যে কারণে ভারতে অক্সিজেন সংকট

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে টালমাটাল গোটা বিশ্ব। মহামারি মোকাবিলায় ইউরোপ, আমেরিকার বহু দেশই লকডাউন ঘোষণা করেছে। জাপান, যেখানে আজ বাদে কাল অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হবে সেখানেও প্রশাসন লকডাউন করেছে। দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়াও লকডাউন দিয়েছে।
রয়টার্স ফাইল ফটো

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে টালমাটাল গোটা বিশ্ব। মহামারি মোকাবিলায় ইউরোপ, আমেরিকার বহু দেশই লকডাউন ঘোষণা করেছে। জাপান, যেখানে আজ বাদে কাল অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হবে সেখানেও প্রশাসন লকডাউন করেছে। দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়াও লকডাউন দিয়েছে।

ভারত যে এখনো এই পথে হাঁটছে না তার কারণ হিসেবে উঠে আসছে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর বিদেশি বহুজাতিক এবং দেশের বাণিজ্য লবির প্রবল চাপ। এই কোভিড পরিস্থিতির ভয়াবহতার মধ্যেই ভারতে তীব্র হয়ে উঠেছে অক্সিজেন সংকট। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির আধুনিকতম বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে ২৫ জন করোনা রোগী মারা গেছেন।

গোটা ভারত জুড়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এই যে অক্সিজেনের তীব্র সংকট, তার প্রধান কারণ স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চরম অবৈজ্ঞানিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা। গত বছর করোনা মোকাবিলায় যখন বিশ্বের ধনী, গরীব- সব দেশই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন প্রদীপ জ্বালানো, থালা বাটি বাজানোর মতো চরম অবৈজ্ঞানিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিষয়গুলো মানুষের ওপর চাপিয়েছিলেন। ফলে কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ভেতরে সেদিন থেকে যে অসচেতনতা তৈরি হয়েছে, সেটিই আজও ভারতকে চরম সংকটের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।

পাকিস্তান, বাংলাদেশেও যখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ছে তখন কেবলমাত্র বাণিজ্য লবির চাপে বিদেশি ফ্লাইটগুলো পর্যন্ত বন্ধ করার পথে হাঁটেনি ভারত। কুম্ভ মেলার মতো জমায়েতের ভেতর দিয়ে কীভাবে করোনা ছড়িয়েছে- তা বিশ্বের অজানা নয়। অথচ ২০২০ এ কোভিড পরিস্থিতি ভারতে ভয়াবহ হওয়ার বেশ আগে দিল্লির নিজামুদ্দিনের তবলিগ জামাতের মারকাজকে ঘিরে চরম সাম্প্রদায়িক প্রচার চালিয়েছে ভারতের শাসক দল বিজেপি আর তাদের মূল মস্তিষ্ক আর এস এস।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে একফোঁটা সতর্কতা না দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় নিজের দলকে জয়ী করা। এজন্যে তিনি দিল্লি থেকে পশ্চিমবঙ্গে আনাচে কানাচে প্রায় নিত্য যাত্রীতে পরিণত হয়েছেন। অথচ জরুরিভিত্তিতে অক্সিজেন উৎপাদনে একটি উদ্যোগ কেন্দ্রীয় সরকার নেয়নি। আপদকালীন অবস্থায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন পিউরিফায়েড করে মানবশরীরের উপযোগী অক্সিজেনে রূপান্তরিত করবার ক্ষেত্রে কোনো নজর দেওয়া হচ্ছে না।

কোভিডের এই ভয়াবহতায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন পিউরিফিকেশন না করেই মানুষকে বাঁচানোর স্বার্থে ব্যবহারের উদ্দেশে গোটা দেশে সরবরাহের জন্যে যে উন্নত পরিকাঠামো দরকার, সেই পরিকাঠামো তৈরির দিকে আজ পর্যন্ত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো মাথা ব্যথা নেই। অক্সিজেন পরিবহনের জন্য যে যথেষ্ট পরিমাণ ট্রাকের প্রয়োজন, পরিবহন ব্যবসায়ীরা সেই পরিমাণ ট্রাক ব্যবহার করতে দিচ্ছে না।

অক্সিজেন ব্যবসায়ী আর ট্রাক মালিকদের একটা অংশের অশুভ আঁতাতের ভয়ঙ্কর অভিযোগ উঠেছে। পরিবহন ব্যবস্থার ইচ্ছাকৃত সমস্যা তৈরি করে অক্সিজেনের মূল সংকটের থেকে অনেক বেশি কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে ভারতে। এই কৃত্রিম সংকট মোকাবিলা করতে আজ পর্যন্ত ভারত সরকার একটিও উদ্যোগ নেয়নি। অক্সিজেন সংকট নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার স্বভাবসুলভ প্রগলভ পথে হাঁটছেন। তিনি একদম নিশ্চুপ। আর তার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন মানুষকে পরামর্শ দিচ্ছেন কম অক্সিজেন নেওয়ার জন্যে।

গত বছর ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির পরেও চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ভারত সরকার স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতির জন্যে একটি টাকাও নতুন করে বরাদ্দ করেনি। যেটুকু বেশি টাকা ভারত সরকার চলতি আর্থিক বছরে স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দ করেছে, সেটি কোভিডের ভ্যাকসিন কেনার জন্যে।

