই দারুণ পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছিল। ১৯৮২ সালে বের হওয়া প্রহরজোড়া ত্রিতাল বের হলো তখন তার কাব্যভঙ্গি সবার মুখেমুখে। তবে এরপরের বছরের কাব্যগ্রন্থ পাল্টে দিলো সমস্ত হিসেব নিকেশ। “মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে” কাব্যগ্রন্থ যেন তাকে নতুন করে চেনালো। বিশেষ করে সমস্ত পরিবর্তন আর অলিখিত নিয়মের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ।
"একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
… তোমার জন্যে গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।"
একই বছর বের হয়েছিলো আরো দুটো কাব্যগ্রন্থ। বন্ধুরা মাতি তরজায় ও ধুম লেগেছে হৃদকোমলে। দুটো কাব্যগ্রন্থই সমালোচকদের দৃষ্টি কেড়েছিল। "ধুম লেগেছে হৃৎকমলে" কাব্যগ্রন্থের জন্য তো শঙ্খ ঘোষ ভূষিত হলেন রবীন্দ্র পুরস্কারে। এই সময়ে কেবল কাব্যেই নন, গদ্যতেও ভীষণ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। ছন্দের বারান্দা, এ আমির আবরণ, উর্বশীর হাসি, শব্দ আর সত্য, নির্মাণ আর সৃষ্টি, কল্পনার হিস্টোরিয়া প্রমাণ করে তার গদ্য ভাণ্ডার কতোখানি সমৃদ্ধ। এর পরের প্রায় এক দশক গদ্যতেই জোয়ার চালিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ। জার্নাল, ঘুমিয়ে পড়া এলবাম, কবিতার মুহূর্ত, কবিতালেখা কবিতাপড়া, ঐতিহ্যের বিস্তার, ছন্দময় জীবন এ দেখা মিলে এক অনন্য গদ্যকার শঙ্খ ঘোষকে। যিনি একবার ভেঙ্গেছেন তো পুনর্বার গড়েছেন। ১৯৯৩ সালে বের হলো তার কাব্যগ্রন্থ " লাইনেই ছিলাম বাবা"। যেটি প্রভাব বিস্তার করে আছে পাঠক হৃদয়ে।
জীবনানন্দ পরবর্তী প্রজন্মে বাংলা কবিতায় যে পঞ্চ পাণ্ডব সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম শঙ্খ ঘোষ। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপল কুমার বসু, বিনম মজুমদার আর শঙ্খ ঘোষ। এই পাঁচজনের হাত ধরে বের হলো বাংলা কবিতার এক অনন্য এক ধারা। কে জানতো জীবনানন্দের বরিশালের এক উত্তরাধিকারীর হাতেই বইবে বাংলা কবিতার এক অনন্য ভার।
কবিতা ও গদ্যের বাইরে প্রাবন্ধিক হিসেবেও অসাধারণ ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। আর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার কলমের ব্যাপ্তি তো ছিল অসামান্য। ছিলেন রবীন্দ্র গবেষক। তার প্রথম গদ্যগ্রন্থই ছিলো রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি নিয়ে। "কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক" এক অনন্য দলিল। বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি বেশ কিছুদিন। নির্বাচিত প্রবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ, হে মহাজীবন: রবীন্দ্র প্রসঙ্গ, লিখেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর রবীন্দ্র মুগ্ধতা ও প্রেম নিয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ তার আত্মায় ছিল, বারেবারে ফিরে যেতেন রবীন্দ্রনাথের আদর্শ আর বিশ্বাসে।
বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মাননা পেলেন ১৯৯৯ সালে। আর ২০১১ সালে পেলেন পদ্ম ভূষণ।
মাত্র তিনজন বাঙালি কবি পেয়েছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মাননা জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। বিষ্ণু দে ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পর তৃতীয় বাঙালি কবি হিসেবে ২০১৬ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ।
শঙ্খ ঘোষের সৃষ্টি থেকে বাদ যায়নি শিশু কিশোর সাহিত্যও। ছোটদের জন্য লিখেছেন বিদ্যাসাগর, আমন ধানের ছড়া, সুপারি বনের সারি, আমন যাবে লাট্টু পাহাড়, বড় হওয়া খুব ভুল, বল তো দেখি কেমন হত, শহর পথের ধুলো, সুর সোহাগীর মতো অসামান্য কিশোর সাহিত্যের জন্ম শঙ্খ ঘোষের হাতে। বিখ্যাত নাট্যকার শম্ভু মিত্রকে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিলো তার "এক বক্তার বৈঠক: শম্ভু মিত্র"।
বাংলা কবি ও কবিতায় কালের এক অনন্য মহাযাত্রীর নাম শঙ্খ ঘোষ। যিনি সমস্ত জনপ্রিয়তা, খ্যাতি মোহ সমস্ত কিছুর বাইরে চলেন এক আদি বিস্তৃত সৃষ্টির ধারায়। বরাবরই ছিলেন সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। কোন গণআন্দোলন আর গণমানুষের দাবি উপেক্ষা করতেন না। সমর্থন জুগিয়েছেন প্রতিটি মুহূর্তে, সে হোক স্বশরীরে উপস্থিত থেকে কিংবা নিজের মন্তব্য প্রকাশ করে, নিজের সৃষ্টিশীলতায় নতুন সৃষ্টির জন্ম দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন বারেবারে। তার সাহিত্য সাধনা এবং জীবনযাপনের মধ্যে বারবার প্রকাশ পেয়েছে তার রাজনৈতিক সত্তা।
হোক নকশাল আন্দোলনে পুলিশের গুলি ও নির্যাতন, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদে সাম্প্রদায়িক হামলা, গুজরাট দাঙ্গা, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে, কিংবা কৃষক আন্দোলনে। নিজেকে বলতেন আমি তো অরাজনৈতিক মানুষ নই। একজন কবি, সৃষ্টিশীল মানুষ কি করে অরাজনৈতিক হতে পারেন?
