উল্টো পথে ‘লকডাউন’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুহার যখন কিছুটা কমতে শুরু করেছে, ঠিক তখন দোকানপাট খোলার সিদ্ধান্ত করোনা মোকাবিলায় সরকারের সব প্রচেষ্টাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দোকানপাট খুলে দেওয়ার বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর গতকাল জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বেনজির আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা মাত্রই করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী হার কমিয়ে একটা উইন-উইন সিচুয়েশনের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু, এখন আমরা আবার লুজ-লুজ সিচুয়েশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে সরকার জানিয়েছে, যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আগামীকাল থেকে দোকানপাট পুনরায় খুলতে পারে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে আরোপিত চলমান বিধিনিষেধের দশম দিনে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।
উপসচিব মো. রেজাউল ইসলামের স্বাক্ষরিত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘২৫ এপ্রিল হতে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দোকানপাট খোলা থাকতে পারে।’
এর আগে, কোভিড-১৯ বিষয়ক একটি প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞ কমিটি পরামর্শ দিয়েছিল, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার পরে সরকার পর্যায়ক্রমে বিধিনিষেধগুলো তুলে নেবে।
রবিবার এক বৈঠকে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি (এনটিএসি) এক বৈঠকে বিধিনিষেধ কঠোর করে আরও এক সপ্তাহের জন্য ‘লকডাউন’ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়।
এ বিষয়ে গতকাল বিশেষজ্ঞরা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এই মুহূর্তে দোকানপাট ও শপিংমল খুলে দিলে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। কারণে, ঈদের কেনাকাটা করতে মানুষ সেখানে ভিড় করবে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে আরও বলেন, ‘কোভিড-১৯-এর কারণে সরকার ইতোমধ্যে যে পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়েছে—দোকানপাট খুলে দেওয়ার পর যদি সংক্রমণ আবারও বেড়ে যায়, তাহলে এই ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে।’
গতকাল সরকারের এই ঘোষণার পরই পরিবহন শ্রমিক-নেতারা বাস ও মিনিবাস পুনরায় চালুর অনুমতি চেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানিয়েছেন, ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত চলমান ‘লকডাউন’ শেষে তারা আবারও বাস চলাচল শুরু করতে চান।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছি, তবে এখনো পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
সারাদেশে চলমান ‘সর্বাত্মক লকডাউনের’ দশম দিন এসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুহার দুটোই কমতে শুরু করে। গতকাল পর্যন্ত দেশে একদিনে ৮৮ জনের মৃত্যু ও তিন হাজার ৬২৯ জনের করোনা শনাক্ত করা হয়।
গত ১৬ এপ্রিল কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফলাফলে পজিটিভ শনাক্তের হার ছিল ২৩ শতাংশ। এরপর থেকে শনাক্তের হার ক্রমেই কমতে থাকে এবং গতকাল এই সংখ্যা ছিল ১৪ শতাংশ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, ‘আমরা কেবল ‘লকডাউনের’ সুফল পেতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু শপিংমল-দোকানপাট খুলে দিলে পরিস্থিতি বিপরীত হতে পারে।’
তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতি আরও বাড়তে পারে।’
তার মতে, এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়ী, ক্রেতা এবং সরকার তিনটি পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
মার্কেটগুলো ‘কোভিড-১৯ হটস্পটে’ পরিণত হলে অনেক ক্রেতা আক্রান্ত ও মারা যেতে পারেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলে ব্যবসায়ীরা তাদের অর্থ বিনিয়োগ করবেন, কিন্তু আমি শঙ্কিত- করোনা পরিস্থিতির কারণে খুব বেশি মানুষ কেনাকাটা করবেন না। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন এবং এরপর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘যারাই অবৈজ্ঞানিক পথে হেঁটেছেন বা অযৌক্তিক পন্থা অবলম্বন করেছেন তাদেরই চূড়ান্তভাবে ভুগতে হয়েছে।’
এ বিষয়ে কথা বলার সময় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানতে চান, মানুষ যদি দলে দলে কেনাকাটা করতে যায়, তাহলে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে।
এদিকে, শপিংমল পুনরায় খোলার সিদ্ধান্ত বিস্মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যার চলমান নিষেধাজ্ঞায় জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাস্তায় অবস্থান করছে।
