ব্যবসা চালু রাখতে মরিয়া দোকান মালিকরা

মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশ বিক্রির জন্য পরিচিত বংশাল এলাকার দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এখন যে কেউ সেখানে গেলে দেখতে পাবেন ভিন্ন চিত্র।
পথচারীদের মাঝে সম্ভাব্য ক্রেতার সন্ধানে বংশালের দোকানিরা। ছবি: পলাশ খান

মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশ বিক্রির জন্য পরিচিত বংশাল এলাকার দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এখন যে কেউ সেখানে গেলে দেখতে পাবেন ভিন্ন চিত্র।

সেখানের সড়কে কর্মব্যস্ত স্বাভাবিক দিনগুলোর তুলনায় যানবাহন চলাচল নেই বললেই চলে। শাটার বন্ধ রাখা দোকানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে আছেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ।

এ দৃশ্য দেখে যে কারো মনে হতেই পারে, তারা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দোকান বন্ধ রাখার সরকারি নিষেধাজ্ঞা মেনে গল্পগুজব করে অলস সময় পার করছেন। যে ভাইরাসে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে সাড়ে দশ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

তবে, একটু সেখানে একটু দাঁড়ালেই আপনার দিকে কোনো বিক্রেতার আকুল প্রশ্ন আসতে পারে, ‘ভাই, কিছু লাগবে?’ 

মঙ্গলবার বিকেলে সেখানে এমন দৃশ্যই দেখা যায়। বংশালের অটো-পার্টস বিক্রেতা মাজহারুল ইসলাম মাসুদ তার ব্যবসা চালু রাখতে মরিয়া। তাই তিনি দোকানের সামনে রাখা একটা টুলে বসে পথচারী ও মোটরসাইকেল চালকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যাচ্ছেন। এ সময় তার দোকানের শাটারটির দুই-তৃতীয়াংশ নামানো অবস্থায় ছিল।

মাসুদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘জানি দোকান খোলা নিষেধ। কিন্তু, কী করার আছে আমার? রোজার মাস চলছে তাই প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটাতে অনেক খরচ।’

বিষণ্ণ মাসুদ আরও বলেন, ‘দোকান খুলতে পারলে কিছু না কিছু উপার্জন হয়। কিন্তু, বাড়িতে অলসভাবে বসে থাকলে পরিবারের মানুষ আমাকে নিয়ে চিন্তায় থাকে। আয় না থাকলে চলবে কীভাবে? এটা আমার জন্য খুব কঠিন সময়।’

মহামারির কারণে প্রায় এক বছর ধরে ব্যবসায় মন্দা অবস্থা চলছে। তাই ৪০ বছরের মাসুদ সংসার চালানোর পাশাপাশি ঈদকে সামনে রেখে দোকানে নতুন কিছু পার্টস ওঠাতে লাখখানেক টাকা ধার করেন।

স্বাভাবিক সময়ে মাসুদের দোকানে দৈনিক ২০ হাজার টাকা বিক্রি ছিল সাধারণ ব্যাপার। তবে, মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত তা ছিল ৮০০ টাকার মতো। তার পরিবারের প্রতিদিনের চাহিদা মেটানোর জন্য যা খুবই অপ্রতুল।

বংশালে স্টিলসহ নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা গেছে। ব্যবসা চালিয়ে নিতে মালিকসহ বিক্রয়কর্মীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন ক্রেতার অপেক্ষায়। কাস্টমার পেলে শাটার খানিকটা খুলে তারা চাহিদামাফিক পণ্য বের করে আনছেন। বিক্রি শেষে আবার শাটার নামিয়ে দিচ্ছেন। 

কেবল বংশাল নয়, দেশের আর্থিক ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের প্রাণ ঢাকা মহানগরের অন্যান্য এলাকাগুলোর চিত্রও প্রায় একই।

গত বছর দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলা লকডাউনে শহরের দোকান মালিকসহ প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এ অবস্থা থেকে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সব আশা শেষ হয়ে গেছে নতুন নিষেধাজ্ঞার কারণে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে, সারাদেশে দোকানের সংখ্যা ৫৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে ঢাকাতেই আছে প্রায় ৫ লাখ।

বাংলাদেশ ইকোনোমিক রিভিউ বলছে, এসব পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার পরিমাণ মোট দেশীয় পণ্য বাণিজ্যের ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। কিন্তু, দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই ব্যবসায়ীদের অনেকে এখন ঋণের দায়ে জর্জরিত। আবার অনেকে ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছেন।

বংশালের আরেক অটো পার্টস ব্যবসায়ী শাহীন আহমেদ বললেন, ‘আমাদের এভাবেই ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। লকডাউনের কারণে দোকান বন্ধ থাকলেও ব্যাংক আমাদের ঋণ কিংবা ঋণের সুদ মাফ করবে না।’

শাহীন আরও বলেন, ‘কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াই সরকার দোকান খোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল। এটা উচিত হয়নি। বিক্রি না হলে, আয় না হলে আমরা চলব কীভাবে?’

করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের কারণে গত ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউনের ঘোষণা দেয় সরকার। পরে তা ২১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু, এর মধ্যে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ায় আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত লকডাউনের নতুন ঘোষণা এসেছে।

নর্থ-সাউথ রোডের রড-স্টিলের ব্যবসায়ী ওয়াহিদ ঢালীর ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ১০ কোটি টাকা। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যাংক থেকে প্রায়ই কল আসে। কিন্তু, ব্যবসার এ অবস্থা চলতে থাকলে ঋণের টাকা দিতে গ্রামের ভিটে-মাটি বিক্রি করা ছাড়া উপায় থাকবে না।’

দেশের পাইকারি কাপড়ের অন্যতম বড় বাজার ইসলামপুরের ব্যবসায়ী সেলিম হোসেন জানান, লকডাউনের কারণে দোকান বন্ধ রাখায় গত বছর ব্যবসার কোনো সুযোগ ছিল না।

তিনি বলেন, ‘তখনকার সময়ের ক্ষতিই এখন পর্যন্ত পুষিয়ে উঠতে পারিনি। অনেকের কাছে বাকিতে কাপড় বিক্রি করেছিলাম। সেই টাকাও এখনো ওঠেনি।’

তিনি জানান, এই মুহূর্তে তার ঋণের পরিমাণ ২২ লাখ টাকা। যার মধ্যে ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন ব্যাংক থেকে।

চলতি বছর পয়লা বৈশাখ সামনে রেখেও বিক্রি আশাব্যঞ্জক হয়নি সেলিমের। আর ঈদুল ফিতর সামনে রেখে এখন তো ইসলামপুরে সর্বোচ্চ বিক্রির মৌসুম। তাই এই মুহূর্তে দোকান বন্ধ থাকা মানে ব্যবসার সর্বোচ্চ ক্ষতি। কারণ, সারা বছর এই বাজারে যে পরিমাণ কাপড় বিক্রি হয়, তার ৩০ শতাংশই বিক্রি হয় ঈদ ও পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে।

ইসলামপুর কাপড় ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নেসার উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘এবার আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, বিক্রি নেই বলে শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার কামিজসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় মজুদ হয়ে আছে।’

এদিকে মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় মাজার কো-অপারেটিভ মার্কেটে ইলেক্ট্রিক্যাল পণ্যের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী মো. শাহীনকে তার দোকানের শাটার কিছুটা খুলে রাখতে দেখা যায়। প্রশাসনের ভয়ে দোকান পুরোটা খুলতে সাহস পাচ্ছেন না তিনি।

শাহীন বলেন, ‘যে কোনো উপায়ে দোকান খোলা রাখতে হবে। কারণ, আমাকে ব্যাংক ঋণের কিস্তি দিতে হয়। দোকান খোলা থাকলে কিছু না কিছু বিক্রি হয়। তাই এর কোনো বিকল্প নেই।’

নিউমার্কেট এলাকাতেও দেখা গেছে প্রায় একই দৃশ্য। সব শপিংমল ও বিপণিবিতান বন্ধ। এলিফ্যান্ট রোড থেকে গাউছিয়া কিংবা নীলক্ষেত কোথাও ক্রেতা-বিক্রেতাদের চিরচেনা সেই ভিড় নেই।

তবুও, এই এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় যে কারো কানে ভেসে আসতে পারে, কি চাচ্ছেন ভাই? কোন বইটা দরকার?  ফটোকপি করতে হবে… ইত্যাদি প্রশ্ন।

নীলক্ষেত মার্কেটের বই ব্যবসায়ী মোহাম্মদ তুহিন বললেন, ‘আমরা কোনোভাবে টিকে আছি। গত এক বছর ধরে যে পরিস্থিতি চলছে তাতে আমরাই সবচেয়ে বেশি ভুগছি।’

২৯ বছরের তুহিন মার্কেটের বাইরের অংশে একটা বন্ধ দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চে বসেছিলেন। তার নিজের দোকানটি মার্কেটের একটু ভেতরে। ক্রেতার জন্য বাইরে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তার। মঙ্গলবার দুপুর একটা পর্যন্ত তুহিন ৫৬০ টাকায় একটা বই বিক্রি করেন। যাতে তার লাভ ছিল মাত্র ৬০ টাকা।

তুহিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই মার্কেটে তার পরিবারের দুটি বইয়ের দোকান আছে। কিন্তু, মহামারির কারণে গত বছরের মার্চ মাস থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় বিক্রিতে ধস নেমেছে। এককভাবে তুহিনের ক্ষতি হয়েছে দুই লাখ টাকার বেশি।

তুহিন বলেন, ‘আমার পরিবার এই মহামারির সবচেয়ে বড় শিকার।’

কাছাকাছি একটা স্টেশনারি পণ্যে বিক্রির দোকানের শাটার ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল একজন বিক্রয়কর্মীকে। তিনি এমনভাবে দাঁড়িয়েছিলেন যাতে পুলিশ দেখার সঙ্গে সঙ্গে শাটারটি নামিয়ে ফেলতে পারেন।

ওই বিক্রয়কর্মী বলেন, ‘যদি ধরা পড়ি তাহলে সন্ধ্যার আগে ছাড়া পাব না।’

হাতিরপুলেও এমন অনেক ব্যবসায়ীকে ক্রেতার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। টাইলস ও স্যানিটারি পণ্যের ব্যবসায়ী গোলাম রসুল ছিলেন তেমনই একজন। তিনি বলেন, ‘আমি জানি কোনো কাস্টমার আসবে না। কিন্তু বাড়িতে বসে থেকেই বা কী করব? সামনে ঈদ। বুঝতে পারছি না এ অবস্থায় সবকিছু কীভাবে সামলাবো?’

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীরা খুবই অসুবিধার মধ্যে আছি। সবধরনের কলকারখানা, ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ও শেয়ার মার্কেট খোলা। আমরাও স্বাস্থ্যবিধিসহ অন্যান্য নিয়ম মেনে দোকান খোলা রাখতে চাই।’

বংশালের অটো-পার্টস বিক্রেতা মাজহারুল ইসলাম মাসুদও খুব শিগগির তার দোকানটি খুলতে চান।

Comments

The Daily Star  | English
Foreign investors confidence in Bangladesh

Safety fear jolts foreign investors’ confidence

A lack of safety in foreign manufacturing and industrial units in Bangladesh, stemming from the debilitating law and order situation and labour unrest, has become a cause of major concern for foreign investors, denting their confidence.

15h ago