হীরক রাজ্যের জিন্দা লাশেরা

রফিকের রিকশাটা রাস্তায় উল্টো করে ফেলা। রাজপথে এমন উল্টে থাকা রিকশার দীর্ঘ লাইন। চার দিন টানা কাজ না করে থাকা রফিক এক হাজার দুই শ টাকা জরিমানা দিয়ে ছাড়াতে পারেন না রিকশাটাকে। নিজের অক্ষমতায় কাঁদতে থাকেন তিনি। কখন থামতে হয় জানেন না। মুখে শুধু এক কথা, ‘রোগ মানাইমু, কিন্তু পেটের ক্ষিধা মানাইমু কী দিয়া? একবেলা না খাইলেও তো আরেকবেলা খাইতে হয়... হয় না?’
লকডাউনে বের হওয়ার কারণে রিকশা উল্টে রাখা হয়েছে। ১৭ এপ্রিল ২০২১। ছবি: আমরান হোসেন/স্টার

রফিকের রিকশাটা রাস্তায় উল্টো করে ফেলা। রাজপথে এমন উল্টে থাকা রিকশার দীর্ঘ লাইন। চার দিন টানা কাজ না করে থাকা রফিক এক হাজার দুই শ টাকা জরিমানা দিয়ে ছাড়াতে পারেন না রিকশাটাকে। নিজের অক্ষমতায় কাঁদতে থাকেন তিনি। কখন থামতে হয় জানেন না। মুখে শুধু এক কথা, ‘রোগ মানাইমু, কিন্তু পেটের ক্ষিধা মানাইমু কী দিয়া? একবেলা না খাইলেও তো আরেকবেলা খাইতে হয়... হয় না?’

ক্ষুধার দুনিয়ায় করোনার ত্রাসের রাজত্ব চলে না। সেখানে পেটের চিতাই করোনার শ্মশানের চাইতে বেশি জ্বলে, বেশি জ্বালায়। দিন যত বাড়ে রফিকদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে বাড়ে ক্ষুধার অসহ্য কান্নার শব্দও। রফিকদের কাছে জীবন হলো মৃত্যুর একটা সুড়ঙ্গ ধরে হাঁটা মাত্র। ওরা না জীবিত, না মৃত। ওরা জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়ানো ‘জিন্দা লাশ’।

দিব্বি জলজ্যান্ত মানুষ জিন্দা লাশ হয় কীভাবে? কেন রফিকদেরই ইতিহাসের ঘুরপথে জিন্দা লাশ হওয়া লাগে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তো দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তুক অ্যাচিলি এমবেমবের ‘নেক্রোপলিটিকস’ কনসেপ্টটি দিয়েই বোঝানো সবচেয়ে সহজ। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারী একটা রাজনৈতিক চর্চার নাম হলো নেক্রোপলিটিকস। এই রাজনীতিতে রাষ্ট্র যে শুধু সরাসরি খুনের ক্ষমতা বহাল রাখে তাই না, বরং নিজের ভঙ্গুর ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য নাগরিকদের ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার ক্ষমতাও পোষণ করে। রাষ্ট্রের দুঃশাসন দাঁড়িয়ে থাকে জনগণের মৃত্যুকূপের ওপর ভর করে, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ‘জিন্দা লাশ’ হয়ে টিকে থাকে।

করোনা মহামারি যখন পুরো বিশ্ব উজাড় করছে, তখন তাকে মোকাবিলা করতে পৃথিবীর বহু দেশ ঠিক এই রাজনৈতিক চর্চাটাকেই বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য করতে গিয়ে বাংলাদেশ সরকার তার প্রান্তিক ও শ্রমিক জনগোষ্ঠীকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। প্রান্তিক মানুষের ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা না করে যে লকডাউনের পথ সরকার বেছে নিয়েছে, তা তাদের নেক্রোপলিটিকসেরই একটা হাতিয়ার মাত্র। এখানে কিছু জীবন অনেক জীবনের চাইতে বেশি দামি। আর তাই অনেক ‘নগণ্য’ জীবনের দামে কিছু ‘মূল্যবান’ জীবন বাঁচানোই রাষ্ট্রের করোনাকালের শাসন-নীতি, নেক্রোপলিটিকস।

