ঢাকায় সত্যজিৎ রায়
সত্যজিৎ রায়। নামটি শুনলে চোখের সামনে ভাসে তার চলচ্চিত্র, সাহিত্য কর্ম, তার তৈরি কল্পিত গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু। শুধুই কী তাই? রবীন্দ্রনাথ ছাড়া একমাত্র সত্যজিৎ রায়ই বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাকে পরিচয় করিয়েছেন বৈশ্বিক ভাষারূপে।
সত্যজিৎ রায়ের জন্ম কলকাতায়। তার বাবা প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক ও ছড়াকার সুকুমার রায়ের জন্মও কলকাতায়। কিন্তু পূর্ববঙ্গ ও ঢাকার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের যোগাযোগ ছিল। সেটা শুধু কর্মসূত্রে নয়, আরও বেশ কিছু পথে। সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গের। যেমন সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর জন্ম পূর্ববঙ্গের তথা আজকের বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের মসুয়ায়। তাদের পূর্বপুরুষ শ্রী রামসুন্দর দেব পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার চাকদহ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন৷ একসময় ভাগ্যান্বেষণে রামসুন্দর দেব তার পৈতৃক নিবাস ছেড়ে পূর্ববঙ্গের শেরপুরে এসেছিলেন৷ সেখানে শেরপুরের জমিদার বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা হয় যশোদলের জমিদার রাজা গুণীচন্দ্রের৷ রাজা গুণীচন্দ্র রামসুন্দরের সুন্দর চেহারা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হয়ে রামসুন্দরকে তার জমিদারিতে নিয়ে যান৷ যশোদলে জমিজমা, ঘরবাড়ি দিয়ে তিনি রামসুন্দরের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দেন। সেই থেকে রামসুন্দর যশোদলে বসবাস শুরু করেন৷ তার বংশধররা সেখান থেকে চলে যায় কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলায় মসুয়া গ্রামে। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর বাবা তথা সত্যজিৎ রায়ের প্রপিতামহ কালিনাথ রায় ছিলেন ভীষণ সুদর্শন। তিনি ছিলেন একাধারে আরবি, ফারসি, বাংলা ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত। তাকে সবাই ডাকতেন শ্যামসুন্দর মুন্সী নামে।
উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে তৎকালীন প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তিও পেয়েছিলেন। তারপর কলকাতায় গিয়ে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। তিনি কলকাতায় চলে গেলেও পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল বহু বছর।
উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর নামের শেষে ‘চৌধুরী’ কীভাবে এলো সেটাও আরেক গল্প। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয়েছিল কামদারঞ্জন রায়। তার বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন তার বাবার এক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায় চৌধুরী তাকে দত্তক নেন। এরপর তার নতুন নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী।
সত্যজিৎ রায়ের বাবা সুকুমার রায় ও পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর সঙ্গে বরাবরই পূর্ববঙ্গের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের জন্মের ছয় বছর আগে মারা যার উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, আর মাত্র আড়াই বছর বয়সে বাবাকে হারান সত্যজিৎ রায়। এখানেই তার পূর্ববঙ্গের সঙ্গে ছেদ পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার মামার বাড়ি ছিল ঢাকার ওয়ারীর র্যাংকিং স্ট্রিটে।
