মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রি কমেছে ৪০ শতাংশ
করোনাভাইরাস মহামারি সহসা শেষ হওয়ার আশা দেখতে পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। তাই খরচে লাগাম টেনেছেন অনেকে। আর এতে করে বাজারে মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রি গত জানুয়ারির তুলনায় কমেছে ৪০ শতাংশ।
পাশাপাশি সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় চলাচলে বিধি-নিষেধ আরোপের কারণেও মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রির ওপর প্রভাব ফেলেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাজারে মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রির পরিমাণ ভালো ছিল। মহামারির মধ্যে বাড়ি থেকে অফিস করা কিংবা ভার্চুয়াল মিটিংয়ে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি পরিবর্তিত নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে অনেককে মোবাইলসহ নানা ডিজিটাল পণ্য কিনতে হয়েছে।
দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজনের সঙ্গে যুক্তরা বলছেন, মহামারির শুরুর দিকে ক্রেতাদের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তারা অনলাইনে এসব ডিজিটাল পণ্য বিক্রির চেষ্টা করেছিলেন। যদিও তা দোকানে ভিড় করা ক্রেতাদের তুলনায় যথেষ্ট কম ছিল।
বাংলাদেশে স্যামসাংয়ের সংযোজন সহযোগী ফেয়ার ইলেক্ট্রনিকসের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দীন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সাধারণত জানুয়ারি মাসে মোবাইল ফোনের বাজার পড়তির দিকে থাকে। আমরা ভেবেছিলাম ফেব্রুয়ারি থেকে বিক্রি বাড়বে। কিন্তু তেমনটা হয়নি। বরং মার্চে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ও এপ্রিলের লকডাউনের কারণে আমাদের বিক্রি ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কমেছে।’
ফেয়ার ইলেক্ট্রনিকস ২০১৮ সালে বাংলাদেশে স্যামসাংয়ের হ্যান্ডসেট সংযোজনের কাজ শুরু করে। সে বছর প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করে ছয় লাখ ইউনিট স্মার্টফোন। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ লাখে। আর গত বছর এটা ১৭ লাখে পৌঁছায়।
মেজবাহ উদ্দীন জানান, স্যামসাং ব্র্যান্ডের ৯৯ শতাংশের বেশি স্মার্টফোন ও ট্যাব স্থানীয়ভাবেই তৈরি হয়। তার মতে, গত বছর মহামারির মধ্যেও মোবাইল ফোনের বাজার ১৫ শতাংশ বেড়েছিল।
তিনি বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের ভয় ও কঠোর লকডাউনের কারণে গত বছরের মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে স্মার্টফোনের বিক্রি ২০ শতাংশ কমে যায়। তবে জুন থেকে লকডাউন উঠে যাওয়ার পরবর্তী দুই মাসে বিক্রি যে পরিমাণ বেড়েছিল তাতে আগের তিন মাসের ক্ষতি পুষিয়ে যায়।’
তবে এবার দোকান খুলে যাওয়ার পরেও গত বছরের মতো বিক্রি বাড়ার আশা করতে পারছেন না মেজবাহ উদ্দীন।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে স্থানীয়ভাবে মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরি ও সংযোজনের সঙ্গে যুক্তরা এক কোটি ৮৬ লাখ হ্যান্ডসেট বিক্রির অনুমতি পেয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল হ্যান্ডসেটের বাজার ১১ হাজার কোটি টাকার। প্রতি বছর চাহিদা আছে তিন কোটি ২০ লাখ মোবাইল ফোনের। যার মধ্যে স্মার্টফোন মাত্র ২৮ শতাংশ, অর্থাৎ ৯০ লাখ।
সিম্ফনি ব্রান্ডের মূল প্রতিষ্ঠান এডিসন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকারিয়া শহীদের মতে, চলতি বছর বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের বাজারের প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়েছে। সামনের মাসগুলোতে পরিস্থিতি পরিবর্তনের ব্যাপারেও তিনি আশাবাদী হতে পারছেন না।
তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো মোবাইল ফোন তৈরির ক্ষেত্রে খুচরা যন্ত্রাংশের ঘাটতিতে পড়েছে। চীনসহ বিশ্বের সব জায়গায় এসব যন্ত্রাংশের দামে বেড়ে গেছে। এটা হয়েছে সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে।’
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো ততটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে মন্তব্য করেন জাকারিয়া শহীদ। তবে সব ধরনের ব্র্যান্ডকেই সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার বিষয়টি প্রভাবিত করছে।