নতুন অক্সিজেন সিলিন্ডার গত বছরের অভিজ্ঞতার নিরিখে তৈরির ক্ষেত্রে নতুন কোনো টাকা বরাদ্দ না হওয়ায় কেবলমাত্র পর্যাপ্ত সিলিন্ডারের অভাবে বহু অক্সিজেন প্ল্যান্টেই অক্সিজেন বটলিং পর্যন্ত করতে পারছে না। ভারতে এই ভয়াবহ অক্সিজেন সংকটে সিলিন্ডারের অভাব, এই সংকটকে তীব্র হতে দেওয়ার একটি অন্যতম বড় কারণ। ভারত সরকার যদি অক্সিজেন পরিবহন ঘিরে ট্রাক মালিকদের একাংশের যে চরম অসহযোগিতা সেটিকে শক্ত হাতে মোকাবিলা না করে এবং তার পাশাপাশি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে অক্সিজেন সিলিন্ডারের উৎপাদন না বাড়ায়, তাহলে অক্সিজেনের উৎপাদন বৃদ্ধি বা অক্সিজেন বিদেশ থেকে আমদানি করা- এইসব টোটকা দিয়ে এই মুহূর্তে ভারতে যে ভয়াবহ অক্সিজেন সংকট, সেই সংকটের মোকাবিলায় কোনো কিছুই করা সম্ভব হবে না।

গত বছরেও উন্নত দেশগুলিতে যখন করোনা মহামারিতে পরিণত হচ্ছে, ভারত সরকার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা সচেষ্ট ছিল মধ্যপ্রদেশে বিরোধী কংগ্রেসের নির্বাচিত সরকারকে ভেঙে নিজেদের সরকার তৈরি করতে। মধ্যপ্রদেশে বিজেপির সরকার গঠনের পর অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে লকডাউন ডেকে পরিযায়ী শ্রমিকসহ গরীব মানুষকে দুর্দশার শেষ সীমায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

গত বছর যে কাজ ভারত সরকার করেছিল, এক বছর পরেও সেই পথেই তারা হেঁটেছে। ইউরোপে, আমেরিকায় যখন আরও ভয়ঙ্করভাবে এই করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ছে, সেইসব উন্নত দেশগুলিতেও মাঝে মধ্যে অক্সিজেনের সংকট সাময়িকভাবে তৈরি হচ্ছে বলে খবর আসছে, তখন দ্বিতীয় ঢেউ ভারতে এলে এই অক্সিজেন সংকট যাতে পরিবহনের ট্রাক আর অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাব থেকে ভয়াবহ আকার ধারণ না করে, সে জন্যে বিন্দুমাত্র পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ভারত সরকারের এই গা ঢিলেমিই আজ একাংশের অসাধু ব্যবসায়ীদের অক্সিজেন সংকটকে ঘিরে ব্যাপক কালোবাজারির সুযোগ করে দিয়েছে।

কোভিড পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের ঘোষণা ছিল দেশের ১৬২টি হাসপাতালে নিজস্ব অক্সিজেন উৎপাদনের ব্যবস্থা এবং পরিকাঠামো তৈরি করা হবে। এই ১৬২টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ৩২টি হাসপাতালে কোথাও আংশিক, কোথাও অর্ধেক অক্সিজেন উৎপাদন ব্যবস্থা হয়েছে। সেই ৩২টি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের ভিতরেও তাদের প্রতিষ্ঠানে অক্সিজেন উৎপাদনের যেটুকু ব্যবস্থা হয়েছে, তার ভিতরেও পরিকাঠামোজনিত ত্রুটি ঘিরে ব্যাপক ক্ষোভ আছে।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যখন গোটা বিশ্বে আছড়ে পড়ছে তখন ভারতে তার মোকাবিলায় বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতি সপ্তাহে গড়ে দুই বার করে পশ্চিমবঙ্গে আসছেন নিজের দলকে ভোটে জেতাতে। আর এই সময়কালেই ২০২০-২১ সালে আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতির কথা জানার পরেও ভারত সরকার ধনী দেশগুলিতে ৯৩০০টন অক্সিজেন রপ্তানি করেছে। বাংলাদেশ, মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশীদের প্রতি কিন্তু এই সদয় মানসিকতা দেখায়নি ভারত সরকার। দেখিয়েছে ইউরোপ, আমেরিকার ধনী দেশগুলোর প্রতি। গত ২০১৯-২০ সালে ভারত সরকার যে পরিমাণ অক্সিজেন বিদেশে রপ্তানি করেছিল, করোনার চলতি বছরের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে তার দ্বিগুণ পরিমাণ অক্সিজেন বিদেশে রপ্তানি করেছে ভারত সরকার। এ থেকেই সহজে বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, ভারতে এই ভয়াবহ অক্সিজেন সংকটের রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংকটের স্বরূপটি কোন পর্যায়ের। অক্সিজেন উৎপাদন এবং সঠিক সরবরাহ ব্যবস্থাতে ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার- উভয়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের ভেতরে যে অক্সিজেন নিয়ে কালোবাজারিকে মদদ দেওয়ার প্রবণতাই প্রবল তা পরিষ্কার হচ্ছে কেরলে বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত সরকারের ভূমিকার নিরিখে। কেরল সরকার তাদের নিজেদের রাজ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউজনিত অক্সিজেনের চাহিদা মিটিয়ে পাশের রাজ্য গোয়া, তামিলনাড়ু, কর্ণাটকে অক্সিজেন সরবরাহ করছে। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কোভিডকে মোকাবিলা করায় কেরলে করোনা রোগীদের অক্সিজেনের চাহিদা অনেকটাই কমে এসেছে। তাই কেরলের পক্ষে পাশের রাজ্যগুলিকে অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।

গৌতম রায়: ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda returns home after 6 days in hospital

Thousands of party activists, along with senior BNP leaders, are escorting Khaleda's convoy back to her Gulshan residence

23m ago