মহামারির এই সময়ে কার জীবন বেশি নগণ্য? কারটা দামি? কিসের মানদণ্ডে কার জীবনটা রাষ্ট্র বাঁচাতে চাচ্ছে কার জীবনের দামে? এই নেক্রোপলিটিক্যাল জামানায় জীবনের মূল্য বিচার করা হচ্ছে অর্থনীতি ও ক্ষমতার লাভক্ষতির দর-কষাকষি করে। কিছু জীবন অন্য জীবনের সাপেক্ষে দামি তার পেশা, শ্রেণি, ক্ষমতা চর্চার ক্ষমতাটা কতখানি তার ওপর ভিত্তি করে। এই অপেক্ষাকৃত ধনী ও সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা মানুষগুলোর জন্যে লকডাউন খুব বেশি লাভজনক না হলেও অন্তত ক্ষতিকর না। লকডাউনে এদের জীবিকার রশিতে টান পড়ে না। দিব্বি ঘরে বসে কাজ করে মাস ফুরোলে বেতনটা, ব্যবসার মুনাফাটা তারা পেয়ে যান। এই সচ্ছল ও সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই তাদের অফিস অনলাইনে চালাতে পারছেন, কারখানা খোলা রাখতে পারছেন।

মনে রাখার বিষয় যে করোনা-পূর্ববর্তী সময়ের সচ্ছল অনেক মানুষই কিন্তু এই ‘দামি ও নিশ্চিত’ জীবনের দল থেকে ছিটকে পড়েছেন। সরকার বলছে, করোনার প্রথম ধাক্কা সামাল দিতে তারা এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত কোটি টাকার অন্তত ২৩টি প্রণোদনা কর্মসূচি নিয়েছে। কিন্তু, কারা পাচ্ছেন সেই প্রণোদনা? সেখানেও রাষ্ট্রের অসম চর্চা রয়েছে। প্রণোদনার ৮০ শতাংশ হলো ব্যাংকঋণের মাধ্যমে তারল্য সহায়তা, বাকিটা আর্থিক প্রণোদনা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ট্রেড লাইসেন্স, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ও জামানত দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সম্পদের অভাব সংক্রান্ত জটিলতায় প্রণোদনার অর্থ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে কারখানা সেসব ধনীরাই খুলতে সক্ষম হয়েছে যারা প্রণোদনার অর্থ বেশি পেয়েছেন। সরকারের প্রণোদনা কর্মসূচি এমনভাবে গৃহীত হয়েছে যা শুধুমাত্র ধনী ও বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ও সুবিধাকে নিশ্চিত করছে। ফলে অনেক ছোট ছোট শিল্প-উদ্যোগ মরে যাচ্ছে, একই পরিণতি সেগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকা মানুষগুলোরও।

বাকিদের জীবনের কী দশা? আমরা সবাই জানি যে শ্রমিক, কৃষকের জীবন দামি না! কিন্তু, এই জীবন আমাদের অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর জন্যে, ভাতের জোগান দেওয়া জন্যে জরুরি। শ্রমিক-কৃষকের এই জীবন যেকোনো পরিস্থিতিতেই এমনকি মহামারিকালেও ‘খরচযোগ্য’ জীবন, প্রাণঘাতী রোগের ভয়েও শ্রম দেওয়া থেকে বিরতি নেওয়ার সুযোগ এই জীবনের নেই। বরং এই জীবনের মূল্য নির্ভর করছে করোনাকালে কতোটা দক্ষতার সঙ্গে একে কতখানি খরচ করে সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করা যাচ্ছে তার ওপর। রাষ্ট্র তার অর্থনীতিকে টেকানোর জন্য, ‘দামি’ নাগরিকদের বাঁচানোর জন্য, সুবিধা দেওয়ার জন্য এসব কমদামি জীবনকে শুধু মৃত্যুর মুখেই ঠেলে দিচ্ছে না, বরং তাদের মৃত্যুটাকেও যতটা পারা যায় উৎপাদনশীল বা লাভজনক করে তুলছে।

করোনাকালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে বাঁচিয়ে রাখার মূল্যটা শ্রমিক দিচ্ছে তার নিজের জীবনের দামে। দেশে লকডাউন চলছে, কিন্তু কারখানা বন্ধ হয়নি। কারখানা বন্ধ রাখলে বিশ্ব বাজারের প্রতিযোগিতা থেকে বাংলাদেশ ছিটকে পড়বে এবং শ্রমিক তার কর্মসংস্থান হারাবে। এই আতঙ্কটি পুরোপুরি মিথ্যা নয়। কিন্তু, একে বিশ্ববাজারে ও স্থানিক পরিসরে ন্যায্য বিচারের দাবি তুলে মোকাবিলা না করে রাষ্ট্র ও মালিকপক্ষ উভয়েই এই আতঙ্কটিকে পেলে-পুষে বড় করছে। বেকারত্ব ও ক্ষুধার যন্ত্রণা লাখো শ্রমিক গত বছর দেখেছেন। সেই যন্ত্রণা ও ভয়টিকেই রাষ্ট্র কাজে লাগাচ্ছে অর্থনীতি চালু রাখার জন্যে শ্রমিকদের মৃত্যু পথে হাঁটতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে। শ্রমিক তাই নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কারখানার কল ঘোরাচ্ছেন। বিনিময়ে কী পাচ্ছেন তারা? তাদের কারখানা খোলা আছে, কিন্তু, যাতায়াতের ব্যবস্থা নেই।