মাতৃভূমির প্রতি শঙ্খ ঘোষের টান ছিল অসম্ভব। প্রচণ্ড ভালোবাসতেন বাংলাদেশকে, এই মাটি আর নদীকে। ২০১৯ সালে অমর একুশের বইমেলা উদ্বোধনী বক্তৃতায় তার প্রমাণই যেন মেলে। "বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। পনেরো বছর বয়সে এই দেশ ছেড়ে গেলেও বাকি বাহাত্তর বছর ধরে এ অনন্য দেশের স্মৃতিই বহন করে চলেছি।"
বিশেষ করে সন্ধ্যা নদী তীরের বরিশালের বানারিপাড়া, মেঘনা তীরবর্তী তার জন্ম শহর চাঁদপুর, নিজের শৈশব আর কৈশোর কাটানো পদ্মা তীরবর্তী পাবনার পাকশি ছিল আজন্ম তার আত্মায়। স্মৃতিকথার দ্বার খুলে দিতেন অজস্রবার। থাকতেন কলকাতায় কিন্তু তার আত্মায় ছিল সন্ধ্যা নদীর পাড়ের কৃষ্ণচূড়ার ছায়া, পদ্মায় ইলিশের জেলে নৌকাগুলোতে টিমটিম করে জ্বলছে আলো, মেঘনার বুকের প্রবল ঢেউয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে অঝোর শ্রাবণে কলকাতার রাস্তায়। আর তিনি যেন ফিরে গেছেন সেই বাদলা দিনে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের পাশের আশ্চর্য সেই কলোনিতে।
"সন্ধ্যানদীজল" কবিতায় যেমন এঁকেছিলেন,
"দুহাত তোমার স্রোতে, সাক্ষী থাকো,
সন্ধ্যানদীজল।
এমন তর্পণদিনে বহু মঠ পেরিয়ে পেরিয়ে
তোমার দুঃখের পাশে বসে আছি
এই ভোরবেলা।
আরও যারা এ মুহূর্তে নেই হয়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছে
আমার শরীর ঘিরে এমন সম্পূর্ণ যবনিকা
তাদের সবার শ্বাস দুহাতে অঞ্জলি দিয়ে আজ
এইখানে বসে ভাবি আমার সম্বল
স্থির থাকা।"
শঙ্খ ঘোষ চিরকাল থাকবেন বাংলায়, বাঙালির হৃদয়ে। শঙ্খ ঘোষ থাকবেন তার সৃষ্টি, প্রতিবাদী মন, কবিতার গহ্বর, সৃষ্ট কর্মের গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে চিরকাল, মহাকালের দীর্ঘ অভিযাত্রায়। আজো যেমন নিয়ম করে শঙ্খ বাজে হুগলী নদীর বাঁকে এক ছুটে চলা মহানগরে, যেমন বাজে প্রতি সাঁঝবেলায় সন্ধ্যা নদীর পাড়ে ছায়া সুনিবিড় অদ্ভুত শান্ত কোনো গৃহে, বাজে সেই পাকশির আশ্চর্য কলোনিতে। তবে শঙ্খের স্তব্ধতা কি করে হয়!
তথ্যসূত্র-
শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা/ শঙ্খ ঘোষ
সময়ের জলছবি- শঙ্খ ঘোষ
শঙ্খ ঘোষ - শান্তি সিংহ
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
আরও পড়ুন-
Comments