জাকারিয়া শহীদ বলেন, ‘গত বছর কোভিড-১৯ মহামারির আগে আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না। কারণ মহামারি শুরুর আগেই চীনা নববর্ষের ছুটির কারণে আমরা সব মজুত করে রেখেছিলাম। কিন্তু এ বছর মার্চ থেকেই আমরা বিভিন্ন উপাদান ও যন্ত্রাংশের ঘাটতিতে পড়ে গেছি।’
বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে মোবাইল নেটওয়ার্ক নামের একটা দোকানের বিক্রয়কর্মী বলেন, ‘জানুয়ারি থেকে মার্কেটে অলস সময় কাটছে। আর মার্চ থেকে তো তেমন কেউ কেনাকাটা করতে আসছেনই না।’
ওই বিক্রয়কর্মী আরও বলেন, ‘আমরা দোকান খুলেছি। কিন্তু ক্রেতা খুবই কম।’
ফিচার ফোন ও কম দামের স্মার্টফোন বিক্রির ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্র্যান্ড ওয়ালটনের অবস্থা অনেকটা ভালো। ওয়ালটন মোবাইলের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা আসিফুর রহমানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ওয়ালটন এক লাখ ৮০ হাজার ইউনিট স্মার্টফোন ও ১১ লাখ ফিচার ফোন বিক্রি করেছে। যার বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকার বেশি।
আসিফুর রহমান বলেন, ‘মহামারির কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মোবাইল ফোনের ব্যবসার অবস্থা ভালো না। তবে দেশে সংক্রমণের নতুন ধাক্কা শুরুর পরেও এ বছর ওয়ালটনের মোবাইল বিক্রির অবস্থা অনেকটা ভালো।’
আসিফ আরও বলেন, ‘চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ইউরোপের বাজারে প্রচুর মোবাইল রপ্তানি হয়েছে। এ ছাড়া ঈদকে সামনে রেখে আমরা নতুন মডেলের কিছু স্মার্টফোন বাজারে আনতে যাচ্ছি। আশা করি, এ বছরটা মোবাইল ফোনের ব্যবসার জন্য ভালো হবে।’
গত বছর ওয়ালটন ৫০ লাখ ইউনিট মোবাইল ফোন তৈরি করেছিল। বিক্রি করেছিল ৬০০ কোটি টাকার ডিজিটাল পণ্য।
বছরের প্রথম প্রান্তিকের ব্যবসা নিয়ে অপ্পো বলছে, করোনা মহামারির কারণে গোটা বিশ্বই একটা কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
অন্যান্য ব্র্যান্ডের মতো অপ্পোও তাদের পণ্য বিক্রির জন্য অনলাইন চ্যানেল বাড়িয়েছে। এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া অপ্পোর এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ক্রেতাদের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে অপ্পো বিনামূল্যে হোম ডেলিভারি সেবা শুরু করেছে। যা এখনো চালু আছে। আমাদের কল সেন্টারগুলো ক্রেতাদের ২৪ ঘণ্টা সেবা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ক্রেতারা যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গা থেকে এই সেবা পাবেন।’
২৫ এপ্রিল থেকে শপিং মলসহ বিপণীবিতান খোলার অনুমতি দিয়েছে সরকার। অপ্পো মনে করছে, এতে করে বিক্রির পরিমাণ বাড়বে।
চীনা স্মার্টফোন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রিয়েলমি প্রায় এক বছর আগে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তারাও তাদের বাছাইকৃত কিছু মডেলের ক্ষেত্রে হোম ডেলিভারি ব্যবস্থা চালু করেছে।
রিয়েলমির এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রিয়েলমি বাংলাদেশে বিকাশমান ই-কমার্স খাতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। রিয়েলমি ফোনের একটা বড় অংশ এই ই-কমার্সের মাধ্যমেই বিক্রি হয়।’
শাওমি বাংলাদেশের মহাব্যবস্থাপক জিয়াউদ্দিন চৌধুরী জানান, লকডাউনের মধ্যে তাদের ব্র্যান্ডটিও বিভিন্ন ই-কমার্স পার্টনারের মাধ্যমে বিপণন প্রক্রিয়া চালু রেখেছিল।
বিটিআরসির হিসাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে তৈরি ও বিদেশ থেকে আমদানি করা মোবাইল ফোনের সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৯৪ লাখ। এর মধ্যে দেশেই তৈরি হয় এক কোটি ৪৯ লাখ মোবাইল ফোন।
এর মধ্যে দেশে তৈরি ২জি ফোনের (বার ফোন) সংখ্যা ছিল ৯৪ লাখ, ৩জি স্মার্টফোনের সংখ্যা ছিল নয় লাখ ৭৭ হাজার এবং ৪জি স্মার্টফোনের সংখ্যা ছিল ৪৫ লাখ ৯৯ হাজার।
একই সময়ে আমদানি করা বার ফোনের সংখ্যা ছিল এক কোটি ৩২ লাখ, ৩জি স্মার্টফোনের সংখ্যা ছিল চার লাখ ৭৪ হাজার এবং ৪জি স্মার্টফোনের সংখ্যা ছিল সাত লাখ ৬৫ হাজার।
এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে তৈরি ফোনগুলো দেশের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ পূরণ করতে পারছে।
বিটিআরসির তথ্য অনুসারে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের ৭৭ শতাংশই ২জি বার ফোন ব্যবহার করেছে। ১৮ শতাংশ ব্যবহার করেছে ৪জি ফোন। আর ৫ শতাংশ ব্যবহার করেছে ৩জি ফোন।
Comments