শ্রমিকের যাতায়াত ‘স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করবে’, এমন কথা সরকারি প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হলেও কারখানা কর্তৃপক্ষরা তা মানছে না। মালিকদের এই আদেশ ভাঙা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আইনি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, নেওয়া হয়নি জরিমানা করার কোনো ব্যবস্থাও। ফলে লকডাউনে সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ করে শ্রমিকের জীবন আরও কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। কারখানার ভেতর ও বাইরে নিরাপদ স্বাস্থ্যকর পরিবেশ কিংবা করোনায় আক্রান্ত হলে শ্রমিকের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়নি। সংক্রমণ হলে তারা চাকরি হারাবেন না, সেরকম নিশ্চয়তাও তাদের দেওয়া হয়নি। সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার খোলা থাকছে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। আর কারখানা বন্ধ হচ্ছে বিকেল ৫ বা ৬টায়। তাহলে একজন শ্রমিক তার প্রয়োজনীয় জিনিস কখন কিনবেন? কারখানার কর্তৃপক্ষ কি শ্রমিকের হয়ে সেই বাজার করার দায়িত্ব নিয়েছেন? শ্রমিক দেশের অর্থনীতি চাঙা করার জন্যে জীবনের ঝুঁকি নেবেন, তাহলে তার মৌলিক অধিকার কেন বিবেচনা করা হচ্ছে না লকডাউনের নীতি প্রণয়নের সময়?

আবার অনেক কারখানাতেই অনেক শ্রমিকের বকেয়া বেতন আটকে রেখেই তাদের লকডাউনে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বেতনের দাবি তোলায় চলতি মাসেই বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রে ছয় জন শ্রমিককে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে, আহত করেছে ৫০’র অধিক শ্রমিককে। রাষ্ট্র চাইলে তার ক্ষমতা ও আইন দিয়ে এস আলম গ্রুপকে বাধ্য করতে পারত শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিতে। কিন্তু, তা করা হয়নি, করার প্রয়োজনও বোধ হয়নি। কারণ এস আলম গ্রুপের স্বাচ্ছন্দ্য ও মুনাফা শ্রমিকের জীবনের চাইতে বহুগুণ বেশি দামি। কেন? কারণ যতক্ষণ ক্ষুধার ওই ত্রাস মানুষের মাঝে আছে, কোনো রকম একটা চাকরি পাওয়ার ক্ষুধা আছে, ততক্ষণ শ্রমিকের অভাব নেই দেশে। আর ঠিক ততক্ষণ শ্রমিকের বেতনের চাইতে শ্রমিকের লাশ এদেশে বেশি লাভজনক, সেই লাশ গুলিতেই হোক কিংবা করোনায়। লাভের এই যোগ-বিয়োগেই রাষ্ট্র কারও জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করছে অন্যের জীবনের দামে।