ঢাকার প্রথম আবাসিক এলাকা ছিল ওয়ারী। ছোটবেলায় দু-তিন দিন ঢাকায় ছিলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু কোন বাড়িতে ছিলেন তা তার মনে নেই। তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ বা ছয় বছর। সত্যজিৎ রায়ের সেটাই ছিল সর্বপ্রথম ঢাকায় আসা। তিনি পরবর্তী বার যখন ঢাকায় এলেন তখন হয়ে উঠেছেন বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, গুণী সাহিত্যিক। অন্যদিকে, বাংলাদেশ তখন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। সত্যজিৎ রায়কে আমন্ত্রণ জানানো হয় ১৯৭২ সালের শহীদ দিবস উপলক্ষে। স্বাধীন বাংলাদেশে সে বছরই প্রথম পালিত হয় শহীদ দিবস। সত্যজিৎ রায়সহ ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী, সাহিত্যিক, পরিচালকরা ঢাকায় আসেন ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।
পল্টন ময়দানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আয়োজনে শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সত্যজিৎ রায়। নিজের পিতৃভূমিতে এসে আবেগ সামলাতে পারেননি আজীবন আবেগ সামলে রাখা সত্যজিৎ রায়। প্রধান অতিথি হিসেবে তার দেওয়া বক্তব্যে যেন সেই আবেগেরই সংমিশ্রণ ঘটলো। সত্যজিৎ রায়ের সে বক্তব্যে উঠে এসেছে ভাষার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের মমত্ববোধ, তার শৈশবের স্মৃতি, চলচ্চিত্র ও এদেশের প্রতি তার অসীম কৃতজ্ঞতা।
তিনি বলেন, ‘বহুদিন থেকে শহীদ দিবসের কথা শুনে আসছি। একুশে ফেব্রুয়ারির কথা শুনে আসছি। কিন্তু এখানে এসে নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না আপনারা বাংলা ভাষাকে কতখানি ভালোবাসেন। বাংলা ভাষা যখন বিপন্ন, তাকে বাঁচানোর জন্য যে সংগ্রাম হয়েছিল, তাতে যারা আত্মোত্সর্গ করেছেন তাদের যে কতখানি শ্রদ্ধা করেন আপনারা, সেটা আমি আজকে এখানে এসে বুঝতে পারছি।’
‘আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গে থাকি, আমরাও বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি। এটা ঠিক যে, পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির মধ্যে আরও পাঁচ রকম সংস্কৃতির প্রভাব এসে পড়ায় সেটাকে একটা পাঁচমিশালি ভাব এনে দিয়েছে। ইংরেজির প্রভাব আমরা এখনও পশ্চিমবঙ্গে সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তার একটা কারণ বোধ হয় এই যে, পশ্চিমবঙ্গ হলো ভারতবর্ষের একটা প্রাদেশিক অংশমাত্র। কিন্তু তাই বলে এই নয় যে, আমরা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি না। বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান, বাংলা চলচ্চিত্র, বাংলা থিয়েটার এসবই পশ্চিমবঙ্গে এখনও বেঁচে আছে, টিকে আছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিমচন্দ্র, শরত্চন্দ্র এদের আমরা এখনো ভালোবাসি।’
‘আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি যে, আজ ২০ বছর ধরে বাংলা ছবি করছি। এর মধ্যে বহুবার বহু জায়গা থেকে অনুরোধ এসেছে যেন আমি বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করে অন্য দেশে, অন্য ভাষায় চিত্র রচনা করি। কিন্তু আমি সেই অনুরোধ বারবার প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ আমি জানি, আমার রক্তে যে ভাষা বইছে, সে ভাষা হলো বাংলা ভাষা। আমি জানি যে সেই ভাষাকে বাদ দিয়ে অন্য ভাষায় কিছু করতে গেলে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে, আমি কূলকিনারা পাব না, শিল্পী হিসেবে আমি মনের জোর হারাব।’
