ফাহিম সালেহ’র জীবন ও স্বপ্ন
ফাহিম পরলোকে চলে যাওয়ার পর দুঃখ ও বেদনায় আমি প্রায় প্রাণহীন হয়ে পড়ি। ঘুমের ওষুধ খেয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব ঘুমিয়ে থাকতাম। ভাবতাম— ফাহিমকে ছাড়া কীভাবে জীবন চলবে? সবার জীবনেই তো একটা উদ্দেশ্য রয়েছে। অনেকে তাদের সন্তানদের ভালোভাবে বড় করার চেষ্টা করেন, অনেকে তাদের পেশাজীবনে আরও উন্নতি করতে চান। অনেকে আবার টাকা-পয়সা উপার্জনের মাঝে জীবনের উদ্দেশ্য এবং শান্তি খুঁজে পান। আমি সেরকম কোনো কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না।
একদিন ঘুম থেকে উঠে আমার ই-মেইল এবং চিঠিগুলো খুলে পড়তে বসলাম। অনেকেই লিখেছেন, বিশেষ করে তরুণরা। তাদের কেউ ফাহিমের বন্ধু, আবার অনেকে তাকে একেবারেই চেনেন না। তবে সবাই ফাহিম সম্পর্কে আরও বেশি জানতে চান। সেসব চিঠি ও ই-মেইলে তারা ফাহিম সম্পর্কে কত কিছুই না জানতে চেয়েছেন! তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম— ফাহিম এবং তাকে নিয়ে আমার স্মৃতি সবাইকে জানাব। এ বিষয়ে ফাহিমের মায়ের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, শুধু শোক করার চেয়ে আমরা ফাহিমের জীবন সম্পর্কে মানুষকে জানাব। বিশ্বকে জানাব ফাহিম কত চমৎকার একটি ছেলে ছিল। একইসঙ্গে আমাদের কাজ হবে ফাহিমের স্বপ্নগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখা। মনে হলো যেন, আমরা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছি।
প্রথম ধাপে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ফাহিমকে নিয়ে একটি বই প্রকাশ করব। যেটা পড়ে সবাই জানতে পারবে— ফাহিম শুধু লাখপতি হবার জন্যই কাজ করেনি, তার কাজের মাঝে ছিল প্রচুর আনন্দ, সৎ উদ্দেশ্য এবং বড় বড় স্বপ্ন বাস্তবায়ন।
আমার মানসিক ও শারীরিক অবস্থা তখনো বেশ খারাপ ছিল। আমার পক্ষে কলম ধরা বা নিজের মনকে শান্ত রাখা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এ কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাময়িকী ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো সমন্বিত করে একটি ইংরেজি ও একটি বাংলা বই প্রকাশ করব। শুরুতেই আমার মাথায় এলো দুটি প্রবন্ধের কথা।
একটি হচ্ছে আমার বড় মেয়ে রুবি অ্যাঞ্জেলার লেখা ‘মৌর্নিং মাই বেবি ব্রাদার ফাহিম’ (আমার ছোট ভাইয়ের জন্য শোক)। এ লেখাটি লাখো মানুষ পড়েছেন এবং শেয়ার করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে এ প্রবন্ধটির ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। অন্য প্রবন্ধটি হচ্ছে ‘ফাহিম সালেহ লিট আপ বাংলাদেশেজ স্টার্ট-আপ সিন লাইক নো আদার’ (বাংলাদেশের স্টার্টআপ অঙ্গনে আর কেউই ফাহিম সালেহ’র মতো এত আলো ছড়াতে পারেননি), যেটি লিখেছেন বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সাংবাদিক মাহমুদুল হাসান।
অনেকেই ফাহিমকে নিয়ে লিখেছেন এবং সেসব লেখা থেকে ছাপানোর জন্য আরও লেখা নির্বাচিত করা যেতে পারে। ফাহিমের জন্মদিন (১২ ডিসেম্বর) এগিয়ে আসছিল এবং আমি অস্থিরতায় ভুগতে শুরু করি। কলম হাতে নিয়ে ফাহিম সম্পর্কে কিছু লেখার চেষ্টা করলাম। শুরুতে একটু সমস্যা হলেও দুটি লেখা লিখে শেষ করতে পারলাম। ‘কাকে জানাব জন্মদিনের শুভেচ্ছা, কাকে জড়িয়ে ধরব?’ নামের লেখাটি তার জন্মদিনে জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল, আর ‘ছোট্ট ফাহিমের অর্থনীতি’ নামের লেখাটি প্রকাশিত হয় কালের কণ্ঠে।
একুশে বইমেলা সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রথম বইটি বাংলাতেই প্রকাশ করব। কিন্তু, কে সেটি প্রকাশ করবেন?
অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলামের কথা ভাবলাম। ১২ বছর আগে আমার বন্ধু এবং খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ আমাকে মাজহারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। হুমায়ুন আহমেদ নিজেই নিউইয়র্ক থেকে আমার একটি গল্পের বইয়ের পাণ্ডুলিপি মাজহারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ‘ঘূর্ণি নিলয়’ নামের বইটি ২০১০ সালে অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়।
মাজহারকে এক রাতে ফোন করি। তখন আমার কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা এবং আবেগ, সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। জানি না আমার কথার কতটুকু মাজহার বুঝেছিলেন। তিনি শুধু বললেন, ‘আমাকে আপনার লেখার কয়েকটি পাতা ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠান। পর্যালোচনা করে আপনাকে জানাব- আমরা বইটি ছাপাতে আগ্রহী হব কি না।’ এরপর আমি খুবই হতাশ হয়ে পড়লাম। তবুও উনাকে ফাহিমের ব্যাপারে দুটি প্রবন্ধ পাঠালাম। পরেরদিন সকালে আমি মাজহারের কাছ থেকে ফোন পেলাম। তিনি আমাকে না চিনতে পারার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, ‘আমি আপনার ফোন থেকে শুধু এটুকুই বুঝতে পেরেছিলাম যে, কেউ একজন ফাহিম সালেহকে নিয়ে একটি বই প্রকাশ করতে চাইছেন’। এরপর জানালেন, তিনি খুবই খুশি হয়েছেন, এত বছর পর আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি বললেন, ‘ফাহিম সালেহ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য একজন পথিকৃৎ। আমরা অবশ্যই ফাহিমকে নিয়ে লেখা বইটি প্রকাশ করব এবং বইটি প্রকাশ করতে পারা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়।’
এরপর আমি স্বস্তি পেলাম, একইসঙ্গে আনন্দিতও হলাম। ফাহিম খুবই দক্ষ একজন ওয়েব ডিজাইনার এবং শিল্পী ছিল। তার পেশাদারী প্রতিটি পণ্য এবং সেবার সঙ্গে ছিল নিখুঁত গ্রাফিক ডিজাইন। আমি শুধু মাজহারকে একটি শর্তই দিয়েছিলাম— বইটির গুণগত মান যেন খুব উঁচু পর্যায়ের হয়। তাহলে সেটা হবে ফাহিমের রেখে যাওয়া ভালো কাজের মানদণ্ডের সঙ্গে মানানসই।
মাজহার তার কথা রেখেছেন। তিনি বইটি অনেক যত্ন ও আবেগ দিয়ে প্রকাশ করেছেন। শিল্পী আহমেদ শামসুদ্দোহা বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য ফাহিমের একটি পোর্ট্রেট এঁকেছেন। মাসুম রহমান একজন অসাধারণ শিল্পী। হুমায়ুন আহমেদের প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদে তার সৃজনশীল কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। ফাহিমের বইতে তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন এবং প্রতিটি পৃষ্ঠার অঙ্গসজ্জার কাজটি সুন্দরভাবে করেছেন। আশা করি বইটি সবার পছন্দ হবে।
বইটি পড়ার পর মানুষ ফাহিমকে নতুনভাবে চিনতে পারবে। কোমল হৃদয়ের হাসিখুশি মানুষ ছিল ফাহিম। একইসঙ্গে সে কাজের প্রতি ছিল আপসহীন ও দৃঢ় সংকল্প। সে একজন লাখপতি ছিল, কিন্তু সে লাখপতি হবার জন্য কাজ করেনি। সে শুধু সেসব কাজই করতো, যা সে নিজে উপভোগ করতো এবং যেগুলোর পেছনে ভালো কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।
ফাহিম কীভাবে ‘ফাহিম’ হয়ে উঠল, সে ব্যাপারে বইটিতে বিভিন্ন গল্প রয়েছে। এটি ফাহিমের জন্য শোক প্রকাশ করার বই নয়, এটি তার জীবনকে জানানোর বই।
লেখক: সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ফাহিম সালেহ’র পিতা
Comments