গ্রেডই কি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়?

grades-all-that-matter-1.jpg
ক্লাব কার্যক্রম না থাকায় ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের এসব সুপ্ত প্রতিভার চর্চা করার কোনো সুযোগ পান না এবং তারা শুধু পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। স্টার ফাইল ফটো

আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বেশ কিছুদিন ধরে স্থবিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং এখানে গ্রেডের ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি ছাত্রদের জন্য বড় ধরনের হতাশা ও অসন্তুষ্টির উৎস হিসেবে কাজ করছে এবং তারা মনে করছেন যে, এসব কারণে তারা উন্নত মানের, সামগ্রিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই বিষয়টি একাডেমিক এক্সপিরিয়েন্স প্রজেক্টের একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

সেখানে ৭৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করছেন যে, দেশের উচ্চশিক্ষা ছাত্র-ছাত্রীদের চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে কোনোরকম সহায়তা করে না। একইসঙ্গে, তারা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অনুষদ এবং শিক্ষকদের মান এবং মেধা বিকাশকারী সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলীর অভাব নিয়েও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। 

যেসব আবেদনকারী তাদের গ্রেড, সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম এবং সেবা শিক্ষার অভিজ্ঞতার মাঝে একটি ভালো সমন্বয় ঘটাতে পারেন, তারাই চাকরির বাজারে প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। ক্লাব এবং অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রমের অভাব ছাত্রদের ক্লাসরুমের গণ্ডির বাইরে যেতে দেয় না। অনেক ছাত্র-ছাত্রীই এ ধরনের সহ-পাঠ্যক্রমিক কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারে না এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরোটা সময় তারা ব্যয় করেন পড়াশোনা, দুঃচিন্তা ও অলস আড্ডায়।

বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেবা শিক্ষার সুযোগ একেবারেই অনুপস্থিত। উইকিপিডিয়া থেকে পাওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘আমরা প্রথাগত পড়াশোনার মাধ্যমে যা শিখি, তা একটি সেবাভিত্তিক পদ্ধতিতে ব্যবহারিকভাবে প্রয়োগ করাকেই সেবা শিক্ষা বলা যায়। এ ক্ষেত্রে ছাত্রদের তাদের জ্ঞান ও আবেগভিত্তিক অভিজ্ঞতার উপযুক্ত সমন্বয় ঘটাতে হয় এবং এর ফলে তাদের শিক্ষার গুণগত মান অনেক বেড়ে যায়। এখানে ব্যক্তিগত পছন্দের সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার সন্নিবেশ ছাত্র-ছাত্রীদের বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য আরও ভালো প্রস্তুতি দেয়। ছাত্ররা তাত্ত্বিক জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে শেখে এবং এর মাধ্যমে সমাজে দীর্ঘমেয়াদী ও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়।’

অনেক ছাত্র-ছাত্রী যথোপযুক্ত ইন্টার্নশিপের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে ছাত্র অবস্থায় কর্মজীবন সম্পর্কে কোনো ধারণাই পায় না। পমেরান্টজ’র সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘ইন্টার্নশিপ হচ্ছে একটি গঠনমূলক অভিজ্ঞতা, যা একজন ছাত্রের মূল পাঠ্য বিষয় কিংবা তার ক্যারিয়ারের লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং এটি তার শিক্ষা, ক্যারিয়ার ও ব্যক্তিগত উন্নয়ন ঘটায়। এটি অবশ্যই একজন পেশাদার কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে হতে হবে। এটি বৈতনিক কিংবা অবৈতনিক হতে পারে, খণ্ডকালীন অথবা পূর্ণকালীন হতে পারে এবং এর ব্যাপ্তি ও সময়কাল নিয়ে ছাত্র, তার ব্যবস্থাপক অথবা শিক্ষককে একমত থাকতে হবে। একে প্র্যাক্টিনাম বা কো-অপ নামেও অভিহিত করা যায়।’  

একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রকল্প থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ক্লাব কার্যক্রমের জন্য চাহিদা রয়েছে এবং একইসঙ্গে তারা ব্যবহারিক সুযোগের মাধ্যমে তাদের সুপ্ত ও লুকিয়ে থাকা প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে চায়। সব ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনায় ভালো নাও হতে পারেন, অনেকে অন্যান্য বিষয়ে, যেমন: বিতর্ক, অভিনয়, সৃজনশীল লেখনী, ক্রীড়া ইত্যাদিতে নৈপুণ্য দেখাতে পারেন। ক্লাব কার্যক্রম না থাকায় ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের এসব সুপ্ত প্রতিভার চর্চা করার কোনো সুযোগ পান না এবং তারা শুধু পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। দুঃখজনকভাবে তাদের মস্তিষ্কের সৃজনশীল অংশটি অনেকাংশেই অব্যক্ত ও অব্যবহৃত থেকে যায়, যা তাদের নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রেক্ষাপটে একটি অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ব্যবহারিক সুযোগ তাদেরকে কর্মী অথবা উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারতো।

অনেক ছাত্র-ছাত্রী মনে করেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারিয়ার সংক্রান্ত উপদেশের ব্যাপারটি একেবারেই অনুপস্থিত, অথবা থাকলেও এ সুবিধাটির আশানুরূপ উন্নয়ন ঘটেনি। প্রকৃতপক্ষে, দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারিয়ার উপদেশ বা তার কাছাকাছি কোনো সুবিধাও থাকে না। অনেক ছাত্র-ছাত্রী জানে না পাশ করে বের হবার পর তারা কী করবেন। এটি অনেক সুপ্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অনেকে তাদের নির্বাচন করা মূল বিষয়ও পছন্দ করেন না, আবার সেটি বদলানোর কোনো গরজও তাদের মাঝে দেখা যায় না। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে প্রশ্ন করা হলে তিনি তার হতাশা ব্যক্ত করেন, ‘আমি এমবিএ করছি, কিন্তু জানি না এটি কতটা সম্ভাবনাময়, অথবা এ বিষয়ে পড়ে আমি কতটুকু উপকৃত হব। আমি যদি অভিজ্ঞ কারও কাছ থেকে উপদেশ পেতাম, তাহলে আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে আরও জেনেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম’। ক্যারিয়ার উপদেশের এই দুর্বল অবস্থার কারণে এমনকি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভালো ফলাফল করা ছাত্ররাও চাকরির বাজারের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তিকে মেলাতে পারেন না। পেশাদার ক্ষেত্রগুলোতে চাকরির সঙ্গে সম্পর্কিত দক্ষতার চাহিদা এবং আবেদনকারীদের মাঝে সেসব দক্ষতার অভাবের এই বড় ব্যবধানের পেছনে এটি একটি বড় কারণ।

ছাত্র-ছাত্রীদের একটি বড় অংশ মনে করেন যে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারটিকেও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ। আগের একটি সম্পাদকীয়তে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে বুয়েটের সাবেক ছাত্র আলভী হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘জাতি হিসেবে আমরা শিক্ষাগত সাফল্যকে যতটা গুরুত্ব দেই, মানসিক স্বাস্থ্যকে ততটা গুরুত্ব দেই না’। প্রতিবছর, ছাত্র-ছাত্রীরা পারিবারিক চাপ, পড়ালেখার দুশ্চিন্তা, অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীর কাছ থেকে আসা চাপ অথবা ব্যক্তিগত সম্পর্কজনিত ঝামেলা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার করছেন, নিজেদের ক্ষতি করছেন অথবা ভুগছেন বিষণ্ণতায়। জরুরিভাবে এমন একজন মানুষ দরকার, যার সঙ্গে তারা অকপটে নিজেদের কঠিন সময়গুলোর ব্যাপারে আলাপ করে পরামর্শ নিতে পারবেন। 