‘আমি ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি যে পূর্ববঙ্গ নাকি আমার দেশ। আমার ঠাকুরদাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়ের নাম হয়তো আপনারা কেউ কেউ শুনেছেন। আমার তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু শিশুকাল থেকে আমি তার রচিত ছেলেভোলানো পূর্ববঙ্গের কাহিনী “টুনটুনির বই” পড়ে এসেছি, ভালোবেসে এসেছি। তার রচিত গানে আমি পূর্ববঙ্গের লোকসংগীতের আমেজ পেয়েছি। যদিও আমি এ দেশে আসিনি, আমার দেশে আমি কখনো আসিনি বা স্থায়ীভাবে আসিনি। এসব গান, এসব রূপকথা শুনলে আমার মনে হতো যে এ দেশের সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ রয়েছে।’
‘যখন আমার পাঁচ কি ছয় বছর বয়স, তখন আমি একবার ঢাকা শহরে এসেছিলাম। দু-তিন দিন মাত্র ছিলাম। আমার মামার বাড়ি ছিল ওয়ারীতে, র্যাংকিং স্ট্রিটে। সে বাড়ি এখন আছে কি না জানি না। সে রাস্তা এখন আছে কি না জানি না। বাড়ির কথা কিছু মনে নেই। মনে আছে শুধু যে প্রচণ্ড বাঁদরের উপদ্রব। বাঁদর এখনও আছে কি না, তা-ও আমি জানি না। তারপর মনে আছে পদ্মায় স্টিমারে আসছি। ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেছে, মা আমাকে বাইরে ডেকে এনে দেখাচ্ছেন যে পদ্মার ওপর সূর্যোদয় হয়েছে। আর দেখাচ্ছেন যে পদ্মা ও মেঘনার জল যেখানে এসে মিশেছে, সেখানে এক নদীর জলের রঙের কতো তফাত। সেই থেকে বারবার মনে হয়েছে যে একবার নিজের দেশটা দেখে আসতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু সে আশা, বিশেষত দেশ বিভাগের পর ক্রমেই দুরাশায় পরিণত হতে চলেছিল। হঠাৎ কিছুদিন আগে ইতিহাসের চাকা ঘুরে গেল, আমার কাছে আমার দেশের দরজা খুলে গেল এবং আজ শহীদ দিবসে এসে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে। ঢাকা শহরে এসে আমার স্বপ্ন অন্তত কিছুটা অংশে সফল হলো। এবার আমি অনেক জরুরি কাজ রেখে চলে এসেছি। এবার আর বেশি দিন থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু আমার ইচ্ছা আছে, আমার আশা আছে, অদূর ভবিষ্যতে আমি আবার এ দেশে ফিরে আসব। এ দেশটাকে ভালো করে দেখব। এ দেশের মানুষের সঙ্গে এমনভাবে জনসভায় নয়, সামনাসামনি, মুখোমুখি বসে কথা বলে তাদের সঙ্গে পরিচয় করব। এ আশা আমার আছে। আমি আর বিশেষ কিছু বলতে চাই না। সংগীতের অনুষ্ঠান রয়েছে, আপনারা যে আমার কাজের সঙ্গে পরিচিত বা আমার কাজ সম্পর্কে যে আপনাদের কৌতূহল আছে, সে খবর আমি এর আগেই পেয়েছি। কয়েক বছর আগে যখন মহানগর ছবি এখানে দেখানো হয়েছিল, তাতে এখানকার জনসাধারণ কী ধরনের আগ্রহ, কৌতূহল প্রকাশ করেছিলেন এবং তার ফলে কী ঘটনার উদ্ভব হয়েছিল, সে খবর আমার কানে যখন প্রথম পৌঁছায়, আমি সে কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু তারপর এখান থেকে বহু পরিচিত-অপরিচিত ব্যক্তি, বন্ধু আমাকে চিঠি লিখে খবরের কাগজের খবর কেটে পাঠিয়েছিলেন। ছবি কেটে পাঠিয়ে আমাকে জানিয়েছিলেন সে ঘটনার কথা। তখন বিশ্বাস হয়েছিল এবং বিস্ময়ে আমি হতবাক হয়ে গেছিলাম। আমি ভাবতে পারিনি যে এটা হতে পারে। একজন শিল্পী হিসেবে এর চেয়ে বড় সম্মান, এর থেকে গর্বের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না।’