অন্যদিকে যেসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সরাসরিভাবে রাষ্ট্রের অর্থনীতি কিংবা দেশের ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর টিকে থাকার জন্য জরুরি নয়, বরং যা নিম্ন আয়ের মানুষের ব্যক্তিগত জীবিকার অংশ, রাষ্ট্র লকডাউনের নামে সেসব কার্যকলাপ বন্ধ করে সেই জীবিকার সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোকেও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ঠেলে দিচ্ছে। কঠোর লকডাউন করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্যে অনেকগুলো কার্যকর ব্যবস্থার মধ্যে একটি। কিন্তু, একমাত্র ব্যবস্থা নয়। গত বছরও আমরা দেখেছি যে ধনী ও কম জনবসতির দেশগুলোতে যে ধরনের নীতি ও লকডাউন আরোপ করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের মতো ঘন-জনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য কার্যকর কোনো সমাধান নয়। গবেষণার তথ্য বলছে, শুধু গত এক বছরেই করোনা আড়াই কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রান্তিক মানুষের সঞ্চয় কমেছে ও বেকারত্বের কারণে আয় কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে, অন্যদিকে ঋণ বেড়েছে আকাশচুম্বী। মানুষের ঋণ নেওয়ার উৎসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ফলে নতুন করে দেওয়া এই লকডাউনকে মোকাবিলা করার জন্যে ঋণ নেওয়ার আগের নেটওয়ার্ক অনেক ক্ষেত্রেই কাজে আসছে না। লকডাউনের আগে থেকেই শহুরে শ্রমজীবী মানুষের মাঝে খাদ্য সংকট ছিল, যা এখন আরও তীব্র আকারে রূপ নেবে সেটা বোঝার ক্ষমতা সরকারের আছে। সবকিছু জেনে-বুঝেও এরকম পরিস্থিতিতেও গরিবের জন্যে রেশন ও ন্যূনতম ভাতা নিশ্চিত না করে একটি অপরিকল্পিত ‘কঠোর লকডাউন’ কার্যকর করতে গিয়ে সরকার এই প্রান্তিক মানুষদের মৃত্যুর পথই তৈরি করছে। বাংলাদেশের মতো একটা দেশে যেখানে বেশিরভাগ মানুষ দিন আনে দিন খায় এবং কাজ বন্ধ থাকলে চাকরি হারায়, সেখানে প্রান্তিক মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না করেই সরকার যেভাবে তাদের জীবিকার উপায় বন্ধ করেছে তাতে হাজারো মানুষ করোনায় না মরলেও ক্ষুধার কষ্টে ও অপুষ্টিতে ধুকে ধুকে মরবেন।

লকডাউন পোষাতে পারেন এমন উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেক সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর (সবাই নয়, বহু মধ্যবিত্তও এই লকডাউনের মাশুল গুনছেন) চলাচলের জন্য অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চলছে, চলছে তাদের নিজ নিজ দামি বাহন। রাষ্ট্র রেস্তোরাঁগুলোর সামনে ইফতার কেনার জন্য সেসব গাড়ি, মোটরসাইকেলের বহরের লম্বা লাইন বরদাস্ত করছে। কিন্তু, চারদিন পর যে রিকশাচালক পেটের জ্বালায় রিকশা চালাতে বের হলেন তার খাদ্য-চিকিৎসা, বাসস্থানের খরচের দায়িত্ব না নিয়ে সরকার তার রিকশা বাজেয়াপ্ত করার হুকুম দিয়েছেন। রিকশাচালকের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়কে বন্ধ করা হচ্ছে। কিন্তু, সুবিধাভোগীদের চিকন জিলাপি খাওয়ার শখকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। দুই কেজি চাল কেনার সামর্থ্য যেই রিকশাচালক হারিয়েছেন, রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী তার কাছ থেকে এক হাজার দুই শ টাকা জরিমানা আদায় করছে।

লক্ষ্য করার বিষয় ‘অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়ার’ নীতি ভঙ্গ করার জন্য রিকশার কোনো যাত্রীকে জরিমানা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে না। জরিমানা শুধু রিকশা বা অটোরিকশাচালকদের জন্যই প্রযোজ্য হচ্ছে। জরিমানা দেওয়ার পরেও অনেক পুলিশ ফাঁড়ি থেকে অটোরিকশার ব্যাটারি চুরি হয়ে যাচ্ছে, যা কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। একটি সরকারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিষ্ঠান থেকে গরিবের জীবিকার উপায় চুরি হচ্ছে কীভাবে? কে এই চুরি করছে? সেই অপরাধের শাস্তি কি কেউ পাচ্ছে? তার জরিমানা কি কেউ দিচ্ছে? সেই জবাবদিহিতা রাষ্ট্রের নেই।

শুধু পরিবহন শ্রমিক নয়, দেশের অগুনতি মানুষ যারা দিনমজুর কিংবা হতদরিদ্র, তারাও জিন্দা লাশ হয়েই বেঁচে আছেন সরকারের নেক্রোপলিটিকসের জন্যে। খাদ্য ও বাসস্থানের কোনো উপায় নিশ্চিত না করেই যে লকডাউন চলছে, তা পথশিশু ও গৃহহীন মানুষকে করোনার ক্ষেত্রে কতটা নাজুক করল আর কতটা ক্ষুধায় মারল তার হিসাব কে গুনবে? ফুল বা পানি বেঁচে যেই শিশু ভাত জোগাড় করত, সে শেষ কবে ভাত খেয়েছে তার খবর রাষ্ট্রের জানা আছে? জীবনে কখনো হাত পাতেননি এমন ৬৫ বছরের বৃদ্ধ নির্মাণশ্রমিক যখন পথে পথে ভিক্ষা চেয়ে বেড়াচ্ছেন আর চিৎকার করে নিজের মৃত্যু কামনা করছেন, তার মানসিক বিপর্যয় রাষ্ট্র বোঝে? দেড় লাখের মতো যৌনকর্মীর পেটে ভাত না পড়ার দায় রাষ্ট্র নিয়েছে? যেই ছাপোষা মধ্যবিত্ত গতবারের লকডাউনে চাকরি হারিয়ে আজ রাইড শেয়ার করে বাঁচতে শিখছিল, সে এখন কীভাবে বাঁচবে তার উপায় রাষ্ট্র বাতলে দিয়েছে?

