শিশুর এমআইএস-সি ও কোভিড-১৯: করণীয় কী?
বাংলাদেশে সদ্যজাত শিশু থেকে ২১ বছর বয়সীদের জন্য একটি নতুন স্বাস্থ্য সংকট হয়ে দেখা দিচ্ছে মাল্টিসিস্টেম ইনফ্ল্যামেটরি সিনড্রোম (এমআইএস-সি)।
২০২০ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে যুক্তরাজ্যে প্রথম শনাক্ত হয় এমআইএস-সি। একে পেডিয়াট্রিক মাল্টিসিস্টেম ইনফ্ল্যামেটরি সিনড্রোমের আকারে গুরুতর কোভিড-১৯ কার্ডিওভাসকুলার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল, যার কাওয়াসাকি রোগের (কেডি) বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কোভিড-১৯ এর কারণে সৃষ্ট এমআইএস-সি হলে রোগীর পরিস্থিতি কেডি’তে আক্রান্ত রোগীর চেয়ে অবনতি হয়।
এমআইএস-সি’র কারণে সৃষ্ট গুরুতর পরিস্থিতিতে হৃদ ক্রিয়ার আকস্মিক অবনতি হতে পারে, অনিয়মিত ভাস্কুলার ওয়ালের সঙ্গে করোনারি ধমনীর ডাইলেশন হতে পারে, ভালভ ফুটো হতে পারে, হাইপোটেনশন হতে পারে, কার্ডিওজেনিক শকসহ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হতে পারে। ফলে, শিশুদের মধ্যে হৃদকম্পন বেড়ে যাওয়া, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে থাকা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, অস্বস্তিতে ভোগা এবং শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ার মত উপসর্গ দেখা দেয়।
এসব বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা ছাড়াও রক্ত পরীক্ষা ও বুকের এক্স-রে করার মাধ্যমে এমআইএস-সি শণাক্ত করা যেতে পারে। কোনো শিশু এমআইএস-সি বা কেডিতে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হলে ইকোকার্ডিওগ্রাফির মাধ্যমে তাকে আরও নিবিড়ভাবে মূল্যায়ন ও চিকিৎসা দেওয়ার জন্য একজন পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্টের কাছে রেফার করা যেতে পারে। এই রোগের ক্ষেত্রে উদ্বেগের বিষয় হলো- হৃদ ক্রিয়ার অবনতি ও রক্ত প্রবাহের ঘনত্ব বৃদ্ধি। রক্ত প্রবাহের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেলে রক্তনালী, বিশেষ করে হৃদযন্ত্রের নালীগুলো ব্লক হয়ে যেতে পারে।
সেক্ষেত্রে শিশুকে বিভিন্ন সমস্যার চিকিৎসার জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করাতে হতে পারে। তাদের গ্যাস্ট্রোইন্টেসটিনালে ত্রুটি, ফুসফুস ও কিডনি ফেইলর হতে পারে। শ্বেত রক্ত কণিকা কমে যাওয়া এবং শুরুতে কমতে থাকার পর হঠাৎ করে প্ল্যাটেলেট বেড়ে যাওয়ার মতো উপসর্গগুলো এই রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সময় মতো এমআইএস-সি শনাক্ত করা। অসুস্থ হয়ে পরার সাত থেকে আট দিনের মধ্যে এই রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করা গেলে রোগীর অবস্থার অবনতি ঠেকানো সম্ভব। যখন শরীরে করোনাভাইরাস প্রবেশ করে, তখন তা খুব দ্রুত প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। এটা দ্রুত বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
রোগাক্রান্ত হলে বা হওয়ার পর, এমনকি চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও হৃদযন্ত্রের নালীতে পরিবর্তন হতে পারে। এ কারণে এই রোগের চিকিৎসার জন্য নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
উপসর্গগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকাকালীন রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা শুরু করা গেলে এমআইএস-সি রোগীকে করোনারি আর্টারি অ্যানিউরিজমের মতো দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি থেকে বাঁচনো সম্ভব। এর জন্য জনসাধারণের মাঝে এই রোগে, রোগের উপসর্গসহ সচেতনতা বাড়াতে হবে।
এমআইএস-সি আক্রান্ত রোগীকে দীর্ঘমেয়াদী পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। শিশুদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়া রোধ করতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পড়া ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের মতো স্বাস্থ্যবিধিগুলো কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পর শিশুর অস্বস্তি, পেশীতে ব্যথা, বারবার জ্বর হওয়া, গলা ভেঙে যাওয়া বা আবারও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভব না থাকে। এক্ষেত্রে শিশুটির জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের পাশাপাশি ভিটামিন ও জিংক দিতে হবে এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দিতে হবে। পুরোপুরি এই রোগ মুক্তির জন্য তাদের সার্বিক মানসিক সুস্থতাও অত্যন্ত জরুরি। তাদের সঙ্গে ঘরে বসে খেলাধুলা করা, পরিবারের সবার পক্ষ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা করা এবং তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার মাধ্যমে সেটা সম্ভব।
এটা উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে কোভিড-১৯ শুধু বড়দের নয়, আমাদের শিশুদেরও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। শিশুদের এমআইএস-সি এবং কোভিড-১৯ প্রতিরোধযোগ্য ও চিকিত্সাযোগ্য রোগ। সবাইকে এটা মনে রাখতে হবে যে, রোগ পরবর্তী জটিলতা এড়াতে নিয়মিতভাবে চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডা. তাহেরা নাজরীন, কনসালটেন্ট পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা, বাংলাদেশ
Comments