গত ২০ বছরে অনেক জায়গায় অনেক দেশে অনেকবার নানাভাবে সম্মানিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু জোর গলায় আজকে এখানে দাঁড়িয়ে এই শহীদ দিবসের পুণ্য তিথিতে আমি বলতে পারি যে আজকের যে সম্মান, সে সম্মানের কাছে আগের সমস্ত সম্মান হার মেনে যায়। এর চেয়ে বড় সম্মান আমি কখনও পাইনি। আর আমার মনে হয় না, আমি আর কখনও পাব। জয় বাংলা।’
সে সফরে সত্যজিৎ রায় সাক্ষাৎ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। একত্রে তারা দারুণ সময় কাটিয়েছেন। সেটাই ছিল ঢাকায় সত্যজিৎ রায়ের সর্বশেষ সফর। সত্যজিৎ রায়ের আশা ছিল তিনি আবার আসবেন তার পূর্বপুরুষের দেশে, দেখবেন তার পূর্ব পুরুষের ভিটে। কিন্তু প্রচণ্ড কর্ম ব্যস্ততার কারণে তার আর আসার সুযোগ হয়নি।
সেই সফর নিয়ে মাসিক উল্টোরথ পত্রিকার ১৯৭২ সালের মার্চ সংখ্যায় ‘ঢাকার ডায়েরি’ নামে সফরের দিনলিপি লিখেছিলেন কলকাতার সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়। একই সংখ্যায় চলচ্চিত্র সাংবাদিক বিমল চক্রবর্তীও লিখেছিলেন ‘ঢাকা থেকে লিখছি’ নামে। অসমাপ্ত সেই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী শিল্পী চলচ্চিত্রসহ নানান কিছুর পরিচয় দেওয়ার পর তিনি লিখেছিলেন- ‘বিকাশ দা, আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, মনের আবেগে কতো কথাই তো এই চিঠিতে লিখে চলেছি। কলম আমার কিছুতেই থামতে চাইছে না।’
‘আজ আবার এই ঢাকায় বসেই স্বনামধন্য সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাও আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির বাসভবনে। সত্যজিৎ বাবুর সঙ্গে আরও অনেকে এলেন। শহীদ দিবসে ঢাকার ছাত্রলীগ যাদের নিমন্ত্রিত করে এনেছিলেন তারা প্রত্যেকে। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে শুধু একজন ঢাকায় আসতে পারেননি। তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। নির্ধারিত এই তারিখে কলকাতায় তার পারিবারিক কাজ ছিল বলে আসতে পারেননি। আর সবাই এসেছেন। শ্যামল মিত্র, অমল মুখার্জী, সুমিত্রা মুখার্জী, বরুণ বক্সী ও আমাদের টুলু দাশ। ওদের সঙ্গে করে নিয়ে এলেন ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সেলিম আবার বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে। এই তথ্য বঙ্গবন্ধুকে সেলিমের সম্বোধন থেকেই বুঝলাম― “মামা, গান শুনবেন?” শেখ সাহেবের সরল স্বীকারোক্তি, “কেন শুনব না? গানই যদি না শুনতে ইচ্ছে করে তবে তো আমি ইয়াহিয়া খান হয়ে যাব।”’
‘একটুখানি হাসির গুঞ্জরন। একে একে প্রত্যেকে একটি করে গান শোনালেন বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু সবার প্রশংসাতেই সমান পঞ্চমুখ। শ্যামল মিত্রকেই দেখলাম সবচেয়ে বেশি কথা বলতে। সত্যজিৎ বাবু একরকম চুপচাপই ছিলেন। ফটোগ্রাফার টুলু দাশ সত্যজিৎ বাবুর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলাদা ছবি তুলতে চাইলেন। শেখ সাহেব জবাব দিলেন, “আলাদা কেন, সবাই আসুন, গ্রুপ ছবি তুলি।”’
‘তারপর চায়ের পালা। বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে সকলকে চা পরিবেশন করলেন। চায়ের আসরে ছাত্রলীগ সদস্য ও বাংলাদেশের নামী কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদ শেখ সাহেবকে বললেন, “জানেন, পশ্চিমবাংলার এরা স্বাধীনতা সংগ্রামের এই নয় মাস আমাদের জন্যে অনেক করেছেন।”’
‘শেখ সাহেব সোজাসুজি জবাব দিলেন, “আমি সব জানি। ওরা তোমাদের জন্যে যা করেছে সেই ঋণ তোমরা পিঠের চামড়া দিয়েও শোধ করতে পারবে না।” শুনে অবাক হলাম। একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এই পরিমাণ সরল স্বীকারোক্তি আমরা ভারতীয়রা ভাবতে পারি কি?’