সার্বিকভাবে সবাই একমত হন যে, ক্যাম্পাসগুলোতে মূলত লেকচার ভিত্তিক ক্লাস নেওয়া হয় এবং পরীক্ষাগুলোতে প্রকৃত, আহরিত জ্ঞান যাচাই করার পরিবর্তে স্মরণশক্তির পরীক্ষা নেওয়া হয়। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যাম্পাসভিত্তিক ও সেবা শিক্ষামূলক বাড়তি কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়, কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যাপারগুলোকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করা হয়। ছাত্ররা অপরিণামদর্শিতার নিদর্শন রেখে ধরে নেয় যে, চাকরিক্ষেত্রে এবং সার্বিকভাবে জীবনে উন্নতি করার জন্য ভালো সিজিপিএ পাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। চার থেকে পাঁচ বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর তারা অনুধাবন করে যে, কত খারাপভাবে তাদেরকে পরিচালিত করা হয়েছে এবং কত দুর্বলভাবে তারা নিজেদেরকে গড়ে তুলেছেন।

তরুণদের শিক্ষা ব্যবস্থার এসব গুরুতর সমস্যাগুলোর দিকে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিৎ। যেসব প্রশ্ন তোলা উচিৎ, তা হল- আমাদের কি সেরকম পেশাদারী জনবল রয়েছে, যারা কার্যকরভাবে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে উপযুক্ত ইন্টার্নশিপ, সেবা শিক্ষার সুযোগ, ক্লাব কার্যক্রম, ক্যারিয়ার উপদেশ ও মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উপদেশ দেওয়ার জন্য যথোপযুক্ত অবকাঠামো তৈরি করতে পারবেন? যদি এরকম পেশাদারী মানুষ না থাকে, তাহলে কি তাদেরকে দ্রুততম সময়ে প্রস্তুত করা সম্ভব? 

আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কখনোই ছাত্র-ছাত্রীদের সার্বিক উন্নয়নের দিকে নজর দেয়নি। একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা বাড়ছে, আরেকদিকে বাড়ছে নানাবিধ উপায়ে তাদের বিভিন্ন দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগ দূর করায় অনুপ্রাণিত করতে এসব নতুন অনুষদের ভূমিকা। একইসঙ্গে এটি আমাদের নতুন নতুন বিষয়ে মানুষকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে ছাত্রদের বৃহত্তর প্রয়োজন মেটানোর ব্যাপারে নির্দেশনা দিচ্ছে। এ ছাড়াও, শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্যেও বেশ কিছু আকর্ষণীয় খাত রয়েছে, যার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব। 

বর্তমান যুগের দাবি হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করা। যদি প্রশাসন তার কল্পনাশক্তিকে বিকশিত করে এবং আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিবর্তনগুলোর প্রচলন করে, তাহলে শিক্ষার সার্বিক মানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উন্নতি আসবে এবং আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পথ আরও সুগম হবে। আমরা আরও বিশ্বাস করি যে, নিয়োগদাতারাও এই নতুনভাবে শিক্ষিত, চৌকস স্নাতকদের নিয়ে অধিকতর উচ্ছ্বাস ও বিস্ময় প্রকাশ করবেন এবং খুশী মনে তাদেরকে চাকরিতে নিয়োগ দেবেন।

সাজ্জাদ শাহরিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করছেন। ড. আন্দালিব পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। ড. আন্দালিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অনুষদের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এই নিবন্ধটি তৈরি করেন এবং অপ-এডের জন্য উপস্থাপন করেন। অপ-এডগুলো লেখা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ওপর আলোকপাতের মাধ্যমে এবং একে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে। ‘একাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রকল্প’তে অবদান রাখতে ইচ্ছুক যেকোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ড. আন্দালিবের সঙ্গে [email protected] মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda urges unity, quick action to institutionalise democracy

She also demanded a comprehensive list of victims of abduction, murder, and extrajudicial killings

Now