মুক্তিযুদ্ধ

২৯ এপ্রিল ১৯৭১: মার্কিন সিনেটে গণহত্যার বিবরণ, লন্ডনে ব্রিটিশ এমপির বিবৃতি

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৯ এপ্রিল ছিল অন্যতম ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন নিউইয়র্কে পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কর্মকর্তা মাহমুদ আলীর পদত্যাগের তারবার্তা পেয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাকে অভিনন্দন জানান।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৯ এপ্রিল ছিল অন্যতম ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন নিউইয়র্কে পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কর্মকর্তা মাহমুদ আলীর পদত্যাগের তারবার্তা পেয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাকে অভিনন্দন জানান।

মার্কিন সিনেটর উইলিয়াম সেক্সবি মার্কিন সিনেটে ঢাকায় গণহত্যার এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান সম্বলিত একটি চিঠি পাঠ করেন। হাউজ অব কমন্সের সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যান এদিন ভারতের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে লন্ডনে ফিরে গণহত্যা নিয়ে বিবৃতি দেন। ঘাঘট নদীর তীরে এদিন হানাদারেরা নির্মম কায়দায় হত্যা করে ১২৫ জন ইপিআর সৈনিককে।

ঢাকায় ২৯ এপ্রিল, ১৯৭১

ঢাকায় সামরিক সরকার এক বিজ্ঞপ্তিতে পহেলা মে থেকে ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে কলোনি, সেক্রেটারিয়েট এলাকা ও শাহজাহানপুর কলোনি এলাকায় বসবাসকারী লোকদের উৎখাতের নির্দেশ দেয়।

সামরিক সরকার ২৯ এপ্রিল এক ঘোষণায় ঢাকা শহরের দেয়াল থেকে রাজনৈতিক স্লোগান, মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা নিয়ে প্রতিবাদ লিখনি মুছে ফেলার নির্দেশ দেয়।

করাচিতে মুসলিম লীগ প্রধানের সংবাদ সম্মেলন

করাচি প্রেসক্লাবে মুসলিম লীগের প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম খান এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, যে সব রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার জন্য সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছিল এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে শিগগিরই ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করেছিল সেসব দলকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত।

তাজউদ্দীন আহমদের অভিনন্দনপত্র

নিউইয়র্কে পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কর্মকর্তা মাহমুদ আলীর পদত্যাগের তারবার্তা পেয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা থেকে  তাকে অভিনন্দন জানান। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দেন।

বিদেশি রাষ্ট্রীয় ও প্রভাবশালী নেতাদের বিবৃতি

২৯ এপ্রিল মার্কিন সিনেটর উইলিয়াম সেক্সবি মার্কিন সিনেটে একটি চিঠি পাঠ করেন। চিঠিটি তাকে পাঠিয়েছিলেন ঢাকায় নিয়োজিত ডা. জন ই. রড। তিনি ঢাকায় চিকিৎসক ও উন্নয়নকর্মী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এই চিঠিতে ডা. রড ২৫ মার্চ থেকে পরবর্তীতে বহু গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন কীভাবে নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। শিশু এবং বৃদ্ধরাও নির্যাতন ও গণহত্যার হাত থেকে বাঁচতে পারছে না। পৈশাচিক নির্যাতন, গণহত্যা, নিপীড়নের বাস্তব প্রমাণ ছিল চিঠির ভাষ্যে।

ব্রিটিশ হাউজ অব কমেন্সের সদস্য, লেবার পার্টির নেতা ব্রুস ডগলাসম্যান এদিন  ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে লন্ডনে পৌঁছান। তিনি দেশে ফিরে এক বিবৃতিতে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা কেবল  পূর্ববঙ্গের মাটি চায়,  জনগণকে চায়না। ওরা সব বাঙালিকে গণহত্যা চালিয়ে খুন করছে। কোনো বাঙালিই ওই মাটিতে তারা রাখতে দেবে না। আমার মতে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির বিষয়ে ব্রিটেনের উচিত পদক্ষেপ নেওয়া। কারণ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সম্পূর্ণ বৈধ এবং তাদের দলটিই নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছিল।

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের দুর্দশা দূর করতে জাতিসংঘ এখনো পাকিস্তান সরকারের উপযুক্ত দায়িত্বে বিশ্বাস করে। জাতিসংঘ মনে করে পাকিস্তানের মানুষের  পরিস্থিতি ও জাতিসংঘ কিভাবে সাহায্য করবে তা পাকিস্তান সরকারের উপর নির্ভর করে তারা কিভাবে গ্রহণ করবে।’

২৯ এপ্রিল ভারতের রাজস্থানের বিধানসভায় সরকারদলীয় নেতা এবং বিরোধী দলের সদস্যরা বাংলাদেশের পক্ষে বিবৃতি দেন। একইসঙ্গে অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তারা বলেন, ঘৃণ্য ইয়াহিয়া খানের কবল থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে ভারত সরকারের উচিত বৈশ্বিকভাবে পদক্ষেপ নেয়া।

বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ সমিতির সভাপতি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় ২৯ এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের এখন প্রয়োজন খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধসহ জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিস। তিনি সরকারের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি মানুষকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলা বাংলা ভাই ভাই। বাংলার মানুষের জন্য তো বাংলার মানুষই এগিয়ে আসবে।

কলকাতায় এদিন বাংলাদেশের পক্ষে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। আলোকচিত্র প্রদর্শনীর নাম ছিল, "বাংলাদেশের হৃদয় হতে"।

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে এক বিবৃতিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড হীরেণ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জরুরিভিত্তিতে লোকসভার অধিবেশন ডাকা উচিত। পাকিস্তানিরা আমাদের ভূমিতে ঢুকে আমাদেরই মানুষ হত্যা করছে, আর তখন লোকসভা বন্ধ। প্রয়োজনে লোকসভার বিশেষ অধিবেশন করা হোক।’

গণহত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লন্ডনে প্রবাসী বাঙালিদের বিক্ষোভ

২৯ এপ্রিল লন্ডনে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাংলাদেশীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দল অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছানোর আগেই বিক্ষোভকারীরা সেখানে উপস্থিত হন। তারা প্রতিবাদ স্বরূপ বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড বহন করেন। যেখানে লেখা ছিল, ‘হত্যাকারী খুনিরা ফিরে যাও’, ‘গণহত্যা অবিলম্বে বন্ধ করো’, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘খুনি ইয়াহিয়ার নিপাত চাই’সহ নানা ধরনের দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ ক্রিকেটারদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল।

সারাদেশে গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ

২৯ এপ্রিল কুমিল্লার বড়কামতায় হানাদার বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দুই দফায় সংঘর্ষ হয়। দু’বারই মুক্তিবাহিনী দোর্দণ্ড প্রতাপে বিজয়ী হয়। বড়কামতার যুদ্ধে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়েছিল। প্রতিরোধের মুখে হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রশস্ত্রও কাজে আসেনি।

২৯ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আসাদ আহমদ বায়রনের নেতৃত্বে একদল গেরিলা নবাবগঞ্জ মহকুমার শিবগঞ্জ থানার পাগলা নদীর তীরে কানপুরে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদারদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। কানুপুরের যুদ্ধে তিন জন হানাদার সৈন্য,  দশ জন রাজাকার নিহত হয়। এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের এই অপারেশনের গাইড ছিল ৯-১০ বছরের একটি ছোট্ট ছেলে।

২৯ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাসের কাছে ঘাঘট নদীর তীরে ১২৫ জন বাঙালি ইপিআর যোদ্ধাকে নিষ্ঠুর কায়দায় গুলি করে হত্যা করে হানাদারেরা।

২৯ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধা নায়েক সফি তার সেকশন নিয়ে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি আউটার সিগন্যালে অ্যামবুশরত অবস্থায় হানাদার বাহিনীর তিনটি গাড়ি অগ্রসর হলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে দু-তিন ঘণ্টাব্যাপী গুলি বিনিময় হয়। এতে পাকিস্তানি হানাদারদের একজন সৈন্য গুরুতরভাবে আহত হয় এবং গাড়ি তিনটি অকেজো হয়ে যায়। হানাদার বাহিনীর গুলিতে একটি ছেলে ও একজন বৃদ্ধ শহীদ হন।

২৯ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দল চট্টগ্রামের করেরহাট-হিয়াকুল হয়ে খাগড়াছড়ির রামগড়ের দিকে অগ্রসর হয়। অপর একটি দল ফেনীর শুভপুর ব্রিজ এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ চালায়। অন্য একটি দল গুইমারা হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হয়। হানাদারদের আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে মেজর জিয়া, মীর শওকতকে শিগগির রামগড় চলে আসতে নির্দেশ দেন।

দেশের উত্তরাঞ্চলের হিলি সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি হানাদারদের  মধ্যে দিনব্যাপী প্রচণ্ড গোলাবিনিময় হয় এদিন।

২৯ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এলাকায় প্রবেশ করে। এসেই হানাদাররা নির্বিচারে হত্যা করে শতাধিক যুবক, ছাত্র ও বৃদ্ধকে।

২৯ এপ্রিল হানাদার বাহিনী সিলেটের সুরমা ও তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ঢুকে গণহত্যা চালায়। হানাদার বাহিনীর ব্রাশফায়ারে ৩০ জন চা শ্রমিক শহীদ হন।

পাকিস্তানি হানাদারেরা ২৯ এপ্রিল দালালদের সহযোগিতায় সৈয়দপুরগামী একটি ট্রেনের কামরায় ২৫ জন বাঙালিকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে।

তথ্যসূত্র -

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র অষ্টম, নবম, ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান, ৩০ এপ্রিল ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৩০ এপ্রিল ১৯৭১

আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০ এপ্রিল ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

আরও পড়ুন:

২৮ এপ্রিল ১৯৭১: গণতান্ত্রিক ও মুক্তিকামী মানুষকে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান তাজউদ্দীন আহমদের

২৭ এপ্রিল ১৯৭১: কালীগঞ্জে গণহত্যা, ইপিআরের নাম পাল্টে ইপিসিএফ

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

14h ago