পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নিহত: চীনা রাষ্ট্রদূতের কাছে ৮১ নাগরিকের চিঠি
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নিহত ও আহতের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূতের কাছে প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছে নাগরিক সমাজ। প্রতিবাদলিপিতে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাসহ চারটি দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
আজ শুক্রবার চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের কাছে ওই প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে। নাগরিক সমাজ থেকে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, বাঁশখালীর এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টটি যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশের এস আলম গ্রুপ এবং চীনা প্রতিষ্ঠান সেফকো থ্রি পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড ও এইচটিজি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ এই যৌথ উদ্যোগের সঙ্গে রয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীনের উন্নয়ন ব্যাংক, ব্যাংক অব চীন ও চীনের কনস্ট্রাকশন ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে। এই প্রকল্পের মোট বাজেটের ৭০ দশমিক ৭১ শতাংশই তাদের। গত ১৭ এপ্রিল পুলিশ ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ওপর গুলি চালালে সাত জন নিহত হন, আহত হন আরও অনেকেই। গুলি চালিয়ে শ্রমিকদের হতাহত করার কাজটি অবশ্যই একটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। আরও দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো— এই ঘটনার পর সাড়ে তিন হাজার অজ্ঞাতনামা শ্রমিক ও স্থানীয়দের বিরুদ্ধে পুলিশ মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। বর্তমানে এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের শোষণ থেকে নিজেদের রক্ষার্থে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন শ্রমিকরা। এবারই প্রথম নয়, এর আগেও প্রকল্পটিতে এ ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে পুলিশ ও স্থানীয় গুন্ডারা প্রায় ১২ জনকে হত্যা করেছে।
শ্রমিকদের দাবি-দাওয়াগুলো সহজ ও ন্যায্য ছিল উল্লেখ করে প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, তাদের দাবির মধ্যে ছিল— বকেয়া মজুরি পরিশোধ করা, প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা কাজ করার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা, রমজান মাসে কাজের সময় আট ঘণ্টা নির্ধারণ করা ও শুক্রবারে নামাজের জন্যে এক ঘণ্টার বিরতি দেওয়া। এগুলো তাদের দাবি নয়, শ্রমিক আইনের আওতায় এগুলো তাদের অধিকার।
প্রতিবাদলিপিতে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পটির ধরন অনুযায়ী বাঁশখালীতে তা চালু করার পর থেকে যতজন শ্রমিককে হত্যা করা হলো ও যতগুলো সহিংস ঘটনা ঘটল, এর দায় চীন সরকার অস্বীকার করতে পারে না। চীন সরকার ভবিষ্যতে নিজ দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু, একই সরকার বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এ ধরনের প্রকল্প পরিচালনা করছে।
বাঁশখালীর এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজের দাবিগুলো হলো—
১. নিহত ও আহত শ্রমিকরা যাতে ন্যায়বিচার পায়, তা নিশ্চিত করা।
২. শ্রমিকদের হত্যা, আহত ও হয়রানির জন্যে দায়ী চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে চীনের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া।
৩. আন্তর্জাতিক আইনি মান অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
৪. প্রকল্পটির সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার জন্যে যৌথ উদ্যোগ চুক্তি প্রকাশ করা।
সবশেষে প্রতিবাদলিপিতে এই দাবিগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে চীন সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষা করার আহ্বান জানানো হয়েছে রাষ্ট্রদূতের কাছে।
প্রতিবাদলিপিতে সই করেছেন নাগরিক সমাজের ৮১ সদস্য। তাদের মধ্যে রয়েছেন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. আকমল হোসেন, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী সি আর আবরার, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশি কবীর, নারী আন্দোলন ও মানবাধিকারকর্মী শিরীন পি হক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, জাবির নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিয়ারা নাসরিন, ঢাবির আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান, যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে গ্র্যান্ড ভ্যালি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আজফার হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ঢাবির অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রুশাদ ফরিদী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের (বিপিএফ) পরিচালক ড. নায়লা জামান খান, গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন, মানবাধিকারকর্মী মো. নুর খান, গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী মেঘনা গুহঠাকুরতা, জাতীয় নদী জোটের আহবায়ক শারমিন মুরশিদ, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি প্রমুখ।
আরও পড়ুন:
বাঁশখালীতে শ্রমিক বিক্ষোভ: ২ মামলায় সাড়ে ৩ হাজার আসামি
বাঁশখালীতে পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নিহতের ঘটনার নিন্দা, ৬৮ নাগরিকের বিবৃতি
বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, নিহত ৫
Comments