যদি জীবন বাঁচানোই মূল উদ্দেশ্য হয় লকডাউনের, তবে কেন চারপাশে এত মানুষের ক্ষুধার চিৎকার, ক্ষুধার আতঙ্ক? যদি সেই ক্ষুধা মেটানোর জন্যে রেশন দেওয়ার ক্ষমতা না থাকে, তবে কেন এই লকডাউন? কার জন্যে এই লকডাউন, কার স্বার্থে এত মানুষের পেটে লাথি মারা? যার রেশন লাগে না, তার সংক্রমণ এড়াতে কেন এত মানুষকে মৃত্যুর দিকে, ক্ষুধার দিকে ঠেলে দেওয়া? আট শতাংশ জিডিপির দেশে কেন পর্যাপ্ত রেশন ও ভাতা দিয়ে একটি পরিকল্পিত ও কার্যকর লকডাউন দেওয়া যায় না?

জিন্দা লাশের জীবন কারও প্রাপ্য নয়। একটি স্বাধীন দেশের সব নাগরিকের বেঁচে থাকার ও শ্বাস নেওয়ার সমান অধিকার থাকার কথা। সেই কথাটা কেন হাপিস হয়ে যাচ্ছে? কেন করোনা মোকাবিলায় দেশের সব নাগরিকের জীবন ও জীবিকাকে সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না? ডিসেম্বরের শেষ থেকেই যখন জানা যাচ্ছিল করোনা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে দেশে আঘাত হানতে যাচ্ছে, তখনো সরকার কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলো না? মার্চের শুরু থেকে যখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বুঝতে পারছিল যে করোনা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে, তখনো কেন সংক্রমণ ঠেকাতে জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হলো না কিংবা সংক্রমিত জেলা থেকে দেশের অন্যত্র যাওয়াকে অনুৎসাহিত করা হলো না? দুই হাজার শয্যার যে হাসপাতালটি করোনা মহামারি মোকাবিলার জন্যে বসুন্ধরায় প্রায় ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বানিয়েছিল, তা কোথায় গায়েব হলো? ইউনিসেফের ১০২ কোটি টাকার চিকিৎসাসামগ্রী কেন বিমানবন্দরে বছর ধরে পরে থেকে নষ্ট হলো? এসবের জবাব সরকার দেয়নি। করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে তারা শুধু গরিব মারার একটি লকডাউন দিয়েছে।

করোনার ঢেউ সহজে থামার নয়। এই ঢেউ আমাদের সামাজিক অবিচার, অন্যায্য শ্রমবাজার, অকার্যকর নীতি, খুনি অর্থনীতি, ভঙ্গুর স্বাস্থ্যখাতের সুযোগ নিয়ে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে, আমাদের মধ্যকার অসমতাকে বাড়িয়ে তুলছে এবং প্রান্তিক মানুষকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড় করাচ্ছে। মহামারির এই ঢেউগুলোকে নাগরিকের জীবনের দামের ভেদাভেদ তৈরি করে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বরং এখন সময় দল-মত নির্বিশেষে একটি সমতাভিত্তিক সম্প্রদায় গড়ে তোলার। সবার জন্যে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ও জীবিকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া। সামাজিক নিরাপত্তা জালের পুরো ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজানো। যদি মরতে হয়, তাহলে মৃত্যু আমাদের সমানভাবে আঘাত করুক। যতটুকু বাঁচি, সমান অধিকার নিয়ে বাঁচি। ভেঙে যাক জিন্দা লাশ তৈরির সকল কারিগরি। মানুষ বাঁচুক মানুষ হয়ে। লাশ হয়ে নয়।

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: গবেষক, পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ, যুক্তরাষ্ট্র

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Battery-run rickshaw drivers set fire to police box in Kalshi

Battery-run rickshaw drivers set fire to a police box in the Kalshi area this evening following a clash with law enforcers in Mirpur-10 area

1h ago