মুক্তিযুদ্ধ

২৬ এপ্রিল ১৯৭১: কড়ই কাদিরপুর ও পটুয়াখালীতে নির্মম গণহত্যা

কড়ই কাদিরপুর বধ্যভুমি। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৬ এপ্রিল গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন সংগঠিত হয়েছিল একাধিক গণহত্যা, টাইমস সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ নিয়ে একটি নিবন্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের নানা স্থানে পাকিস্তানি হানাদারদের ঠেকাতে গড়ে তুলেছিলেন প্রতিরক্ষা ব্যূহ। বাদ যায়নি হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ যুদ্ধ।

ঢাকায় ২৬ এপ্রিল

এদিন সাবেক প্রাদেশিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ও মুসলিম লীগের সহসভাপতি মফিজুদ্দিন আহমদ, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মওলানা আবদুল মান্নান ঢাকায় এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মাদ্রাসা শিক্ষক, ছাত্র ও আলেমরা ভূমিকা পালন করবে। পাকিস্তানকে রক্ষা করতে এবং দুষ্কৃতকারী ভারতের চর দেশদ্রোহী মুক্তিবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক নাগরিকেরা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সবসময় এক আছে। এব্যাপারে দেশপ্রেমিক ভাইবোনদের সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।’ 

এদিকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর প্রশাসন বেলা ১২টার দিকে ঢাকার উপ দূতাবাস জোরপূর্বক বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন মনে করে এটি ছিল ভারতে পাকিস্তানি দূতাবাস বন্ধের পরে দূতাবাস কেন্দ্রিক বড় পদক্ষেপ। এর আগে দূতাবাস বন্ধে নোটিশ জারি করে পাকিস্তানি প্রশাসন।

২৬ এপ্রিল রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদ খান দেশের সার্বিক  পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে এবং পরবর্তী ব্যবস্থা কী হবে তা নির্ধারণের জন্যে ঢাকা আসেন। এসময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক প্রশাসক টিক্কা খানসহ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা  হামিদ খানকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান।

২৬ এপ্রিল পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ একটি নোটিশ জারি করে, কেউ যদি রাস্তা ঘাট, অফিস আদালত, সরকারি সম্পত্তির উপর আঘাত হানে তবে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখিও হতে হবে। একই সঙ্গে এও বলা হয় যেখানেই সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করা হবে তার আশপাশের বসবাসকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিন ঢাকায় কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে শান্তি কমিটির জেলা আহ্বায়কদের নাম ঘোষণা করা হয়। বরিশাল জেলায় আহ্বায়ক করা হয় মওলানা বশির উল্লাহ আতাহরী ও প্রাক্তন এমএলএ অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সিকদার, দিনাজপুর জেলায় মৌলভী মতিউর রহমান চৌধুরী ও আহমদ জান মোক্তারকে, ঈশ্বরদীতে মমতাজুর রহমান, পটুয়াখালী জেলায় প্রাক্তন এমএলএ কসিমউদ্দিন সিকদার এবং বগুড়া, খুলনা, মাদারীপুর ও পটুয়াখালী জেলায় স্বীয় জেলার জামে মসজিদের ইমামদেরকে।

বিশ্ব গণমাধ্যমে ২৬ এপ্রিল

২৬ এপ্রিল টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘গৃহযুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা তৎপরতার অধ্যায় এর মধ্যে  শুরু হয়ে গেছে, অধিকাংশ শহর সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আর মুক্তিবাহিনীর দখলে রয়েছে গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকা। পূর্ব পাকিস্থানকে কব্জা করে রাখার সংকল্পে পাকিস্তান যতই অটল থাকুক না কেন, পরিস্থিতি দৃষ্টে এখনই ভবিষৎবাণী করা যায় যে  শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’

ঢাকার বাইরে গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ

২৬ এপ্রিল ঝাউগড়া গণহত্যা দিবস। ২৬ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ব্রহ্মপুত্র নদ পারি দিয়ে হানাদার বাহিনী শেরপুরে প্রবেশ করে মোস্তফা, বুলবুল, রুটির দোকানী আহমদ আলী ও শনি বিগ্রহের পুরোহিত সুব্রত ভট্টাচার্যকে হত্যা করে। সেদিনই স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় “ঝাউগড়া” গ্রামে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি হানাদারেরা। শহর থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য ব্যবসায়ী চৌথমল কারুয়া, নিপু সাহাসহ বেশ কয়জন ঝাউগড়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। হানাদার বাহিনী মহেন্দ্র দেবসহ ৮ জনকে বেঁধে মৃগী নদীর ধারে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশগুলো নদীতে ফেলে চলে যায়।

২৬ এপ্রিল কড়ই কাদিরপুর গণহত্যা দিবস

এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জয়পুরহাটের কড়ই কাদিরপুরসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্মম গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন কড়ই, কাদিরপুর ও আশেপাশের গ্রামের প্রায় ৩৭১ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

গণহত্যার আগে ২৪ এপ্রিল রাতে সান্তাহার থেকে ট্রেনে পাকিস্তান হানাদারেরা জয়পুরহাটে আসে  এবং জয়পুরহাট মহকুমা সদর দখল করে। ২৫ এপ্রিল সকাল থেকে সৈন্যরা মানুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যাকাণ্ড শুরু করে। একইসঙ্গে লুটপাট ও গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। তখন  জয়পুরহাটের মানুষেরা গ্রামের দিকে পালাতে শুরু করেন। ২৬ এপ্রিল স্থানীয় রাজাকারদের  সহায়তায় হানাদারেরা হিন্দু-অধ্যুষিত কড়ই ও কাদিরপুর গ্রামকে লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে। প্রথমে  তারা গ্রামগুলোকে ঘিরে ফেলে এবং পুরুষদের জিম্মি করে নিয়ে যায়। তারপর তাদের সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে।

