কৃত্রিম প্রজননে এবার ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদনে সাফল্য
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় টেংরা, গুলশা, পাবদা ও বৈরালীসহ ২৪টি দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদনের পর এবার ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা পেয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। চলমান করোনা মহামারির মধ্যে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এ সাফল্য অর্জন করলেন। বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু হলে পুষ্টিসমৃদ্ধ বিলুপ্তপ্রায় ঢেলা মাছ শিগগির খাবারের তালিকায় যোগ হবে বলে আশা করছেন গবেষকরা।
ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ময়মনসিংহ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে গত দুই বছর ধরে নিবিড় গবেষণা চলছিল। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ঢেলা মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা পাওয়া গেছে। এই গবেষক দলে ছিলেন স্বাদু পানি গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এইচ এম কোহিনুর, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শাহা আলী, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিনা ইয়াসমিন ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আওয়াল।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয় ব্রহ্মপুত্র নদসহ বিভিন্ন উৎস থেকে ঢেলা মাছের পোনা সংগ্রহ করে কেন্দ্রের পুকুরে চাষ করা হয়। ঢেলা মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে সে অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা হয়। তা ছাড়া, বছরব্যাপী জিএসআই ও হিস্টোলজি পরীক্ষা করে ঢেলা মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করা হয়। হিস্টোলজি পরীক্ষায় দেখা যায় যে, ঢেলা মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম হচ্ছে মে-জুন। তবে এপ্রিলের শেষ দিক থেকে প্রজননকাল শুরু হয়।’
‘ঢেলা মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা হলো প্রতিগ্রামে ৭০০-৮০০টি। গবেষণায় দেখা যায়, একটি স্ত্রী ঢেলা মাছ প্রায় ছয় থেকে আট গ্রাম ওজনের হলেই প্রজনন উপযোগী হয়। প্রজনন উপযোগী পুরুষ ঢেলা মাছ আকারে অপেক্ষকৃত ছোট (চার থেকে পাঁচ গ্রাম) হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে ঢেলা মাছ সংগ্রহের সময় দেখা যায়, প্রকৃতিতে প্রতি চারটি স্ত্রী ঢেলার বিপরীতে মাত্র একটি পুরুষ ঢেলা পাওয়া যায়’— বলেন ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ।
তিনি আরও বলেন, ‘গবেষণায় ১০ জোড়া ঢেলা মাছকে হরমোন প্রয়োগ করা হয়েছিল। হরমোন প্রয়োগের আট থেকে নয় ঘণ্টা পরে মাছগুলো ডিম ছাড়ে এবং ২২ ঘণ্টা পরে নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু পোনা উৎপাদিত হয়। এ সময় ডিম নিষিক্ততার পরিমাণ ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। উৎপাদিত পোনা বর্তমানে ইনস্টিটিউটের স্বাদু পানি কেন্দ্রের হ্যাচারিতে
প্রতিপালন করা হচ্ছে।’
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘ঢেলা মাছ সহজেই চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে। অন্যান্য দেশীয় মাছের তুলনায় ঢেলা মাছে খনিজ পদার্থের পরিমাণ বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেলা মাছে ভিটামিন এ ৯৩৭ আইইউ, ক্যালসিয়াম এক হাজার ২৬০ মিলিগ্রাম ও জিংক আছে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। ভিটামিন এ শিশুদের রাতকানা রোগ থেকে রক্ষা করে, ক্যালসিয়াম হাড় গঠনে সহায়তা করে। তা ছাড়া, জিংক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।’
গবেষকরা জানান, দেশের নদ-নদী ও হাওড় বিলে আগে প্রচুর পরিমাণে ঢেলা মাছ পাওয়া যেত। জলবায়ু পরিবর্তন, অতি আহরণ ও জলাশয় কমে যাওয়ায় ঢেলা মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র নষ্ট হয়ে যায়। যে কারণে বিলুপ্তিপ্রায় মাছের তালিকায় চলে আসে। ঢেলা মাছ এখন প্রায় দুষ্প্রাপ্য এবং বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় ঢেলা মাছ সংরক্ষণ এবং চাষের মাধ্যমে এর উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, ইনস্টিটিউটে বর্তমানে পিয়ালী, কাজলী, বাতাসি, কাকিলা, রাণী ও গাং টেংরাসহ আরও ১০টি মাছ নিয়ে গবেষণা চলছে।
বিএফআরআই ইতোমধ্যে পাবদা, গুলশা, টেংরা, বৈরালীসহ ২৪টি দেশীয় ও বিলুপ্তপ্রায় মিঠা পানির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে চাষের মাধ্যমে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার মেট্রিক টন। পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে আড়াই লাখ মেট্রিক টন হয়েছে। অর্থাৎ গত এক যুগে উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ।
Comments