সফর নিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ডায়েরিতে লিখেছিলেন,
‘২১শে ফেব্রুয়ারি
আমি আপনাদের সেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আপাতত ঢাকায় আছি। এসেছি একুশে ফেব্রুয়ারি। বোয়িংয়ে কলকাতা থেকে ঢাকা ২৫ মিনিটের পথ। কিন্তু তার জন্য যে হুজ্জতি পোহাতে হয় তাতে লন্ডন চলে যাওয়া যায়। এই ধরুন না, প্লেন প্রতিদিনই লেট। এয়ারপোর্টে বসে বসে হরিমটর জপ করতে হয়। আমাদের আসার দিন প্লেন তিন থেকে চার ঘণ্টা লেটে ছাড়লো। আমার বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যাচ্ছিলেন শ্রী সত্যজিৎ রায়। এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি তিনি বসে আছেন বেলা ৯টা থেকে। প্লেন ছাড়ল সাড়ে ১২টায়। সত্যজিৎ বাবুকে জিজ্ঞাসা করায় বললেন, না মশায় আমায় তো কেউ বলেনি যে লেট হবে।
১২৫ টাকা ভাড়া। তাও আবার মাল ২৫ কেজির একটু বেশি হলেই নগদ অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হবে। দুটো ফর্ম সই করতে হবে। ১৫ টাকার স্ট্যাম্প কিনতে হবে। কাস্টমস চেকিংয়ের পর পুলিশ দেহ তল্লাশি করবে। তারপর ছাড়া পাওয়া। প্লেনে উঠে অখাদ্য এক গেলাস অরেঞ্জ স্কোয়াশ মুখে ঠেকাতে না ঠেকাতেই দেখলাম পদ্মা পার হচ্ছি। সামনের সিটে সত্যজিৎ বাবু, ঋত্বিক বাবু বসে। ঋত্বিক বাবু বলছেন, মশায় আমার বাড়ি ঢাকায়। আমি সব চিনি।
ঋত্বিক ঘটক সত্যজিৎ বাবুকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করেন। ওদের কথা শুনছিলাম। ঋত্বিক বাবু বলছিলেন, পাবলিকের নগদ বিদায় হাততালি নিয়ে কী হবে সত্যজিৎ বাবু। এমন কিছু করুন যা সত্যিকারের সৎ ও মহৎ। সত্যজিৎ বাবু অন্যমনস্ক হয়ে মাঝে মাঝে কী সব ভাবছিলেন। পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই ঢাকা। সত্যজিৎ বাবুর জন্য ফুল নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে। আমার জন্য গাড়ি নিয়ে এসেছেন এক ভদ্রলোক। এয়ারপোর্টে একটা ফর্ম সই করতে হলো। সঙ্গে কত টাকা এনেছি তার ঘোষণা।
আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, শুনলাম কাল সারারাত লোকে জেগেছে। শহীদ মিনার লোকে লোকারণ্য হয়েছে। এখন ঘুমোচ্ছে শহর। লোকজন বেশি পথে নেই।
পথে যেতে যেতে কয়েকটি তোরণ চোখে পড়ল। গত যুদ্ধে ঢাকার যেসব মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছে, তাদের সম্মানার্থে তৈরি হয়েছে তোরণ। পথের মোড়ে মোড়ে ভাষা আন্দোলনের সুন্দর সুন্দর স্মারক।
অফিসে এসে সুখরঞ্জনের সঙ্গে দেখা হলো। বিকেলবেলা গেলাম শেখ সাহেবের বাড়িতে। আগে যেটি ছিল প্রেসিডেন্ট হাউস, এখন সেটি শেখ সাহেবের সরকারি বাসভবন। বাংলো প্যাটার্নের একতলা বাড়ি। সুন্দর লন। বাড়িটা হলো রমনা গ্রিনে। এ জায়গাটিতে এলে অনেকটা নিউদিল্লির মতো মনে হয়।
শেখ সাহেবের ঘরে ঢুকে দেখি সত্যজিৎ রায় বসে আছেন। আর গান গাইছেন দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় আর শ্যামল মিত্র। গানের পর বেশ মজা হলো। একটি মেয়ে গান গাইল। কে একজন পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলল, শেখ সাহেব, এ হলো বাংলাদেশের মেয়ে। শেখ হাসতে হাসতে বললেন, তাহলে ওরা কোথাকার? হাসির রোল উঠল। যে বলেছিল সে বেচারা তো লজ্জায় একেবারে চুপ।