পটুয়াখালীতে গণহত্যা

২৬ এপ্রিল সকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিত বিমান হামলা চালায় পটুয়াখালীতে। দুটি জঙ্গি বিমান, দুটি হেলিকপ্টার থেকে নামানো হয় ছত্রীসেনা। অতর্কিত হামলায় দিশেহারা হয়ে পড়ে শহরবাসী। প্রথম আক্রমণের শিকার হয় মাদবর বাড়ির নিরীহ মানুষ। সেখানে ক্রমাগত গুলি চালিয়ে হত্যা করে নারী ও শিশুসহ ১৯ জনকে। এরপর বিটাইপ এলাকায় ছয় জন আনসার ও একজন তথ্য কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। এই গণহত্যায় হাজারের বেশি মানুষ শহীদ হন। পরবর্তীতে শহরের পুরানবাজার এলাকায় লুটপাট করে অগ্নি সংযোগ করা হলে আতঙ্কিতরা লোহালিয়া নদী সাঁতরে প্রাণে বাঁচে। এদিন পটুয়াখালী শহর পরিণত হয় ধ্বংসস্তুপে। টানা তিন দিন তিন রাত ধরে শহরে আগুন জ্বলে।

প্রতিরোধ যুদ্ধ

২৬ এপ্রিল মহালছড়ির মুক্তিযোদ্ধা হেডকোয়ার্টার আক্রমণ প্রতিহত করতে মেজর মীর শওকত আলী ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ও তার দলকে নানিয়ারচর বাজারে বড় পাহাড়ের ওপর অবস্থানের নির্দেশ দেন। ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বে আরেকটি দলকে সড়কপথে হানাদারদের গতিরোধ করতে পাঠান। লেফটেন্যান্ট মাহফুজের নেতৃত্বে অপর একটি দলকে রিজার্ভর রাখেন যাতে পাল্টা আক্রমণ করা যায়।

২৬ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারেরা গুলি করতে করতে শেরপুর শহরে প্রবেশ করে। অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যার মাধ্যমে শেরপুর দখলে নিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে নয়ানী জমিদার বাড়িতে।

২৬ এপ্রিল হানাদার বাহিনী বরিশাল দখল করে। বরিশাল দখল করার পর শুরু করে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগ। ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী অবিরাম বোমা ও গুলিবর্ষণের মুখে এসব এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে গ্রাম অঞ্চলে সরে যায়।

২৬ এপ্রিল প্রাথমিক অবস্থায় হানাদার বাহিনী সিরাজগঞ্জ শহরে ঢুকতে ব্যর্থ হলে ভোর রাতে বিমান বাহিনীর সহায়তায় প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করে এবং সিরাজগঞ্জ শহরে ঢোকে। এরপর হানাদার  বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার মেজর মোহাম্মদ আরিফ সিরাজগঞ্জ শহর ও গ্রামের ১০ মাইল পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। ওই দিন ভোররাত থেকে সিরাজগঞ্জ শহর ও আশপাশের গ্রামগুলো হানাদারেরা গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।

২৬ এপ্রিল কুড়িগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি টহল দলের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর বেশকিছু ক্ষতিসাধন করে নিরাপদ ঘাঁটিতে ফিরে যায়।

এদিন সিলেটের কালাগুল চা বাগানে হামলা চালিয়ে ৫০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।

তথ্যসূত্র –

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র- ষষ্ঠ, অষ্টম ও নবম খণ্ড।

অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৭ এপ্রিল ১৯৭১

দৈনিক পাকিস্তান, ২৭ এপ্রিল ১৯৭১

সিলেটে গণহত্যা/ তাজুল মোহাম্মদ

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

আরও পড়ুন:

২২ এপ্রিল ১৯৭১: পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারে না: ভাসানী

২১ এপ্রিল ১৯৭১: ফরিদপুরের শ্রীঅঙ্গন গণহত্যা, বিশ্ব নেতাদের ভাসানীর চিঠি

২০ এপ্রিল ১৯৭১: দিল্লিতে ৩০ পাকিস্তানি কূটনীতিক বহিষ্কার, ঢাকায় শান্তি কমিটির মিছিল

১৯ এপ্রিল ১৯৭১: প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ১৮ নির্দেশনা

১৮ এপ্রিল ১৯৭১: বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন

স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সূচনা, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ

১৬ এপ্রিল ১৯৭১: প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার শপথের অপেক্ষা, ঢাকায় কারফিউ শিথিল

১৫ এপ্রিল ১৯৭১: নিভৃতে কেটেছে বাংলা নববর্ষ, ভয়ে-আতঙ্কে ঢাকা ছাড়ে মানুষ

১৩ এপ্রিল ১৯৭১: চারঘাট গণহত্যা ও ঘটনাবহুল একটি দিন

১২ এপ্রিল ১৯৭১: বালারখাইল গণহত্যা ও ঘটনাবহুল একটি দিন

১১ এপ্রিল, ১৯৭১: দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান তাজউদ্দীন আহমদের

১০ এপ্রিল: মুজিবনগর সরকার গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিবস

 

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago