‘গাড়ির চাকা বন্ধ মানে আমাদের জীবনের চাকাও বন্ধ’
ঢাকা-টাঙ্গাইল রুটের ধলেশ্বরী পরিবহনের চালকের সহকারী পারভেজ মিয়া সকাল থেকে বাস টার্মিনালে এসে বসে আছেন তার বাসের মালিকের সঙ্গে দেখা করতে। তার আশা মালিককে ধরলে হয়তো এই বন্ধের দিনগুলিতে তার পরিবারের মানুষদের দুবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।
পারভেজ বলেন, 'গত বছর লকডাউনেও আমরা বাসের শ্রমিকরা অনেক কষ্ট করছি। সেসময় যা ধার কর্য করছিলাম সেগুলি এখনও শোধ করতে পারি নাই। এখন আবার সেই বিপদ আসছে। শুধু গাড়ি বন্ধ রাখলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে?'
পারভেজ মিয়ার মতো টাঙ্গাইল জেলার প্রায় আট হাজার বাস শ্রমিকের অধিকাংশই অতি দরিদ্র হওয়ার কারণে লকডাউনে কাজ না থাকায় তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
এসময় তাদের পাশে পরিবহন মালিক সমিতি, শ্রমিক সমিতি বা সরকার কেউই কোন ধরনের সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।
বাসের সুপারভাইজার আবু তাহের বলেন, 'আমরা বাস শ্রমিকরা পুরাই দিন মজুর। গাড়ির চাকা ঘুরলে টাকা পাই। গাড়ির চাকা বন্ধ মানে আমাদের জীবনের চাকাও বন্ধ।’
তিনি বলেন, 'আর কোনো উপায় না পেয়ে আজকে গাড়ির ডিপার্টমেন্টে আসছি। খুবই অমানবিক এই ডিপার্টমেন্ট। আমাদের না আছে নিয়োগপত্র, না আছে চাকরির নিশ্চয়তা, না আছে কোনো বেতন, ভাতা। কীভাবে চলবো?'
সদর উপজেলার বাসচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, 'লকডাউন শুরুর আগের দিন যখন গাড়ি থেকে নামি তখন আমার কাছে সব মিলিয়ে তিন হাজার টাকা ছিল। রোজাসহ কয়েকদিনের বাজার সদাই করে তার সবটাই শেষ। অথচ প্রতিদিনই সংসারে কোনো না কোনো প্রয়োজনে টাকা লাগে। ধার কর্জ করে চলার চেষ্টা করছি।'
সাইফুল বলেন, 'অধিকাংশ বাস শ্রমিকের কোনো সঞ্চয় না থাকায় কোনো কারণে গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের পক্ষে চলা কঠিন হয়ে যায়।'
অনেক শ্রমিকের অভিযোগ লকডাউনে শ্রমিকদের এই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াননি তাদের নিয়োগকর্তা বাসের মালিকরা। তবে টার্মিনালে বাসগুলো পাহারা দিয়ে রাখার জন্য মালিক সমিতি দিনে এবং রাতে দশ জন করে বিশ জন শ্রমিককে নিয়োজিত করেছে। একদিন ডিউটি করে পাওয়া যায় ৩০০ টাকা। তবে সেই সুযোগ পেতেও অপেক্ষা করতে হয়।
বাসচালকের সহকারী গোবিন্দ সাহা বলেন, 'লকডাউন শুরুর নয় দিন পর আজ আমি দিনের বেলায় গাড়ি পাহারা দেয়ার সিরিয়াল পেয়েছি। ডিউটি করে ৩০০ টাকা তো পাবো।'
টাঙ্গাইলের কয়েজন গাড়ির মালিক জানালেন, জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে বাসের সংখ্যা প্রায় ৮০০ এর কাছাকাছি। স্থানীয় গাড়ির মালিকদের আয় রোজগার এমনিতেই কম। ক্রমাগত লোকসানের মধ্যে আবার লকডাউন। এদিকে ব্যাংক লোনের কিস্তিসহ আরো কত প্রয়োজন। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকদের জন্য কিছু করা যায় না।
গাড়ির মালিক শফিকুর রহমান শফিক বলেন, ‘মালিকরা সাহায্য করবে কী, তাদেরই উল্টো সাহায্য দরকার। ব্যবসা একদম নেই, এরমধ্যে লকডাউন।’
জানতে চাইলে জেলা বাস-কোচ শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল লতিফ জানান, কল্যাণ তহবিলে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে তারা কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের জন্য কিছু করতে পারছেন না। কল্যাণ তহবিলের টাকা শ্রমিকদের মৃত্যুর পর এককালীন এবং মেয়ের বিয়েতে সাহায্য করতেই শেষ হয়ে যায়।
কয়েকজন বাস শ্রমিক বলেন, আমরা মোটর গাড়ির শ্রমিকরা শুধু নামেই শ্রমিক। একজন শ্রমিক হিসাবে বা শ্রম আইন অনুযায়ী আমাদের যা কিছু প্রাপ্য আমরা কি তা পাই? মালিকরা আমাদের কি দেবে, তারা তো শুধু চায়। একদিন ইনকাম কম দিলেই গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। শ্রমিক নেতারা কি করবে? তারা তো শ্রমিকদের মতো গরীব নয়। আর শ্রমিকের স্বার্থ নেতারা কীভাবে দেখবে, শ্রমিকদের নেতা তো আর শ্রমিকরা হয় না। রাজনীতিতে যখন যারা ক্ষমতায় থাকে তারাই নেতা বনে যায়।
তারা আরো বলেন, আমরা পরিবহন শ্রমিকরা এদেশেরই মানুষ। আমরা সব নিয়ম কানুন মেনে চলতে চাই। এজন্য আমরাও চাই আমাদের শ্রমিক হিসাবে সব ন্যায্য সুযোগ সুবিধা দেয়ার।
Comments