গানের পর শেখ চা খেতে ডাকলেন। চা খাওয়ার সময় আমি এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিলাম। বললাম, আমি কিছুদিন এখানে আছি। মাঝে মাঝে দেখা হবে।
শেখ বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই হবে।
সন্ধ্যার পর ভাবলাম পল্টন ময়দানের সভায় যাব।
কলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিকরা এসেছেন। তাদের নিয়ে জনসভা। পরে বিচিত্রানুষ্ঠান। কিন্তু লোকের ভিড়ে এগুতে পারলাম না। প্রায় লাখ খানেক লোকের ভিড় সেখানে। চলে এলাম।
২২শে ফেব্রুয়ারি
আজ বিকেলে আবার শেখ দর্শন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতি শেখের সঙ্গে কলকাতার সাহিত্যিকদের এক সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছিলেন। শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন সেদিন প্রবোধ সান্যাল, মনোজ বসু, সন্তোষ ঘোষ, নীরেন চক্রবর্তী, দক্ষিণারঞ্জন বসু প্রমুখেরা।
শেখ ওদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বসালেন। এক এক করে পরিচয়ের পালা। সন্তোষ দা বললেন, আমার বাড়ি ফরিদপুরের রাজবাড়ি। প্রবোধ সান্যাল বললেন, আমার বাড়ি ফরিদপুরে ছিল। নীরেন চক্রবর্তীও বললেন, আমার বাড়ি ছিল ফরিদপুর। শেখ বললেন, আমার বাড়ি কোথায় জানেন? বাংলাদেশে। সবাই অপ্রস্তুত।
শেখ বললেন, আমার জীবনের বড় স্বপ্ন ছিল বাঙালিকে জাতি তৈরি করা। আমার সে স্বপ্ন সার্থক হয়েছে, বাঙালি আজ জাতি হয়েছে।
প্রবোধ বাবু বললেন, আপনি জেলখানায় প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর অপেক্ষা করেছেন। শেখ বললেন, আমার কিন্তু তাতে ঘুমের ব্যাঘাত হয়নি। আমি বিছানায় শোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়তাম। জানতামই তো মৃত্যু নিকটে। তাই আর চিন্তা করে কী হবে। শেখ একটু থেমে বাংলাদেশের ক’জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা বোধ হয় ভেবেছিলে আমি আর ফিরব না?
একজন বললেন, না শেখ সাহেব, সকলে কিন্তু তা ভাবিনি।
শেখ সাহেব বললেন, না, তোমরা ভেবেছিলে। আমি জানি।
শেখ বললেন, আমি দেখেছিলাম, সংগ্রাম করতেই হবে। ২৫শে মার্চ তাই আমি অর্ডার দিয়ে দিয়েছিলাম তোমরা অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়। যখন খবর পেলাম ওরা আমাদের টেলিফোন লাইন কেটে দেবে, তার আগেই আমি মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম চট্টগ্রামে। রাত ১২টার মধ্যে সে খবর গিয়ে পৌঁছল থানায় থানায়।
শেখের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের এই বিবরণ টেলিভিশনে ধরে রাখা হলো।
২৬শে ফেব্রুয়ারি
শেখ মুজিবুর রহমানকে যত দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। আজ গিয়েছিলাম পাবনার নগরবাড়িতে শেখের একটি সভা কভার করতে। রাত ৪টার সময় উঠে বেরুতে হলো। শেখের ইনফরমেশন অফিসার গাড়ি নিয়ে এসেছেন।
হোটেল থেকে আমি ও স্টেটসম্যানের মানস ঘোষ বের হলাম। প্রেসক্লাবে এসে হাজির হলাম। সেখানে অত ভোরেও চায়ের ব্যবস্থা ছিল। দেখি আর সব স্থানীয় সাংবাদিকরা এসে গেছেন। ৫টা নাগাদ আমাদের বাস ছাড়ল।