রাজধানীর ওয়ারীতে দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ‘দোকানপাট খুলে দিলে মানুষের চলাচল বেড়ে যাবে। তখন আমাদের করণীয় কী হবে? এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে এখনো কোনো নির্দেশনা পাইনি।’
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা পাইনি। নতুন নির্দেশনা পেলে আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’
বর্তমানে কাউকে বাইরে যেতে হলে পুলিশের কাছ থেকে ‘মুভমেন্ট পাস’ নিতে হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিক এবং অন্যান্য জরুরি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মুভমেন্ট পাসের দরকার হচ্ছে না।
নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন ডেইলি স্টারকে জানান, তারা ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের মাস্ক পরতে এবং দোকানে আসা ক্রেতাদের সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় থাকবে এবং মাস্ক ছাড়া কাউকে মার্কেটে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বারবার এই ঘোষণা প্রচার করা হবে এবং ক্রেতাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা মনে করিয়ে দেওয়া হবে।’
আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘তিন হাজারের বেশি ব্যবসায়ী ও কর্মচারী নিউমার্কেটে কাজ করেন। এছাড়া প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার ক্রেতা মার্কেট প্রাঙ্গণে থাকবেন। তাই বিকেল পাঁচটার পর মার্কেট বন্ধের সময় সেখানে ব্যাপক ভিড় জমে যাবে।’
‘যদি মার্কেট খোলা রাখার সময় আরও বাড়ানো হতো তাহলে মানুষ নিরাপদ দূরত্বে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাকাটা করতে পারবে’ বলেও মনে করেন তিনি।
তৈরি পোশাকের অনেক পাইকারি দোকান আছে রাজধানীর উর্দু রোডে। বছরের এই সময়টাতে অসংখ্য মানুষ সেখানে কেনাকাটা করেন।
উর্দু রোড অভ্যন্তরীণ তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এইচ এম মোস্তফা জানান, ইতোমধ্যে তারা ২৭টি মার্কেটের ব্যবসায়ীদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে ও ক্রেতাদের কোনো ভিড় না করতে বলে দিয়েছেন।
যান চলাচল স্বাভাবিক না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাদের পাইকারি ক্রেতাদের আসতে অসুবিধা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারপরও আমরা খুশি যে, সরকার আমাদের মার্কেট খোলার অনুমতি দিয়েছে।’
গত মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলে গত পাঁচ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার চলাচলে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে।
তবে, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ‘কঠোর লকডাউনের’ সুপারিশ উপেক্ষা করে দুদিন পর থেকে বাস চলাচল শুরু হয় এবং চার দিন পরে থেকে মার্কেট খোলার অনুমতি দেওয়া হয়।
ওই সময়ে বিধিনিষেধের শিথিলতার কারণে করোনা সংক্রমণের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলের ৯ তারিখে করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ শনাক্তের হার পৌঁছায় ২৪ শতাংশে।
এরপর সরকার ১৪ এপ্রিল থেকে সারাদেশে ‘কঠোর লকডাউনের’ ঘোষণা দিয়ে চলাচলের জন্য ‘মুভমেন্ট পাস’ চালু করে। যা পরে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এ সময় সরকারি-বেসরকারি অফিস ও গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে জরুরি সেবা, কারখানা এবং কিছু ব্যাংকের শাখা খোলা রাখা হয়।
পরে, গত বৃহস্পতিবার থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং তাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সীমিত আকারে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। এর একদিন পর গতকাল সরকার মার্কেট ও শপিংমল খোলার অনুমতি দিয়েছে।
আরও পড়ুন:
ঈদের আগে লকডাউন শিথিলের চিন্তা করছে সরকার: সেতুমন্ত্রী
লকডাউন বাড়নোর প্রস্তাব, বাস্তবায়নে কঠোরতার ইঙ্গিত
১৪-২১ এপ্রিল: নতুন বিধি-নিষেধে যেভাবে চলার নির্দেশনা
১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের সর্বাত্মক লকডাউনের চিন্তা: সেতুমন্ত্রী
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে নিষেধাজ্ঞা: যা করা যাবে, যা করা যাবে না
৯-১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্যবিধি মানা সাপেক্ষে দোকান-শপিংমল খোলা
৫ এপ্রিল থেকে সারাদেশে এক সপ্তাহের লকডাউন
ঢাকা, চট্টগ্রামসহ ১১ সিটি করপোরেশন এলাকায় কাল থেকে গণপরিবহন চলবে
লকডাউনের ঘোষণায় ঢাকার বাস টার্মিনালগুলোতে ভিড়
গণপরিবহন বন্ধ, বিকল্প পরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া
রাজশাহীর বেশিরভাগ দোকান খোলা
Comments