বেশ শীত শীত করছে। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। আমরা হাইওয়ে ধরে এগিয়ে চললাম। আরিচা যেতে গেলে প্রথমে দুটো ছোট ফেরি পার হতে হয়। তারপর পদ্মা। একটি ছোট ফেরি নাম যার তারাঘাট, সেখানে এসে খেজুরের রস খেলাম।
এরপর আরিচা ঘাট। সামনে পদ্মা। এখন আর প্রমত্তা নয়। দেখে মনে হয় এক কাকচক্ষু সরোবর। একদিকে পদ্মা চলে গেছে কুষ্টিয়া-রাজশাহী। ভাগীরথীর সঙ্গে মিশেছে সেখানে। আর একদিকে মিশেছে মেঘনার সঙ্গে। গতবারে আসার সময় দেখে এসেছি সেই সঙ্গম। বিশাল পারাপারহীন সমুদ্রের মত।
আমাদের বিশেষ স্টিমার তৈরি ছিল। ব্যবস্থা করেছিলেন ওয়াবদা। বাংলায় যাকে বলা হয় পানি ও বিদ্যুৎ-পর্ষৎ। কারণ তারা একটি প্রজেক্টের কাজ হাতে নিয়েছেন। নাম পাবনা প্রজেক্ট। বন্যা নিয়ন্ত্রণই এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য। বিশ্বব্যাংক এই প্রজেক্টের কাজে সাহায্য করবেন ঠিক করেছিলেন। কাজও আরম্ভ হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য কাজ স্থগিত রাখা হয়।
পদ্মার শোভা দেখতে দেখতে চলেছি। অনেক কাল আগে এই পদ্মার বুকের ওপর বজরা ভাসিয়ে দিনের পর দিন ঘুরেছেন কবি রবীন্দ্রনাথ। এই তো কিছুদূর গেলেই পড়বে শাহজাদপুর। আরও এগোলে কুঠিবাড়ি শিলাইদহ।
ঘণ্টা দুয়েক পরে আমরা এসে নামলাম নগরবাড়িতে। সেখান থেকে পদ্মার তীরে বালুর ওপর দিয়ে হাঁটতে হলো। রাস্তা তৈরি হচ্ছে। গাড়ি আসতে পারে না ঘাট পর্যন্ত। বেশ গরম লাগছে এখন, বালিতে পা ডুবে যাচ্ছে। মাইলখানেক আসার পর দেখলাম একটি বাস রয়েছে। সেটিতে উঠে আরও মাইল খানেক যেতে হলো। মাইল দুয়েক দূরে সভার স্থান। অন্তত লাখখানেক লোক জড়ো হয়েছে সেখানে। বেলা ১১টা বাজে। চড়চড়ে রোদ। তা উপেক্ষা করে জড়ো হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
আমরা গিয়ে মঞ্চে বসলাম। একটু পরে হেলিকপ্টার এলো। সভার মধ্যেই নামলো হেলিকপ্টার। আর সঙ্গে সঙ্গে বন্যার জলের মতো হাজার হাজার মানুষ ব্যারিকেড ভেঙে শেখ সাহেবের কাছে এগিয়ে এলো। শেখ তাদের ধমক দিলেন। কেউ শুনল না। তারপর শেখ নিজেই ভিড়ের মধ্যে গিয়ে ভিড় নিয়ন্ত্রণের কাজে লেগে গেলেন। একটু পরে কোদাল দিয়ে মাটি কাটলেন শেখ। বাঁধ তৈরির কাজের শুভ সূচনা হলো।
এবার মঞ্চে উঠে শেখ বললেন, আপনারা যদি চুপ করে না শোনেন তাহলে আমি চলে যাব। এতে ফল হলো। জনতা চুপ করে গেল। তারপর শেখ বক্তৃতা করতে আরম্ভ করলেন। বললেন সহজ সরল গ্রাম্য মানুষের ভাষায়। মানুষের হৃদয়ে গিয়ে সে ভাষা স্পর্শ করে। কখনও তিনি ক্রুদ্ধ, কখনও অশ্রুসজল, আবার কখনও পরিহাস তরল। এমনভাবে সাধারণ মানুষের ভাষায় একজন কথা বলতে পারতেন বলে শুনেছি। তিনি ফজলুল হক।’
১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিল চিরতরে ঘুমিয়ে যান সত্যজিৎ রায়। কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার, সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র-
সত্যজিৎ রায়ের প্রবন্ধ সংগ্রহ
বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারি ও বঙ্গবন্ধু: মুয়িন পারভেজ
মাসিক উল্টোরথ: বর্ষ ২১, সংখ্যা ১, চৈত্র, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ, মার্চ ১৯৭২
আহমাদ ইশতিয়াক, [email protected]
Comments